ঢাকার জৌলুশ পৃথিবীর সবাইকেই আকর্ষণ করতো। যিনি একবার ঢাকার দ্বারপ্রান্তে এসেছেন, অবাকই হয়েছেন নগরীর কোনো না কোনো রূপে। বলা হয়ে থাকে, একবার এক ইংরেজ পর্যটক ঘোড়ায় চড়ে গেন্ডারিয়ার লোহারপুলের কাছে এসে চারপাশের দৃশ্য দেখে বলেছিলেন, ‘What a Grand Area!’ সেই থেকে ঐ আবাসিক এলাকার নাম হয়ে যায় ‘গেন্ডারিয়া’(Grand. area)।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঢাকার প্রথম আবাসিক এলাকা গড়ে উঠে গেন্ডারিয়ায়। এখানে আছে যোগেশ চন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠিত সাধনা ঔষধালয়, সীমান্ত খেলাঘর আসর, কিশলয় কচিকাঁচার মেলা, গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
পূর্ববঙ্গের স্কুলসমূহের ডেপুটি ইন্সপেক্টর, পোগোজ স্কুলের প্রথম বাঙালি প্রধান শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক এবং সাংবাদিক দীননাথ সেন এবং আর দুজন প্রভাবশালী উকিল রজনীকান্ত চৌধুরী ও আনন্দ চন্দ্র রায় মিলে গেন্ডারিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল কিনেছিলেন। দীননাথ সেনই একমাত্র থাকার জন্য বাড়ি নির্মাণ করেন এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে গেন্ডারিয়া পরিণত হয়েছিল মধ্যশ্রেণির আবাসিক এলাকা হিসেবে।
দীননাথ সেন ছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের দাদাশ্বশুর। দীননাথ সেনের নাতি, বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়।
গেন্ডারিয়ায় আছে সোনা মিয়া মিষ্টান্ন ভান্ডার! কথিত আছে, সুচিত্রা সেন এই দোকানের মিষ্টি খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন! গেন্ডারিয়ার অন্যতম প্রধান সড়ক দীননাথ সেন রোড। এর বাইরে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মধ্যে রয়েছে ডিস্টিলারি রোড, সতীশ সরকার রোড, রজনী চৌধুরী রোড, এস কে দাশ রোড।
ঢাকার অন্যতম জল বিশুদ্ধকরণ প্রকল্প : ১৮৮৫ সালের নথি অনুযায়ী ধোলাই খালের পূর্ব পাড়ে গড়ে উঠেছিল জল বিশুদ্ধকরণ ও সরবরাহ প্রকল্প। বৃটিশ আমলে যা ভাটিখানা বা ডিস্টিলারি রোড নামে পরিচিত ছিল- ডিস্টিল ওয়াটার থেকে ডিস্টিলারি।
গেন্ডারিয়ার পূর্বে ১৮৮৫ সালে চালু হওয়া গেন্ডারিয়া রেল স্টেশন। কমলাপুর থেকে গেন্ডারিয়া হয়ে ট্রেন নারায়ণগঞ্জ যেত। এখন সাময়িকভাবে এই রেল লাইন বন্ধ আছে। পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রজেক্টের কারণে রেলস্টেশনটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরী করা হচ্ছে। গেন্ডারিয়ার পশ্চিমে সংযোগ রক্ষা করে ছিল দুটি পুল। একটি লোহার তৈরি, নাম লোহারপুল। অন্যটি কাঠের খুঁটি ও পাটাতনের। নাম কাঠেরপুল। তবে এখন এই দুটি পুলের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুলের নিচে প্রবাহিত খালটি ঢাকা মেগাসিটির ব্যস্ততম মহাসড়ক। গেন্ডারিয়ার দক্ষিণে এক সময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা।
১৯২৪ সালে গেন্ডারিয়ায় গঠন করা হয় তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রথম নারীসংগঠন ‘গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি’, যার সভানেত্রী ছিলেন বিপ্লবী আশালতা সেন। আশালতা সেনের বাড়িটি বর্তমানে ‘গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়’ হিসেবে পরিচিত। গেন্ডারিয়ার আরেকটি পুরোনো সংগঠন “আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম”। মুসলমানদের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য গঠিত হয়েছিল সংগঠনটি।
গেন্ডারিয়ার সীমান্ত গ্রন্থাগার শুধু একটি পাঠাগার নয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নাম। নাসিম আলী, যাঁর ডাক নাম কচি ভাই, এই পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়তেন। বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অল্প কিছু বই নিয়ে শুরু করেছিলেন পাঠাগারটি। ইমদাদুল হক মিলন থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে এই পাঠাগারটির বিরাট অবদান। সম্প্রতি আধুনিকায়ন হয়েছে পাঠাগারটি। গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার মেলা দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় শিশু-কিশোর সংগঠন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গেন্ডারিয়া একসময় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রগামী ছিল। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, কবি, সাংবাদিক ক্রীড়াবিদের পদচারণে মুখর ছিল এলাকাটি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি আমিনুল ইসলাম, লেখক হায়াৎ মামুদ, অভিনেতা হাসান ইমাম, শওকত আকবর, সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, নায়িকা শাবানা, নীনা হামিদ, আলী যাকের, এ টি এম শামসুজ্জামান, ড. মেহের-এ-খুদা, বজলে মওলা, ইমরুল চৌধুরী, কায়েস আহমেদ, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার, ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম বুলবুল, ক্রীড়া ভাষ্যকার আবদুল হামিদ প্রমুখ।