রাত পোহালেই বাঙালির পৌষপার্বণ বা মকর সংক্রান্তি এবং অসমিয়াদের ভোগালি বিহু। অসমিয়া পরম্পরার ভোগালি এবং বাঙালিদের মকর সংক্রান্তি উৎসবের প্রাক্কালে মেতে উঠেছে অসম। মকর সংক্রান্তি একটি আনন্দের উৎসব। তাই এই উৎসবের খুশিতে মেতে উঠেছেন সকলে।
মকর সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে স্নান করে ঘরে আলপনা দিয়ে কিন্তু সূর্যদেবের পুজো করার নিয়ম প্রচলিত। সূর্যদেবের আশীর্বাদে রোগ থেকে মুক্তি মেলে এবং ফসল ভালো হয়। এই বিশ্বাসকে অবলম্বন করে আগামীকাল ভোরে গুয়াহাটির ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক নদী, কুশিয়ারা নদী, লঙ্গাই নদীর বিভিন্ন ঘাটে নানা স্তরের নগারিক গাত্রদাহনের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। হিন্দু বিধান অনুযায়ী তিথি মেনে মহানগর থেকে রাজ্যের প্রায় সব মফসসল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী-পুরুষ ধূপ-দীপ, ফলমূল, জল, সিঁদুর, লাল কাপড় নিয়ে নদ-নদী এবং বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে পুজো দিতে যাবেন।
পৌষসংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম একটি উৎসব। এই উৎসব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে পালিত হয়। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে বা পরে এই তিথি আসে। মকর সংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘উত্তরায়ণ’-এর সূচনা হিসেবে পরিচিত। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে পালিত উৎসবকে কেউ কেউ শস্যোৎসবও বলে থাকেন। এই উৎসব জমি থেকে পাকা ধান প্রথম ঘরে তোলা হয়। তাই বিশেষ করে চাষিদের ঘরে পালন করা হয়ে থাকে শস্যোৎসব। হেমন্তকালে আমন ধান ঘরে প্রথম তোলার প্রতীক হিসেবে কয়েকটি পাকা ধানের শিস ঘরে এনে কিছু নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-পেটরা-তোরঙ্গ ইত্যাদির উপর এবং খড়ের চালে গুঁজে দেওয়া হয় শিস। বছরের প্রথম ফসলকে অতিপবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করা হয়।
নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠে তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়ো, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের বৈশিষ্ট্য আলাদা, তার মেয়াদও আলাদা হয়।
পৌষসংক্রান্তি মানেই বাঙালির কাছে পিঠে-পুলি উৎসব। কয়েক দশক আগেও ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হত এই উৎসব। রাজ্যের গ্রামেগঞ্জে এখনও সেই ধারা কিছুটা বজায় থাকলেও শহরে ব্যস্ততার যুগে এখন খানিকটা ম্লান। তবে শতব্যস্ততার মধ্যেও সরুচাকলি, পাটিসাপটা, মালপোয়া-সহ নানা রকমের পিঠে-পুলি সাধ্যমতো অসমিয়া সমাজ এবং বাঙালিদের ঘরে ঘরে তৈরি হয়। বিরুন চালের চোঙা পিঠে সিলেটিদের অন্যতম বিশেষ ব্যঞ্জন। বিভিন্ন জায়গায় এই সময় ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজও রয়েছে।
মকর সংক্রান্তির মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে করিমগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বৈঠাখালের দেবী ভগবতী মন্দিরের প্রধান আচার্য পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা বলেন, রাশিচক্রের বিচারে এই তিথিতে সূর্য মকর রাশিতে (ক্যাপ্রিকর্ন) প্রবেশ করে। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এ রকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে। তিনি বলেন, এ বছর ১৪ জানুয়ারি নাকি ১৫ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি পড়ছে তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।
