নেমন্তন্ন ছিল দুপুরে, কথাও দিয়েছিলেন যাবেন। কিন্তু একটি বিশেষ কাজে তাঁকে হঠাৎ যেতে হল বজবজে। কাজ শেষ হতে দুপুর শেষে সময় গড়াল সন্ধ্যায়। তখনও তিনি রয়েছেন বজবজে, নিমন্ত্রণ কলকাতাতেই। দূরত্ব মোটামুটি পঁচিশ কিলোমিটার। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই হবে, তাই যখন নিমন্ত্রণ বাড়িতে পৌঁছলেন, তখন রাতও গভীর হয়ে গেছে, বাজে একটা কি দুটো। দুই সঙ্গী সহ তিনি যখন সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন তখন চতুর্দিক শুনশান, বাড়ির সদরদড়জা বন্ধ, সব জানলাগুলোও বন্ধ। কি আর করা যায়, এতদুর এসে তো আর ফিরে যাওয়া যায় না.. তাই তিনি দড়জায় কড়া নাড়তে লাগলেন। কিছু পরে বাড়ির ভেতর থেকে সাড়া এলো – ‘এত রাতে কে কড়া নাড়ে ? ‘ তিনি উত্তর দিলেন, “আমি সুভাষচন্দ্র.. আপনারা নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কথা দিয়েছিলাম আসবো.. তাই এতো রাত হয়ে গেলেও এসেছি।” মুহুর্তে বাড়ির ভেতরে চাপা শশব্যাস্ত শুরু হয়ে গেল। সদরদরজা খুলে গেল। এতো রাত্রে ! গৃহকর্তা নিজেই শঙ্কোচে পড়ে গেছেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে থাকা সত্যরঞ্জন বক্সী ও কিরণ শংকর রায়’ও খুব অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে.. কিন্তু সুভাষচন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, “তাতে কি হয়েছে ! ব্যস্ত হবেন না.. মাংস আর ঘি-ময়দা তো আছে.. লুচি ভেজে দিন, আমরা মাংস দিয়ে জমিয়ে খেয়ে নেব।”
স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু নিজ মুখে খেতে চাইছেন ! একথা শুনে উৎসব শেষের বাড়িতে নতুনভাবে রান্নার তোড়জোড়ে আবার উৎসব শুরু হয়ে গেল। শেষমেশ খাওয়াদাওয়া যখন শেষ হল, তখন প্রায় ভোর হয় হয়। এরপর বাড়ির সকলের সাথে খোশ-গল্প জুড়ে দিলেন সুভাষচন্দ্র। গল্পে আড্ডায় কারুর হুঁশ নেই.. ওঠার আর নাম নেই। এসব দেখে সত্যরঞ্জন বক্সী ও কিরণ শংকর রায় তাড়া দিতে লাগলেন.. ‘ভোর হয়ে গেছে.. এবার বাড়ি ফেরা যাক’ .. এবার আবার সুভাষচন্দ্র মজা করে বললেন, “আরে সত্যরঞ্জন, কিরণশংকর.. এক্ষুনি ওঠা কেন! আর একটু বসে গেলেই তো বেশ হয়.. একেবারে ভোরের চা-টা খেয়েই না হয় এখান থেকে যাওয়া যাবে।”
সত্যি সত্যিই সকালের চা খেয়ে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করেই সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে নিমন্ত্রন বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। এই হচ্ছে মানুষ সুভাষচন্দ্র বসু, যে দিকটা প্রায় আড়াল থেকে যায়। এমনই তাঁর ব্যক্তি আকর্ষণ যে তাঁকে দেখতে পেয়ে একটা ছুটন্ত ট্রেন থমকে গেছিল.. ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে ছুটে এসেছিল তাঁকে সামনে থেকে এক পলক দেখতে .. সে ঘটনাও তুলে ধরা হবে এই প্রবন্ধে ..
