তারপর আর কত বৎসর অতিক্রান্ত হল। ইন্দ্র , বিরোচন পুনশ্চঃ প্রজাপতির আশ্রমে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে লাগলেন ব্রহ্মজ্ঞানের আশায়। হৃদয়ের মলিনতা কবে যে দূরীভূত হবে সেই দিনের অপেক্ষায় রইলেন। একদিন আবার প্রজাপতি ব্রহ্মা যজ্ঞ শেষে ইন্দ্র ও বিরোচনকে একটি জলপূর্ণ পাত্র আনার জন্য আদেশ করলেন। পাত্র আনা হলে , প্রজাপতি বললেন, ” উদশরাব আত্মানমবেক্ষ্য যদাত্মনো ন বিজানীথস্তন্মে প্রবূতমিতি…তৌ হোদশরাবেহবেক্ষাংচক্রাতে …. কিং পশ্যথ ইতি! – জলের দিকে তাকিয়ে কি দেখছ তোমরা? আমি বলছি যে জলের মধ্যে আত্মা আছে। এবার এই বাক্য যদি তোমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়, যদি কোনো সংশয় থাকে , তাহলে আমাকে বলো, আমাকে প্রশ্ন করো। ” প্রকৃত গুরু বা শিক্ষক হন তবে তিনি শিষ্যের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।
কিন্তু শিষ্য যখন চিন্তা ভাবনাই না করেন তখন ? গুরু তো ভারী মুশকিলে পড়েন এসব শিষ্যদের নিয়ে। এরা স্কুলের সেই সব ছাত্রদের মতো হয় যারা মাথা খাটায় না , শিক্ষক প্রশ্ন করলে ভুল উত্তর দেয় এবং বকা দিলে শিক্ষকেই দোষী করে। ইন্দ্র এবং বিরোচন কিয়ৎ তেমনি শিষ্য ছিলেন। প্রজাপতির প্রশ্ন শুনে তৎক্ষণাৎ চিন্তা না করেই উত্তর করলেন, ” সর্বমেবেদমাবাং ভগব আত্মানং পশ্যাব আ লোমভ্য আ নখেভ্যঃ প্রতিরূপমিতি -আমরা জলে আমাদের মাথা চুল থেকে নখ পর্যন্ত আমাদের আত্মার পূর্ন প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছি।” তাঁরা একবারও চিন্তা করলেন না যে নখ, চুল এবং অন্যান্য দৈহিক চিন্হ বিশিষ্ট দেহ কখনো আত্মা হতে পারে না।
সেইদিন আমি ভেবেছিনু মনে
উদাস হইয়া যাইব চলি।
তখনো হায় রে একটি বাঁধনে
আবদ্ধ আছিল পরাণ দেহ।
সে দৃঢ় বাঁধন ভেবেছিনু মনে
পারিবে না আহা ছিঁড়িতে কেহ!
আজ ছিঁড়িয়াছে, আজ ভাঙিয়াছে,
আজ সে স্বপন গিয়াছে চলি।
প্রেম ব্রত আজ করি উদ্যাপন
ভিখারি হইয়া যাইব চলি!
জানো তো, বেদান্ত দর্শনে ধ্রুবতারার উদাহরণ দেওয়া হয় । মনে কর, কাউকে তুমি ধ্রুবতারা দর্শন করাচ্ছ। কিভাবে করাবে? প্রথমে তুমি একটি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তারপর তাকে সেই বৃক্ষের বড় ডালখানি দেখাবে। তারপর বড় ডালের পিছনে ছোট একটি ডাল দেখিয়ে বলবে, ” ওর পিছনে যে তারাটি দেখা যাচ্ছে সেটিই ধ্রুবতারা।” অর্থাৎ , ধীরে ধীরে তুমি তোমার সঙ্গীকে লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছ। প্রজাপতিও তাই করলেন। তিনি ইন্দ্র ও বিরোচনকে ভুল বোঝাচ্ছেন না। তাঁরা যে অবস্থায় আছেন , সেইখান থেকে ধাপে ধাপে তাঁদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
মঙ্গল করো হে, আজি মঙ্গলবন্ধন
তব শুভ আশীর্বাদ করি বিতরণ।
বরিষ হে ধ্রুবতারা, কল্যাণকিরণধারা–
দুর্দিনে সুদিনে তুমি থাকো চিরসাথী॥
প্রজাপতি যখন দেখলেন তাঁর শিষ্যরা কিছুই পারছে না , তখন তিনি উভয়কে বললেন , ” স্নান করে, চন্দন চর্চিত হয়ে, রাজবেশে, স্বর্ণমণিমানিক্য খচিত মূল্যবান অলঙ্কারে সুজ্জিত হয়ে জলপূর্ণ পাত্রের দিকে তাকাও।
সাঞ্চলঙ্কৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বোদশরাবে বেক্ষেথামিতি তৌ হ সাধ্বলঙ্কৃতৌ সুবসনৌ পরিষ্কৃতৌ ভূত্বোদশরাবে বেক্ষাংচক্রাতে তৌ হ প্রজাপতিরুবাচ কিং পশ্যথ ইতি।।”
ইন্দ্র ও বিরোচন প্রজাপতির আদেশ মেনে নিলেন। তাঁরা রাজবেশে নিজেদের পুনরায় সজ্জিত করে এসে জলপূর্ণ পাত্র আপন আপন প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করলেন। পূর্বের ন্যায় এবারেও তাঁদের উপলব্ধি একই হল। বরং তাঁদের উপলব্ধি হওয়া উচিত ছিল যে লোমনখ সুজ্জিত দেহ কখনো আত্মা হতে পারে না। কিছু পূর্বেও এসব তাঁদের শরীরে ছিল না। পরে তাঁরা তা ধারণ করেছেন। প্রজাপতি চাইছিলেন যে দুই মহাবলী রাজা গুরুগৃহে অন্তত বুদ্ধিটুকু ব্যবহার করুক।
রাজবেশ, রাজ অলঙ্কার পরিহিত এক দেহ কিভাবে আত্মা হতে পারে? সর্ব ভয় থেকে কি তা মুক্ত হতে পারে? আত্মা তো অপরিবর্তনীয়। তাহলে ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন পোশাকে এই দেহ কেন ভিন্ন ভিন্ন দেখায়? কিন্তু প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্র ও বিরোচন কোনো প্রশ্ন করলেন না। তাঁরা ভাবলেন, তাঁদের যা খোঁজ ছিল, যা প্রশ্ন ছিল, যে জ্ঞান লাভের তৃষ্ণা ছিল তা তাঁরা প্রাপ্ত হয়েছেন। তাই সন্তুষ্ট হয়ে বিদায় নিলেন।
সাধারণতঃ এই মহামায়ার সংসারে সকলের মনই সর্বদা সন্দেহ, সংশয়ে দোদুল্যমান থাকে। এই তো মনের স্বভাব তাই। তখনই মন শান্ত হয় যখন সে সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেয়ে যায়, যখন সে আপন লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। উপনিষদ বলছেন যে ইন্দ্র ও বিরোচন শান্ত মনে আপন আপন প্রতিবিম্ব দেখে বিদায় নিলেন। অর্থাৎ , তাঁদের মনে কোনো সংশয়, কোনো প্রশ্নের অবকাশ ছিল না। প্রজাপতির ইঙ্গিতেই তাঁরা তাঁদের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন বলে ভাবলেন।
তাঁদের চলে যেতে দেখে প্রজাপতি কেবলমাত্র অবাকই হলেন না। দুঃখিতও হলেন। এ কি? দুই মহাবলী, মহারথী স্বর্গলোক, পাতাললোকের দুই মহান রাজা তাঁদের এইটুকু বুদ্ধি নেই ? কেবলমাত্র ধাঁধার প্রশ্নকে উত্তর ভেবে সন্তুষ্ট হয়ে চলে যাচ্ছে? দুজনে একটু কিছু উপলব্ধি করার চেষ্টাও করল না।
তৌ হান্বীক্ষ্য প্রজাপতিরুবাচানুপলভ্যাত্মানমননুবিদ্য ব্ৰজতো যতর এতদুপনিষদো ভবিষ্যন্তি দেবা বাংসুরা বা তে পরাভবিষ্যত্তীতি স হ শান্তহৃদয় এব বিরোচনোঽসুরাঞ্জগাম তেভ্যো হৈতামুপনিষদং প্রোবাচাত্মৈবেহ মহয্য আত্মা পরিচর্য আত্মানমেবেহ মহয়ন্নাত্মানং পরিচরন্নুভৌ লোকাববাপ্নোতীমং চামুং চেতি ॥
প্রজাপতির এ দুঃখ স্বাভাবিক। তিনি ইন্দ্র ও বিরোচনের শুভাকাঙ্ক্ষী, গুরু । তাই মনে মনে বললেন, ” হায়, মহামায়া ….ওরা রাজা হয়েও কেমন যেন অবোধ শিশুর মতো করল। ওরা কিছু না জেনেই চলে গেল। ওরা তো আমাকে প্রশ্ন করতে পারত যে , দেহের পরিবর্তন হলে কি আত্মারও পরিবর্তন হয়? কিন্তু হায়, ওরা কোনো প্রশ্ন করল না। এই যে কোনো বিষয়কে না বুঝেই গ্রহণ করা , তা সে দেব হোক বা অসুর যেই করুক সে পথভ্রষ্ট, সত্যভ্রষ্ট হয়। তার বিনাশ ব্যতীত অন্যগতি থাকে না।
আত্মা যেথা লুপ্ত থাকে সেথা উপচ্ছায়া
মুগ্ধ চেতনার ‘পরে রচে তার মায়া,
তাই নিয়ে ভুলাব কি আমার জীবন।
গাঁথিব কি বুদ্বুদের হার।
বিরোচন অসুরকুলে ফিরে গিয়ে বললেন , ” শোন মহাশক্তিশালী অসুর কুল, আমি আমার সকল প্রশ্নের উত্তরই পেয়ে গেছি, এই দেহই আত্মা।তাই এই আপন আপন দেহের পূজা করো ,সেবাযত্ন করো। তা যদি করো তবে ইহকাল, পরকাল সকলই তোমার হবে।” অসুরকুল আপন দোষে অমৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হলেন। তাঁরা অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার সংসারে জাগতিক বিষয়ী জীবনদর্শন গ্রহণ করলেন। খাও, দাও, পরিচর্যা করো, আরাম করো, ভোগ করো, স্ফূর্তি করো, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পাপ করো, জীবনকে উপভোগ করার জন্য যেকোনো পর্যায় অবধি যাও। যা স্থূল , ইন্দ্রিয়েগোচর তাই তাঁদের নিকট সত্য হল। যা সূক্ষ্ম ,ইন্দ্রিয়েগোচর নয় তাই মিথ্যা। বিরোচনের প্রচারিত এই ভুল মতে অসুরকুল বিনষ্টের পথে এগিয়ে গেল।
বিরোচন অসুরদের যে বৈষয়িক দেহবাদী শিক্ষা দিলেন তা উল্লেখ করতে গিয়ে #উপনিষদ্ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। উপনিষদ্ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল #নিঃশেষ করা , যা অজ্ঞানতাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। উপনিষদ্ আমাদের আত্মজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রদান করেন। কিন্তু বিরোচন তো প্রজাপতির সব কথা শোনেননি, শুনলেও বুঝতে পারেন নি। কোনো প্রশ্ন করেন নি। নিজের মতো যা বুঝেছিলেন তা ভুল। দেহই আত্মা এ ব্যতীত সূক্ষ্ম অর্থ আর তিনি খুঁজে পান নি।
তারপর কি হল? বিরোচন তো সংযম, ধৈর্য্য, প্রশ্ন সব ত্যাগ করলেন। ইন্দ্র কি করলেন? ইন্দ্রও কি বিরোচনের মতোই ভুল করলেন ?
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী