চার মাস কেটে গেল। খালি পড়ে রয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উপাচার্যের কূর্সি। আরও কতকাল খালি পড়ে থাকবে, কেউ বলতে পারছেন না। একসময় এখনকার পাকিস্তান, বাংলাদেশ মায়ানমার-সহ উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল ঐতিহ্যপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের এক্তিয়ার। আজ এ সবই অতীত।
কয়েক দশক ধরে ডানা ছাঁটার পরে এখনও ১৫৩টি কলেজ রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। মূল ভিসি-র অভাবে প্রায় বসে বসে বেতন পাচ্ছেন ওই বিভাগের জন্য পৃথক বরাদ্দ আট কর্মী-আধিকারিক। অস্বস্তিতে তাঁরা। দীর্ঘকাল ধরে সহ উপাচার্য (অর্থ)-র পদ খালি পড়ে থাকায় প্রায় কর্মহীন হয়ে বেতন পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগের কর্মী-আধিকারিকরাও।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভিসি-র ঘরের কূর্সিতে কেউ বসছেন না। সূত্রের খবর, উপাচার্য পদে প্রতিষ্ঠানে পুনর্নিয়োগ নিয়ে হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্ট সঠিক বলে মন্তব্য করার পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যাওয়া বন্ধ করে দেন। কিছুকাল বাদে রাজ্যের সুপারিশে আচার্য-রাজ্যপাল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য (শিক্ষা) ডঃ আশিস চট্টোপাধ্যায়কে অস্থায়ীভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব দিলেও তিনি মূল উপাচার্যের ঘরে না বসে নিজের ঘরে বসছেন। ফলে ভিসি-সচিবালয়ের আধিকারিকদের সেভাবে কাজ নেই।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সনাতন চট্টোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, “এক আধিকারিক বলছিলেন, ভিসি-র নামে আসা চিঠিগুলো কেবল অন্য ঘরে তাঁর (ভারপ্রাপ্ত ভিসি) হাতে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া সেভাবে কিছু করার অবকাশ হচ্ছে না।“
১৯ জানুয়ারি শেষ হয়ে গিয়েছে আশিস চট্টোপাধ্যায়ের ভিসি পদের আইনি সময়সীমা। ফলে আটকে গিয়েছে প্রশাসনিক বহু কাজ। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “আশা করছি এ নিয়ে সরকারি তরফে শীঘ্রই একটা নির্দেশিকা পাব। অন্যথায় খুব অসুবিধে হচ্ছে।”
কী অসুবিধে? আশিসবাবুর জবাব, “আইন অনুযায়ীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেটে আলোচনা আবশ্যিক। কিন্তু সেই বৈঠক ডাকতে পারছি না। শিক্ষকদের বহু পদ খালি। নিয়োগপ্রক্রিয়া আটকে গিয়েছে। ব্যাহত হচ্ছে পঠনপাঠন। হরিণঘাটায় একটি গবেষণাপ্রকল্পকে কার্যকরী করতে বাইরের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা দরকার। এরকম অনেক কিছু করা যাচ্ছে না ভিসি-র এক্তিয়ার না থাকলে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থায় রীতিমত অস্বস্তিতে সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়ও। এই প্রতিবেদককে বলেন, “এই অবস্থা আমাদের সকলের খারাপ লাগার কথা। আমি ১৯৮৫ থেকে ২০১৫ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলাম। সহ উপাচার্যের পদও সামলাতে হয়েছে। অনেক ক্ষতি হচ্ছে। অবিলম্বে এই অবস্থা দূর না হলে ভবিষ্যতে আরও ক্ষতি হবে।” এর জন্য কি মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী অথবা আচার্য-রাজ্যপালের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ দরকার? ধ্রুবজ্যোতিবাবুর জবাব, “না। যেটা দরকার সঠিক নিয়ম ও আইনের সার্থক রূপায়ণ।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক প্রাক্তন উপাচার্য তথা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ আশুতোষ ঘোষ এখন সিঙুর রানি রাসমনি গ্রিন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। তিনি বলেন, “যা হয়েছে, যা হচ্ছে খুব ক্ষতিকারক। পূর্ণ দায়িত্বের ভি সি না থাকলে সত্যি জটিলতা দেখা দেয়। এই রকম পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তার একটা ব্যবস্থা থাকা অবশ্যপ্রয়োজনীয়।“
অধ্যাপক সমিতির (WBCUTA) প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ড. শ্রুতিনাথ প্রহরাজ এই প্রতিবেদককে বলেন, “ রাজ্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখন চলছে চুক্তি ভিত্তিক উপাচার্যদের নিয়ে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য ও স্তাবকতা প্রধান মাপকাঠি হওয়ায় প্রকৃত অর্থে যোগ্য মানুষরা এই দায়িত্ব নিতে চাইছেন না এখন। আর এসব যিনি দেখতেন এতদিন, উপাচার্যদের নেতা সেই মানুষটি এখন দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন। সব মিলিয়ে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে। এককথায় নজীরবিহীন পরিস্থিতি। অতীতে কখনও রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে এহেন সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীগণ।”
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সনাতন চট্টোপাধ্যায় এই প্রতিবেদককে জানান, “বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা ভীষণ সঙ্গীন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এখন সম্পূর্ণরূপে অভিভাবক হীন। খুব সাধারণ এবং গতানুগতিক কিছু কাজ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। সমস্ত রকমের মুখ্য সিদ্ধান্ত আটকে আছে। আমরা প্রথমেই স্থায়ী উপাচার্যের দাবি জানিয়েছিলাম। সেটা শুনলে এই নৈরাজ্যের উদ্রেক হতো না।“