রাজনীতির বাইরে
ঘরের-ছেলে মানুষ সুভাষচন্দ্র বসু
ঘটনা ও রটনা
“সুভাষ হাসলে এত ভালো দেখায় – এত ভালো আর কিছুতে নয় .. সুভাষের স্বভাবমাধুয্য আমায় মুগ্ধ করেছিল। একবার যে তার সাথে কথা বলেছে, তার তাকে মনে ধরবেই – সুভাষের গুণই ছিল এই”, কথাগুলি বলেছেন দিলীপকুমার রায়, সুভাষচন্দ্র বসুর বাল্যবন্ধু। ছোট থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন স্বভাব গাম্ভীর্য, তবু একবার হাসতে শুরু করলে পেটে খিল না ধরা অবধি তাঁর হাসি থামত না। তিনি দরকার মত গম্ভীর থাকতেন, আবার দরকারে প্রাণ খুলে হাসতেনও। তবে কখনই তিনি খুব বেশি হাত-পা ছুঁড়ে কথা বলা পছন্দ করতেন না। কলকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় সুভাষচন্দ্র বসু প্রায়ই দক্ষিণেশ্বর বা বেলুড়ে যেতেন, একথা আমরা প্রায় সকলেই জানি। দক্ষিণেশ্বরে কখনো কখনো পঞ্চবটীর তলায় বসে কিশোর সুভাষচন্দ্র ধ্যান করতেন, একথাও আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে এসে গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে তিনি একদিন প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন – একথা আমরা অনেকেই জানি না। সেসময় প্রায় ডুবে যাওয়া কিশোর ছাত্র সুভাষচন্দ্র’কে বাঁচিয়ে ছিলেন প্রফুল্ল ঘোষ নামে ঢাকা থেকে কলকাতায় পড়তে আসা বিপ্লবী মনোভাবী এক ছাত্র। ঘটনাটি নিজের চোখে দেখা সুভাষ-বন্ধু হেমন্ত সরকার সেই দিনের কথা জানিয়ে লিখেছেন – “সুভাষ সাঁতার জানত না। সেদিনের পরে যখন কৃষ্ণনগরে আসত, তখন জলঙ্গী নদীতে আমার কাছে একটু একটু সাঁতার দেওয়া শিখেছিল।” সাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী, সুভাষ অনুরাগী, সুভাষ-জীবনের বহু ঘটনার সাক্ষী সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “সুভাষবাবু’কে ষোলো আনার উপর আঠারো আনা ভদ্রলোক বললেও সবটুকু বলা হয় না। আদর্শ বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে তিনি যেমন সকলের কাছে শ্রদ্ধেও, তেমন বাঙালীপনার ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত।” বেশ কিছু দিন খুব কাছে থেকে সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখেছেন লেখক ও সাংবাদিক সরোজকুমার রায়চৌধুরী, তাঁর মতে, “বিপদকে নিজে ডেকে আনতেন সুভাষবাবু। এই কাজেই তিনি আরাম পেতেন বেশি। শান্ত জীবনযাপনে থাকতে তিনি বেশিদিন পছন্দ করতেন না। সাধারণত যাদের সাহসী বা দুঃসাহসী বলা হয়, সুভাষচন্দ্র তাদের থেকেও অনেক অনেক বেশি। ভয় জিনিসটাই তাঁর নেই। এমন মানুষ দেখা যায় না।” ‘ঘরের-ছেলে মানুষ সুভাষচন্দ্র বসু’কে খুঁজতে গিয়ে আমার কেবলই মনে হচ্ছে যে, আজও তাঁর সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানি না। তাঁকে সম্পূর্ণ জেনে ওঠা বোধহয় এক-জীবনে কখনই সম্ভব নয়। আমার লেখা অপূর্ণ। এই ‘বিরাট ব্যক্তি’র যে কোনও কথা কারুর পক্ষেই সম্পূর্ণ লেখা সম্ভব নয়। তাই সেই চেষ্টাও আমি করিনি। যোগ্যতারও অভাব। তবু আমি রাজনীতির বাইরে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি দিক আঁকতে চেয়েছি।
প্রথম পর্ব –
মাবাবাজন্মরাশিচক্রওদিদিদাদাভাইবোন
সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছেন – “আমার বাবা জানকীনাথ বসু মাহীনগরের বসু বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মা প্রভাবতী দেবী উত্তর কলকাতার হাটখোলা দত্ত পরিবারের কন্যা। আমার বাবা নবম দশকে উড়িষ্যায় চলে যান এবং ওকালতি সূত্রে কটকে বসবাস করতে থাকেন। আমি আমার বাবা-মা’র নবম-সন্তান ষষ্ঠ-পুত্র।” সুভাষচন্দ্র বসুর পূর্বপুরুষের ভিটে বাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কোদালিয়াতে। জানকীনাথ বসু সাথে প্রভাবতীদেবীর বিয়ে হয় ১৮৮০ সালে। কাজের সূত্রে ১৮৮৫ সাল থেকে কটকে। ১৯১২ সালে জানকীনাথ বসু বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন ও ‘রায়বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন; ১৯১৭ সালে সরকারি উকিলের পদে ইস্তফা দেন; ১৯৩০ সালে সরকারি দমননীতির প্রতিবাদ করে রায়বাহাদুর উপাধি বর্জন করেন।
হেমন্তকুমার সরকারের লেখা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে – সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম বাংলা ১১ই মাঘ, সন ১৩০৩, শনিবার, সময় আন্দাজ বেলা ১২-১৫ মিনিট। সময়টা আন্দাজ করা হয়েছিল একারণে যে জন্মের একেবারে সঠিক সময় সঠিকভাবে বাড়ির কেউই বলতে পারেননি। আরো যা লেখা আছে তা হল – শকাব্দ ১৮১৮। ইংরেজি ১৮৯৭ সাল, ২৩শে জানুয়ারি। কন্যারাশি, নক্ষত্র উত্তরফাল্গুনী, নরগণ, বৈশ্যবর্ণ। সুভাষ-বন্ধু হেমন্তকুমারের লেখায় লগ্নের কোনো উল্লেখ নেই, যদিও সুভাষচন্দ্র বসুর লগ্ন – বৃষ। জন্মকালীন লগ্নে মঙ্গলের অবস্থান। এইসব কথায় আবার কেউ ‘কুসংস্কার’ দেখতে যাবেন না, ব্যক্তিকে জানতে এই প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিক।
বাবা জানকীনাথ বসু (১৮৬০-১৯৩৪) ও মা প্রভাবতীদেবীর (১৮৬৯-১৯৪৩) চোদ্দ’টি পুত্র ও কন্যা সন্তান – প্রমীলা বসু মিত্র, সরলা বসু দে, সতীশচন্দ্র বসু (ব্যারিষ্টার), শরৎচন্দ্র বসু (ব্যারিষ্টার), সুরেশচন্দ্র বসু (ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট), সুধীরচন্দ্র বসু (টাটার কয়লা খনির অফিসার), সুনীলচন্দ্র বসু (ডাক্তার, হার্ট-স্পেশালিস্ট), তরুবালা বসু রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, মলিনা বসু দত্ত, প্রতিভা বসু মিত্র, কনকলতা বসু মিত্র, শৈলেশচন্দ্র বসু (টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার), সন্তোষচন্দ্র বসু (১৯-বছর বয়সে মৃত্যু হয়)।
সুভাষচন্দ্র বসুর ডাক নাম ‘সুবি’। বাবা ও মা’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মানসিকতা সুভাষচন্দ্রের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীকালে তিনি বলেছেন, পারিবারিক পরিবেশের জন্য তাঁর মধ্যে কখনও স্বার্থপরতা বা লোভ জন্মায়নি। বাবা ও মা অসন্তুষ্ট হবেন এমন কাজ করা তিনি অনুচিত মনে করতেন। তবে কিশোর সুভাষচন্দ্রের মধ্যে এক বিদ্রোহী মন তৈরি হয়েছিল – নিজের আদর্শ, মানব সেবার ব্রত কার্যকর করতে তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন। এজন্য অনেক সময় বাবা ও মা’র ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে যেতে হয়েছে। ছাত্র-জীবনেই তাঁর মনের মধ্যে নিজের মুক্তিসাধন, পার্থিব আকাঙ্খামুক্তি ও মানবসেবার আগুন জ্বলা শুরু হয়ে যায় – বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে গুরু’র খোঁজে তাঁর গৃতহ্যাগ তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ।
????
ছাত্রসুভাষচন্দ্রবসু
‘ছাত্র জীবন’ মানুষ সুভাষচন্দ্র বসুর গঠনের প্রাথমিক এক অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভবিষ্যতের নির্ভীক দেশনেতা ও নেতাজী হওয়ার বীজ ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর মধ্যে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। হাতেখড়ির পর থেকে ধাপে ধাপে সুভাষচন্দ্র বসুর জ্ঞান ও মেধা ঠিক কতোটা উচ্চতায় পৌঁছেছিল তা কথায় বর্ণনা করা কারুর পক্ষে একদমই সম্ভব নয়। পাঁচ-বছর বয়সে সুভাষচন্দ্র বসু ভর্তি হন কটকের প্রোটেষ্টান্ট ইউরোপীয় স্কুলে। ছাত্র অবস্থায় খুব বেশি সময় কখনই তিনি বইতে মুখ গুঁজে থাকেননি। অথচ খুব কম সময় পাঠ্যবই পড়ে অনায়াসে একটি বাদে বাকি সব পরীক্ষাতেই এক-থেকে-চারের মধ্যে থেকেছেন। ছাত্র অবস্থায় প্রথমে ইংরেজি-মাধ্যমে পড়ার জন্য সংস্কৃত কিছুই জানতেন না – তাও মানা গেল, কিন্তু বাঙালির ঘরের ছেলে হয়ে তিনি বাংলা’ও ঠিকমতো লিখতে পারতেন না ! এই অবস্থা থেকে মাত্র এক-বছরে কোন মন্ত্রবলে তিনি সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন, তা কেবল ঈশ্বরই বলতে পারবেন। শুধু পড়াশোনায় খুব ভালো বা আশ্চর্য মেধা তাই নয়, ছাত্র সুভাষ’কে অন্য সকল সহপাঠীরা নিজেদের অজান্তেই অনুসরণ করত। সহপাঠীরা সুভাষ’কে তাদের ‘নেতা’ মানত, একথা বলা ঠিক নয়, কারণ সেই ভাবনার বয়স সেই বয়সে আসে না। আসলে সকলের ‘অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন ছাত্র সুভাষ, তাই এক গভীর ভালোবাসা থেকে সহপাঠীরা তাঁর সকল কথা মেনে চলত। সেই মেনে চলা থেকেই অনুসরণ। স্কুল শেষে বন্ধু সুভাষের কথাতেই তাঁর সহপাঠীরা নদীর পাড়ে প্যারেড অনুশীলন করত। নিজের অজান্তে ছাত্র অবস্থায় সুভাষচন্দ্রের প্রথম বৈপ্লবিক প্রতিবাদ ১১ই আগস্ট, ১৯১১ সালে .. ব্রিটিশ আমলে একটি তেরো/চোদ্দ বছরের ছেলে স্কুলের প্রায় সকল ছাত্রদের নিয়ে বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে! সকল ছাত্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করছে .. এক শান্ত সুন্দর তেজ.. যে তেজের সামনে সম্মোহন তৈরি হবেই।
১৯০৯ সালে কটকের কাঠাজুড়ি নদীর তীরে বাংলা মাধ্যম র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেনীমাধব দাস। যাঁর ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশচেতনা বালক সুভাষকে প্রথম প্রভাবিত করে। এই সময়ের পর থেকে বাংলার লোকসাহিত্য অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর, ইতিহাসের প্রতি তৈরি হয় গভীর ভালোবাসা। শিক্ষক বেনীমাধব দাস সুভাষচন্দ্রের মানসিক দৃঢ়তা গঠনে এক অভুতপূর্ব ভূমিকা পালন করেন। সুভাষচন্দ্র কখনও তাঁর ছেলেবেলার এই শিক্ষককে ভুলতে পারেননি।
ছাত্র অবস্থাতেই সুভাষচন্দ্র বসু দু’বার সন্ন্যাসী-জীবনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯১৩ সালে শান্তিপুরে এক ভাড়া বাড়িতে কিছুকাল সন্ন্যাসীদের মতো জীবনযাপন করেছিলেন। ১৯১৪ সালে এবার ঘর ছেড়েছিলেন ‘গুরু’র খোঁজে ভারত দর্শনে, বন্ধু হেমন্ত সরকারের সাথে। অখণ্ড ভারতবর্ষের অশেষ সৌভাগ্য যে, ব্যক্তিগত মুক্তির এই সন্ধান সুভাষচন্দ্র বসু’কে শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাস-জীবনে নিয়ে যায়নি, তিনি বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। ফিরে এসেছিলেন এক অগাধ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রায় দু’মাস ব্যাপী ভারত-ভ্রমণে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, মিথ্যে জাতপাতের ভয়াবহ আচরণ ও অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
ছাত্র সুভাষচন্দ্রের একটি বিশেষ ঘটনা-অধ্যায় ইংরেজ শিক্ষক অধ্যাপক ওটেন পর্ব। প্রেসিডেন্সী কলেজের ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন ভারতীয় ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করতেন, গালাগালও দিতেন। ফলে সময় ও সুযোগ পেয়ে একদল ছাত্র নিজেদের মুখ বাঁচিয়ে অধ্যাপক ওটেন’কে শারীরিকভাবে আঘাত করেন (১৯১৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি)। অথচ আশ্চর্য এই যে, অধ্যাপক ওটেন ও কলেজের প্রিন্সিপাল সহ কলেজ পরিচালন কমিটি ছাত্রদের অলিখিত নেতা সুভাষচন্দ্র’কেই ঘটনার জন্য দায়ী করে জবাবদিহি করে। শেষপর্যন্ত অন্যের দোষে দোষী সুভাষচন্দ্র বসু কলেজ থেকে বহিষ্কার হয়ে পেলেন প্রকৃত নেতৃত্বের সাধ। আরো কিছু ছাত্রদের – অনঙ্গ দাম, বিপিন/সতীশচন্দ্র দে, ভোলানাথ রায়কেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। যে সব ছাত্ররা সুভাষচন্দ্রের সাথে ছিল তাদের পুলিশ নজর রাখছে বা থানায় ডেকে পাঠাচ্ছে দেখে সুভাষচন্দ্রের দাদারা তাঁকে কলকাতা থেকে কটকে পাঠিয়ে দেন। এক-বছর নষ্ট হলেও গতিপথ রোধ করা গেল না। ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চে পড়ার সময় বেলঘরিয়াতে কলকাতা ইউনিভার্সিটির ইনফেনট্রি ক্যাম্পে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত আঞ্চলিক সামরিক শিক্ষা অনুশীলনে সুভাষচন্দ্র বসু মিলিটারি ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, বাবা জানকীনাথ বসুর ইচ্ছায় গেলেন ইংল্যান্ড, আইসিএস পড়তে। সেখানে হাতে ছিল মাত্র আট-মাস, তাও বোধহয় বেশিই হয়ে গেল। সবমিলিয়ে চতুর্থস্থান পেলেন, ইংরেজদের দেশে ইংরেজি কম্পোজিসনে প্রথম হলেন। পরীক্ষা দেবার আগেই চাকরি থেকে ইস্তফা দেবার পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মনোবিজ্ঞান ও নীতিবিজ্ঞানে ট্রাইপোজ সহ বি.এ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তবে এখানে সবচেয়ে আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, সুভাষচন্দ্রের আইসিএস পদত্যাগের খবরে বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। অন্য সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে, সুভাষচন্দ্র এই অবস্থা অনুমান করেছিলেন যে পদত্যাগের পরে বোধহয় বাড়ি থেকে আর টাকা আসবে না। যাই হোক সত্যি এই যে শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র’কে বন্ধুদের থেকে টাকা ধার করেই ইংল্যান্ডে থাকার শেষ কিছু মাস খরচ চালাতে হয়েছিল।
শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান ও মেধা – জ্ঞান ও মেধা কোনো বিশেষ একটি বা দু’টি ক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে; আর শিক্ষা-দীক্ষা মানে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, তার সাথে আচার আচরণ, চিন্তা ভাবনা, দয়া দাক্ষিণ্য, সেবক মন ও কর্ম, আগাম পরিকল্পনার ক্ষমতা, স্বার্থ ও ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতা, আশ্চর্য সাহস, জাত-পাত হীন ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গঠনের সত্যিকারের ইচ্ছে ও চেষ্টা, বিশুদ্ধ খাঁটি স্বদেশপ্রেম এবং অবশ্যই চরিত্র – এইসব যদি মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে সুভাষচন্দ্র বসুর বহুমুখী কর্মক্ষেত্রের সমসাময়িক সারা দেশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি তাঁর সাথে একাসনে বসতে পারেন।
শ্রীরামকৃষ্ণস্বামীবিবেকানন্দপ্রভাবেসুভাষচন্দ্রবসু
‘আজ তিনি জীবিত থাকলে আমি তাঁর চরণেই আশ্রয় নিতাম’ – একথা বলেছেন সুভাষচন্দ্র বসু। অর্থাৎ সময় ও সুযোগ পেলে ভাবগুরু স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি ভাবশিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতেন সেই অন্তরের ভাবনা এখানে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। একদিন সুভাষচন্দ্র নিকট আত্মীয় সুহৃৎচন্দ্র মিত্রের বাড়িতে গিয়ে হঠাৎই সন্ধান পেলেন স্বামী বিবেকানন্দের বইয়ের। অন্য তথ্যে পাওয়া যায়, কটকের র্যাভেনশ স্কুলে ও কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় বেলুড় মঠের শঙ্কর মহারাজ’কে জানিয়েছিলেন, কটকের প্যারীমোহন অ্যাকাডেমির শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র সেন সেইসময় নবম-শ্রেণীতে পড়া কিশোর সুভাষচন্দ্রের হাতে প্রথম তুলে দিয়েছিলেন ‘স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বই’। সুভাষচন্দ্রের নিজের কথায় – “.. বয়স তখন সবে মাত্র পনেরো। আমার জীবনে এক প্রচণ্ড বিপ্লব ঘটে গেল। বিবেকানন্দ আমার জীবনে প্রবেশ করলেন।” আর সুভাষচন্দ্র তাঁর মা প্রভাবতীদেবীর মুখ থেকে ‘কথামৃত’ শুনতে শুরু করেছিলেন বালক বয়স থেকেই। বালক বয়সে শুনেছেন, কৈশোরে নিজে পড়া শুরু করলেন, যা থেকে প্রথমে তৈরি হল জাতপাত হীন ‘সেবা’, তারপরে যোগ হল ‘ত্যাগ’, পরে পরিণত সুভাষচন্দ্র বসুর মনে গঠন হল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সর্ব-ধর্ম-সমন্বয়। পরিণত বয়সে সুভাষচন্দ্র বসু বলেছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আমি যে কত ঋণী, তা ভাষায় কি করে প্রকাশ করব ? তাঁদের পূণ্য প্রভাবে আমার জীবনের প্রথম সঠিক পথের দেখা পাই। ভগিনী নিবেদিতার মতো আমিও মনে করি যে, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ – এক ব্যক্তির অখণ্ড দুই রূপ। আজ যদি স্বামীজী জীবিত থাকতেন, নিশ্চয়ই তিনি আমার গুরু হতেন – তাঁকে গুরু পদে আমি বরণ করতাম। আমি যতদিন জীবিত থাকব, ততদিন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের একান্ত অনুগত ও ভক্ত থাকব।”
সুভাষচন্দ্রের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন মহাপ্রয়াণ ঘটে স্বামী বিবেকানন্দের। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘােষকে সুভাষচন্দ্র জানিয়েছিলেন, ‘ভারতবর্ষকে আমি ভালবেসেছি বিবেকানন্দ পড়ে। আর বিবেকানন্দকে আমি চিনেছি নিবেদিতার লেখায়।’ কিভাবে মানুষ কাম-বাসনার উপরে নিজের সংযম-শক্তিকে জয়ী করতে পারে, কিভাবে নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগাতে হয়, কিভাবে নিজেকে হীন-দুর্বল ভাবনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় – এইসব কিভাবে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বই থেকে নির্দেশ পাওয়া যাবে, তা সুভাষচন্দ্র বসু চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন তাঁর এক প্রিয় সহকর্মী হরিচরণ বাগচীকে। নিজেকে নিঃস্ব করে স্বামীজীর ‘ত্যাগ ও সেবা’ সুভাষচন্দ্র বসুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র বসু একই জীবনধর্মের দু’টি রূপ মাত্র। এক পর্ব আগে জন্মালে নেতাজী হতেন স্বামীজী এবং পরের পর্বে আর্বিভূত হলে বিবেকানন্দ হতেন সুভাষচন্দ্র।
বিশিষ্টগণদেরপ্রভাবেসুভাষচন্দ্র_বসু
কলেজ জীবনের সূচনায় সুভাষচন্দ্র বসু যাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এঁদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সুভাষচন্দ্র তাঁর রাজনৈতিক গুরু রূপে বরণ করেছেন, যদিও দেশবন্ধুর সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ কর্মযোগ ছিল মাত্র তিন-বছরের, তবু সুভাষচন্দ্রের মনে ও কাজে দেশবন্ধুর চিরস্থায়ী প্রভাব থেকে গেছে। দেশবন্ধু ছিলেন সুভাষচন্দ্রের ‘রোল মডেল’। তরুণ ছাত্র সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রীঅরবিন্দের স্থায়ী প্রভাব কতটা ছিল তা নিয়ে দ্বন্দ্ব সুভাষচন্দ্রের মনের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। শ্রীঅরবিন্দের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট থাকলেও আকর্ষণের অন্যতম কারণ ছিল অরবিন্দ-শিষ্য দীলিপ রায়ের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব, উভয়ের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর খুব স্নেহের সম্পর্ক ছিল। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও জানকীনাথ বসু সহপাঠী ছিলেন। আচার্য রায়ের মহান ব্যক্তিত্ব, তাঁর সাদামাটা জীবনযাত্রা, কর্ম-উদ্যোগ, মানব-প্রেম ও স্বদেশ-প্রেম ছাত্র সুভাষচন্দ্র’কে প্রবল আকর্ষণ করে। পরবর্তীকালে ১৯২২ সালে দেশের বন্যা-ত্রাণ সেবায় তাঁদের যে যুগলবন্দীর শুরু তার সম্পর্ক ও প্রভাব সুভাষচন্দ্রের জীবনে সবসময় ছিল। এই বন্যা-ত্রাণের তহবিলের খরচ-খরচা নিয়ে আচার্যের সাথে পুত্রসম সুভাষচন্দ্রের তীব্র মতবিরোধ হয়েছিল। যদিও সেই বিরোধ কেউই খুব বেশিদিন বয়ে নিয়ে চলেননি। কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ সুভাষচন্দ্রের ছাত্র-জীবনেই শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শ, সাহিত্য ও গান সুভাষচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছিল। ইংল্যান্ড থেকে আইসিএস চাকরিতে পদত্যাগ করার পরে দেশে ফেরার সময়ে তরুণ সুভাষচন্দ্রের সাথে একই জাহাজে ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর সাথে সুভাষচন্দ্র বসুর পারস্পরিক সম্পর্ক তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করার আগের সময় থেকে গৃহ-ও-দেশ-ত্যাগের আগের সময় পর্যন্ত এক বিস্তৃত অতি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান অধ্যায়। যে অধ্যায়ে আছে সুভাষচন্দ্রের প্রতি কবিগুরুর উপদেশ; তীব্র সমালোচনা ও টিপ্পনি; অভুতপূর্ব সমর্থন, আস্থা ও ভরসা, ভালোবাসা ও আশির্বাদ। ছাত্রদের কাছে আদর্শ পুরুষ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্ভাবনী ক্ষমতা, স্বদেশ প্রীতি ও তাঁর বক্তব্য সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রবল ভাবে টানত। বিজ্ঞানী বসুকে সুভাষচন্দ্র কী অসীম শ্রদ্ধা করতেন, তার পরিচয় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা জানব ..
বিজ্ঞানীজগদীশচন্দ্রবসুএকসংবর্ধনাওসুভাষচন্দ্রবসুরমানসিক_গঠন
১৯১৫, ৮ ডিসেম্বর কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক সভার আয়োজন করা হয়, সেখানে বিজ্ঞানী বসুর বক্তৃতা দেওয়ার কথাও প্রচারিত হয়। ছাত্র সুভাষচন্দ্র আশা, উত্তেজনা, গভীর আগ্রহ ও উৎসাহে সভায় গেলেন শুধুমাত্র জগদীশচন্দ্র বসুর মুখে মূল্যবান কিছু কথা শুনতে। কিন্তু সভার শুরু হয় ইংরেজি থিয়েটার ও ইংরেজি গান দিয়ে। সভায় যুবকদের হাসাহাসি ও উচ্ছৃঙ্খলতায় অতিষ্ঠ সুভাষচন্দ্র একবার ভাবলেন সভা ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন, কিন্তু বিজ্ঞানী বসুর বক্তব্য শোনার ইচ্ছায় তা পারলেন না। একবার ঘুমানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু অত্যধিক চিৎকারে তাও পারলেন না। কিন্তু শেষপর্যন্ত সভায় জগদীশচন্দ্র বসু কোনও বক্তৃতা দেননি, কারণ সেই পরিস্থিতি ও পরিবেশ সভায় ছিল না। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসু ধিক্কার জানিয়ে লিখেছিলেন, “থিয়েটার দিয়ে অভিনন্দন ! হায় ভারত হায় বাঙালি ! তোমার কি এতদূর অধঃপতন হয়েছ ? .. যতদিন না আমরা মহাপুরুষদের উপযুক্ত সম্মান দিতে শিখছি, ততদিন আমাদের কিছু হবে না। .. জানি না বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এই অভ্যর্থনা কীভাবে নিয়েছিলেন ! স্বদেশভক্ত বিজ্ঞানী বসু দেশের দান দুই হাত পেতে অবশ্যই নেবেন – ছাইভস্ম দিক আর ফুলচন্দনই দিক। কিন্তু এই অভ্যর্থনাতে তিনি যে হৃদয়ে গভীর বেদনা পেয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। “
এই ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ায় আঠারো পেরিয়ে ঊনিশ-বছরের দিকে এগিয়ে যাওয়া সুভাষচন্দ্র বসুর মানসিক গঠন, মূল্যবোধ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ছিল। পরবর্তীকালেও এই মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। এরফলে বিভিন্ন ঘটনায় অনেকেই তাঁকে ভুল বুঝেছে। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই যে, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বা ভারতের মহাপুরুষদের প্রতি অপমানজনক ব্যবহার সম্বন্ধে তিনি যা বলেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর নিজের জীবনেই তা পেতে হয়েছে।
ধার্মীকসুভাষচন্দ্রবসু
তিনি যে কোন জায়গায়, যে কোনও অবস্থায়, সহজেই ধ্যানে মগ্ন হতে পারতেন – এই অসম্ভব কাজটি সুভাষচন্দ্র বসু সহজ করে তুলেছিলেন কিশোর বয়স থেকে একাত্ম অনুশীলনের মাধ্যমে। বালক বয়সে মা প্রভাবতীদেবীর মুখ থেকে ধর্মকথা শুনে বড় হয়েছেন, বালক মনে তখন থেকেই ধর্ম নিয়ে নানান প্রশ্ন শুরু হয়েছিল; বালক থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক, যুবক থেকে পরিণত বয়স – মনের জিজ্ঞাসা থামেনি। কটক থেকে কলকাতায় আসার পর থেকে তিনি দক্ষিণেশ্বর ও বেলুড়ে যাতায়াত করতেন। মন্দিরে ‘দেবদর্শনে’ যাওয়ার আগে বা ‘সাধুসঙ্গে’র আগে তিনি গঙ্গান্নান করতেন। কিশোর বয়সে ধর্মের খোঁজে, গুরুর খোঁজে, সন্ন্যাস নেবার তীব্র ইচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছিলেন। জীবনে বহুবার সাধু সন্ন্যাসীদের সংস্পর্শে এসেছেন। পরবর্তীকালে দেশের কাজ ফেলে দিয়ে সন্ন্যাস নেবার পন্থা’কে মানতে পারতেন না, বলতেন পলায়নমনবৃত্তি। কিশোর বয়সে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের ‘মায়াবাদে’ আকর্ষিত হয়েছিলেন। ‘দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে তবেই চেতনা বাড়বে’ – একসময় এই পথও নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, তবে যখন মনে হলো এভাবে হবে না, তখন বিভিন্ন সাধনার পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন। জেল-জীবনে বহু রকমের আধ্যাত্মীক ও তন্ত্র সাধনার বই নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত ‘পুরোহিত দর্পণ’ বইটিতে সুভাষচন্দ্র বসু নিজের হাতে বাংলায় মন্তব্য ও বিশ্লেষণ লিখে দিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের পর থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ‘মন্ত্র-শক্তি’ বিশ্বাস করতেন – বহু পরে একথা তিনি তাঁর বন্ধু দিলীপ রায়কে চিঠিতে (৫-৩-১৯৩৩) জানিয়েছিলেন। সেসময় সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, এক এক মানসিক অবস্থার জন্য এক একটা বিশেষ শৈব বা শাক্ত বা বৈষ্ণব মন্ত্রের প্রয়োজন। যদিও শেষপর্যন্ত সুভাষচন্দ্র বসু নির্দিষ্ট কোন মন্ত্র অথবা তাঁর এক এক মানসিক অবস্থার জন্য আলাদা আলাদাভাবে সমস্ত ধর্মের মন্ত্র – এর কোনওটাই গ্রহণ করতে পারেননি।
পরমযোগী ‘শিবে’র ‘রূপে’ মুগ্ধ ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, গোড়ার কথা’ নিবন্ধে তিনি অসাধারণ ত্যাগব্রত খুঁজে পেয়েছিলেন সর্বত্যাগী শংকর শিবের আদর্শের মধ্যে – “নীলকণ্ঠ’কে আদর্শ করে যে ব্যক্তি বলতে পারে যে – আমার মধ্যে আনন্দের উৎস খুলে গেছে, তাই আমি সংসারের সকল দুঃখ কষ্ট নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে পারি; যে ব্যক্তি বলতে পারে – আমি সব যন্ত্রণা ক্লেশ মাথায় তুলে নিচ্ছি কারণ এর ভেতর দিয়ে আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি – সেই ব্যক্তিই সাধনায় সিদ্ধ হয়েছে। আমাদের আজ এই সাধনায় সিদ্ধ হতে হবে। নূতন ভারত যারা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের কেবল দিয়ে যেতে হবে – সারাজীবন কেবল দিয়ে যেতে হবে – নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাঙাল হয়ে যেতে হবে – প্রতিদানে কিছু না চেয়ে। নিঃশেষে জীবনদান করেই জীবনের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
‘মাকালী’র মাতৃমূর্ত্তি তাঁকে প্রবলভাবেই টানত। সুভাষচন্দ্র বসুর বন্ধু সাধক-গায়ক দিলীপকুমার রায়ের স্মৃতি-কথায় জানা যায় – “সুভাষচন্দ্র কৈশরে গঙ্গাজলে নেমে ইংরেজিতে আবৃত্তি করতেন স্বামী বিবেকানন্দের ‘কালী দ্য মাদার’। “সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বহুপাশে, কালনৃত্য করে উপভোগ, মৃত্যুরূপা তারি কাছে আসে” – বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুর মন-মন্ত্র এটাই।
‘শিব’ ‘কালী’ ‘কৃষ্ণ’ – সমান চোখে শ্রদ্ধার সাথে সমানভাবে দেখতেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি স্পষ্টতই বলেছেন – “হিন্দুদের ভগবানের নাম আলাদা হলেও মূলত সকলেই এক; কেউ একরূপে আরাধনা করছে, আবার কেউ অন্যরূপে তাঁকে ডাকছে।” এখানে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ‘যত মত তত পথে’র একশ-শতাংশ প্রভাব খুব স্পষ্ট।
সুভাষচন্দ্র বসু আদ্যপান্ত ধার্মীক ছিলেন। নিজের ‘ধর্মে’ বিশ্বাসী হওয়া প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার রয়েছে, আবার নিজ ধর্মে বিশ্বাস না রাখাও ব্যক্তিগত ইচ্ছা, কোনও অন্যায় নেই। ধর্মে বিশ্বাস রাখলেই যে সেই ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের হয়ে যাবেন, তাও না; আবার অনেকক্ষেত্রে তাও হতে পারে, যেমন উগ্র-ধার্মীক, তাদের কাছে নিজের ধর্মই সঠিক, অন্য ধর্ম বেঠিক, আর সেক্ষেত্রে তা দেশ ও দেশের জনগণের কাছে খুবই দুশ্চিন্তা ও ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আশ্চর্যের কথা এই যে, ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে ধর্মের কোনও ভূমিকা ছিল না। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার সাথেই তিনি নিজেকে নিয়ােগ করেছিলেন দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কাজে। ‘মানুষ সুভাষচন্দ্র বসু’ এবং ‘নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’ – এই দুই নামের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে আচার-আচরণে বিস্তর ফারাক থাকলেও মানসিকতায় কোনও পার্থক্য নেই। মানসিক পার্থক্য না থাকার কারণ ঐ একজন – স্বামী বিবেকানন্দ। ‘ব্যক্তি সুভাষচন্দ্র বসু’ ‘শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দে’র যে অসাম্প্রদায়িকতা ও সেবামূলক মনোভাবে আপাদমস্তক প্রভাবিত ছিলেন, ‘নেতাজী’ রূপেও সেই প্রভাব সর্বোচ্চ আধারে বিরাজ করছে।
শক্তিউপাসকসুভাষচন্দ্র_বসু
ব্যক্তি সুভাষচন্দ্র বসু ‘শাক্ত-ধর্মে’ বিশ্বাসী – একথা অস্বীকার তাঁরাই করবেন যাঁদের তাঁর প্রতি বিশ্বাস নেই – একথা বলব না, বলব নিজেদের নেতাজী-প্রেমে আস্থা নেই। প্রথম থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে – তাঁর শক্তি-পুজো আসলে রক্ত-মাংসের নারী-পুজো। অর্থাৎ যে কোন জাত-ধর্ম-বর্ণের নারী বা মহিলাকে মাতৃ-জ্ঞানে দেখার স্বাভাবিক মানসিকতায় তিনি শক্তির-উপাসক। আর ঠিক এই কারণেই সুভাষচন্দ্র বসু চিরকুমার ব্রহ্মচারী। কোনও ‘নারী’কে বিবাহ করা অনেক দূরের প্রশ্ন, কাম-স্পর্শ করেননি কখনও। তাঁর নারীর প্রতি শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ যৌন-সংস্কার মুক্ত। স্বামী বিবেকানন্দের যে পৌরুষভাব, তাঁর ভাব-শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসুর সেই একই লক্ষণ, হুবহু।
সেবকসুভাষচন্দ্রবসু
কলেজ জীবন শুরু করার আগেই কিশোর সুভাষচন্দ্র ও তাঁর একদল-বন্ধু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ ভাবধারা অনুযায়ী নিজেদের জীবন-গঠন করার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিলেন। কটকে থাকাকালীন ছাত্রবস্থাতেই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে একটি ‘সেবাদল’ তৈরি করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯১১ সাল, ভয়ঙ্কর মহামারী দেখা দিল কটক শহরে। সব দেখে চিন্তিত সুভাষচন্দ্র তাঁর বিদ্যালয়ের বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন সমাজসেবী দল। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কলেরা রোগীদের সেবা করে যেতে লাগলেন। নিজের টিফিন থেকে একটা করে রুটি ছোট্টো সুভাষ তুলে রাখতেন স্কুলের যাতায়াতের পথে বসে থাকা এক ভিখারিনীকে দেওয়ার জন্য। আর একটু বড় হয়ে কলেজ জীবনে বহু সময় বাড়ি থেকে কলেজ প্রায় তিন-কিমি পথ হেঁটে যেতেন, হাত খরচের পয়সা দিয়ে দিতেন কোনও না কোনো দুস্থ’কে – এই সব শিক্ষা তাঁকে কেউ দেয়নি, এই বোধ তাঁর তৈরি হয়েছিল নিজে থেকে, সেই ছোট্টো বয়স থেকেই। ১৯২২, সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে উত্তরবঙ্গে।