পণ্ডিত শর্মা জানান, তবে পঞ্জিকা অনুসারে আজ ১৪ জানুয়ারি মকর রাশিতে প্রবেশ করছে সূর্য। এদিন রাত ৮.১৪ মিনিটে পড়ছে সংক্রান্তির তিথি। তবে যেহেতু এই তিথি রাতে পড়ছে তাই স্নান ও দান নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। পঞ্জিকা মতে, আগামীকাল ১৫ জানুয়ারি সকাল ৭-টা ১৫ মিনিট থেকে সন্ধে ৫-টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত মকর সংক্রান্তির তিথি থাকবে। এই সময়কালের মধ্যে একাধিক বিধি অনুযায়ী পূজাপার্বণ করা হবে।
জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ভীমসেন শর্মা বলেন, এই সময় পুণ্যস্নান করলে জীবনে সৌভাগ্য সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলে। এই তিথিতে বাংলা বছরের ‘অশুভ’ পৌষ মাসের অবসান হয়।
গোটা রাজ্য-তো বটেই, সংক্রান্তির আগের দিন শনিবার মকর সংক্রান্তি বা অসমিয়া পরম্পরার উরুকা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশ থেকে গুজরাট, পঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ুর মতো অসমেও এই সময় নতুন ধান ওঠে। তাই উপবাস, ভোজ এবং বহ্ন্যুৎসবের মধ্যে দিয়ে জমে ওঠে ভোগালি বিহু। পঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত গোটা উত্তর ভারতে তিল, গুড় এবং দুধের মিষ্টান্নের পাশাপাশি অত্যন্ত জনপ্রিয় হল চাল, ডাল এবং মরশুমি সবজি দিয়ে তৈরি হয় খিচুড়ি। আবার পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে আছে সুজির হালুয়া, আর তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে দুধ আর চালের পায়েস এবং মিষ্টি।
গুয়াহাটি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে সুসজ্জিত মেজি (ভোলাঘর)। এই সব ভেলাঘরে নানান আমিষ ব্যঞ্জনে খাওয়া-দাওয়া হবে। গুয়াহাটির ব্রহ্মপুত্রে গত দুদিন ভোরে মৎস্য শিকার করেছেন মৎস্যজীবীরা। উজানবাজারে বসেছিল নানা মাছের বিশাল বাজার। আজরার কেউটপাড়া এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা দিপরবিলে মাছ শিকার। ওই অঞ্চলের মাছুয়ারা ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন মাছ শিকারে।
আজ উরুকার রাতে দীপরবিল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে বিহু বা পৌষ সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ মাঘ মাসের প্রথম দিন সকালে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে পরম্পরাগতভাবে সাজিয়ে তোলা ভেলাঘরে অগ্নিসংযোগ করে গঙ্গাপুত্র ভীষ্মের আশীর্বাদ নেবেন যাতে গোটা বছর সকলে ধনধান্যে ভরপুর হয়ে ওঠেন, সকলে যেন ভালোভাবে পরবর্তী নয়া বছর কাটান। একই পরম্পরায় মেতে উঠবে গোটা অসম।
মকর সংক্রান্তি বাঙালির অন্যতম একটি প্রিয় উৎসব। এই উৎসবটি প্রিয় হওয়ার কারণ এদিন ভোজনপ্রিয় বাঙালির রসনার তৃপ্তি ঘটে। গুড়, চাল, দুধ ইত্যাদি সহকারে নানা ধরনের উপাদেয় মিষ্টি, পিঠেপুলি, পায়েস ইত্যাদি বানিয়ে খাওয়া হয়। কেউ বাড়িতে আসলে অথবা নেমন্তন্ন করে তাঁকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। কথিত আছে এই বিশেষ দিনটিতে সূর্যদেব তার পুত্র শনি দেবতার প্রতি তার ক্ষোভ ভুলে যান এবং তার গৃহে সূর্যদেবের আগমন ঘটে। তাই এ-দিন সকলে মিলিত হয়ে মিষ্টি মুখ করানোর মাধ্যমে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন।