ক’দিন আগে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম কলকাতা প্রেস ক্লাবের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে। ওই সফরে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলাম আমন্ত্রিত হয়ে। সেখানে বেশ কিছু সংগঠনের প্রতিনিধির সমাবেশে কেউ কেউ প্রকাশ্যে অভিযোগ তুললেন সংখ্যালঘুদের জমি এবং দেবোত্তর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়ে। সেটা নিয়ে খবরও করেছিলাম। এবার চোখে পড়ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক সোনম সাহার এই লেখা। সামাজিক মাধ্যমে এটি ভাগ করেছেন মানবাধিকার কর্মী প্রিয়া সাহা।
প্রিয়া লিখেছেন, নীচে যে ছবিটি দেখছেন এটি একটি মন্দির। মন্দিরটির অবস্থান ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার কুঠিরহাটে। অত্র এলাকায় প্রাচিন মন্দিরের মধ্যে এটিও একটি। জায়গার ইতিহাস খুঁজলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। প্রায় সাড়ে সাত একর সম্পত্তি ছিলো মন্দিরটির নামে। পেটে গেছে সরকারের ব্যক্তির। এখন আছে ৬৬ শতক। কি অবাক হয়েছেন? হওয়ারই কথা। এই দেশের হিন্দুরা আছে ১২ মাসে তের পুজা পার্বন নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু পিছনে যে তাদের সম্পত্তি গ্রাস হয়ে যাচ্ছে সে দিকে কোনো নজর নেই। এই দেশের হিন্দুরা ধর্ম পালন করে তবে তা পাছা খোলা রেখে।
মন্দিরটিতে এক সময় নিত্যপুজো হতো এখন মাছ বাজার দিয়ে মন্দিরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। নিত্যপুজোও আর হয় না পূজারীরাও আর আসে না। একসময় এই অংশটুকু হয়তো চলে যাবে কোনো ভুমি দস্যুর পেটে।
————— ———–
তেমনি ঢাকার প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত একটি মন্দিরে কপি করে দিলাম।
অনুরোধ রইলো হিন্দুরা পড়ে নিয়েন!
বেইলী রোড-সিদ্ধেশ্বরী অঞ্চলে একটা মন্দির আছে। আসলে এলাকার নামটাই এই মন্দিরের দেবীর নামে; শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। ছোট একটা মন্দির। মন্দিরের পুরাতন দলিল দস্তাবেজে দেখা যায় এই মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তির সীমানা ছিল উত্তরে মৌচাক, আনারকলি মার্কেট, সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল আর তার খেলার মাঠ পর্যন্ত আর দক্ষিনে বাগান, পুকুর, ছত্র, সব নিয়ে বেইলী রোডের সীমানা পর্যন্ত। ১৯৪৬ থেকে কমতে কমতে এই সীমানা এখন শুধুই মূল মন্দিরটা ঘিরে একটা নাট মন্দির নিয়ে সীমাবদ্ধ। না, কেন বা কী প্রক্রিয়ায় মন্দিরের সম্পত্তি বেহাত হলো তা দিয়ে অভিযোগ, অনুযোগ বা আফসোস করছি না। শুধু একটু ইতিহাস বলার লোভ সামলাতে পারলাম না বলে বলছিলাম।
মন্দিরটাতে প্রতিবছর দুর্গা পূজা হয়। দেশের আর সব মন্দিরের মতই পুলিশ পাহারায়। দুর্গা পূজায় গুনে গেঁথে পুলিশ, র্যাফ, আনসার মিলে মোট ৩০ জনের একটা দল থাকে প্রহরায়। কালী পূজায় থাকে ১০ জনের মত। স্বরস্বতী পূজাতেও তেমনই। জন্মাষ্টমী, লক্ষ্মী পূজা, কার্তিক পূজা, উৎসব এইসব সময়ে রমনা থানায় আবেদন করলে চারজন বা দুইজন পুলিশ দেওয়া হয় প্রহরার জন্য। আজ এধরনের কোনো পার্বন নেই। কিন্তু মন্দিরে পুলিশের সংখ্যা ২০ জন বা তার বেশিও হতে পারে। বাইরে, ভেতরে, সীমানায়। কাল রাত থেকে এরা পালাবদল করে মন্দির পাহারা দিচ্ছে। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ঐতিহ্যগত ভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি। তারা অনেকেই আজ মন্দিরে গিয়েছেন আসন্ন পৌষ সংক্রান্তির আয়োজন করতে। পিঠে-পুলির পার্বন, ফানুশ ওড়ানোর উৎসব, এইসব। কিন্তু সবাইকেই ফিরে আসতে হচ্ছে। অনেকেই হয় সেবাইত/পুরোহিত বা খোদ পুলিশ কন্সটেবলকে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? কন্সটেবলদের কাছ থেকে উত্তর মিলছে, ‘গতকাল কোরান পুড়াইছে বাড্ডায়, তাই আপনারা যাতে সেই মাইর না খান সেইজন্য ডিউটি ফালাইছে এইখানে।’ সেবাইতদের কাছে উত্তর মিলছে না পুলিশ পাহারার, শুধু বলছে ‘এবার পৌষ সংক্রান্তির আয়োজন না-ও হতে পারে! পরে খোঁজ নিতে আসুন একবার!’
মূল মন্দিরেও যাওয়া যাচ্ছে না। লোহার গ্রিল দেয়া গেটে তালা দেয়া, প্রতিমা ভাঙ্গচুর ঠেকাতে। একজন ফিরে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। কী দুঃখে সে প্রশ্ন অবান্তর। যার চোখ ভাসে আর যার চোখ পোড়ে দুইজনে প্রশ্ন না করেই কারণ টা জানে।
বাংলাদেশী হিন্দু এই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণী যার জন্য কোনো টিভি চ্যানেলে (ডিসকভারী চ্যানেলেও না) স্কুপ নিউজ হবে না, বাইট মিলবে না, পত্রিকায় একটা কলাম জুটবে না, কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না, কেউ বলবেনা অন্যায় হচ্ছে। এ বলবে ‘তুমি ওর ভোট ব্যাংক’, ও বলবে ‘তুমি তো আমার কেনা গোলাম’।
এরা ন্যায় চাইলে বলবে ‘সাহস বাড়ছে’, মিনমিন করে কাউকে সাহায্যে ডাকলে উপদেশ আসবে; “আপন মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়” (মাই ফুট!)
এরা যে কোনো মুহূর্তে পুরো সম্প্রদায়ের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেটা হতে পারে যে ফেসবুকে তার অ্যাকাউন্ট নেই সেখান থেকে, সেটা হতে পারে যে কথা সে বলেনি সেখান থেকে, সেটা হতে পারে যে দেশে সে থাকেনি সেখান থেকে, সেটা হতে পারে যে শুধু সে এদেশে থাকার সাহস করে বলে।
এরা নিজেদের বঞ্চনার কথা লিখলে অবধারিত ভাবে গুজরাট, ফ্রিজে গরুর মাংস, ২০০১ এর পরিসংখ্যান ইত্যাদি জানার পর জানবে ‘তার তুলনায় তোমাদেরকে ভালই রাখছি!’ বিষাদ জানালে বলবে, ‘খাও আমাগো আর মন থাহে হেই পারে?’ তর্ক করতে গেলে শুনবে ‘বাপের দেশে পাঠাই দিমু!’ যুক্তি দিতে গিলে শুনবে ‘মালাউনের এত কথা কিসের’ আর প্রতিবাদ করলে বলবে, ‘এই ডান্ডিরা সাম্প্রদায়িক’। (আহা, যদি আর বাকি গুলোও বলতে পারতাম।)
আমার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় ভারতবর্ষের ইতিহাস। এটা পড়তে গেলে ভারতীয় দর্শন বুঝতে হয় আর তার সূত্র ধরে ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের বিকাশ, বিবর্তন বা উত্থানের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা একেবারেই এড়ানো যায় না। এবং আমি আমার ক্লাসে একটু ভয়ে ভয়ে, বাচ্চা গুলোর বিরক্ত হয়ে থাকা মুখগুলো দেখেও না দেখার মত করে থেকে যেখানে যেখানে সংযোগ করা সম্ভব সেখানে এই বিষয় গুলো খুব অল্প করে বুঝাবার চেষ্টা করি এবং প্রতিবার বাড়ি এসে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি পেরেছি? উত্তর পাই, না পারিনি। আমি আসলে একটা একরোখা জেদ নিয়ে চেষ্টা করে যাই। আমি জানি যে আমি কোনোদিন পারবো না বুঝাতে। তবু সিসিফাসের মত চেষ্টা করে যাই। এখন থেকে আর করবো না। কোনো মানে হয় না সিসিফাস হয়ে বাঁচার।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের আকাশ লুকানো আঙ্গিনায় সন্ধ্যা নামার মুখে একটা মেয়ে গ্রিল এর ওপারে কালী প্রতিমার সামনে হাতজোড় করলো। চেয়ার পেতে বসে থাকা এক কনস্টেবল আরেকজনকে ডেকে বললো ‘দ্যাখ! দ্যাখ! নমো করে! হিহি!’
মেয়েটা করজোড়ে রাখা হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করলো।
© অধ্যাপক সোনম সাহা
#SaveBangladeshiHindus
#saveworldhindu
#SaveHinduTemples