মকর সংক্রান্তি উৎসব ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ

হরিয়ানা, পাঞ্জাবে মাঘি বা লোহরি ; গুজরাটে উত্তরায়ণ ,তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল , আসামে বিহু , উত্তরপ্রদেশে খিচড়ি , পশ্চিমবঙ্গে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি —- সারা ভারতবর্ষব্যাপী একই উৎসব বিভিন্ন নামে উদযাপিত হয়। ভারতবর্ষের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য এই উৎসব গুলোর মাধ্যমে এক হয়েই আমরা একটা ‘জাতি’ যা ইউরোপীয়ানদের উপলব্ধি তে আসে না। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী , বিভিন্ন পরিধান-এ সজ্জিত হয়েও আমরা ‘অখন্ড’ ভারতবর্ষের অংশ—- একেই বিদ্বজ্জনেরা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বলেছেন।
দেশ গঠনের শর্ত , একসাথে বসবাস করার জন্য কি ঐক্যসূত্রের প্রয়োজন তা ইউরোপীয় দার্শনিকদের থেকে শেখার চাইতে ভারতবর্ষ কে অধ্যয়ন করলে বেশি ভালো বোঝা যায়। ইউরোপ বুঝেছে ভাষা এক হওয়া প্রয়োজন, কখনো বলেছে বেশ-ভূষা এক হতে হবে কখনো এক উপাস্যের প্রতি আনুগত্যকে রাষ্ট্রগঠনের শর্ত বলেছে। কিন্তু ইউরোপের ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে বারবার পেয়েছে ভারতবর্ষকে। ভারতবর্ষে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’কে দেখে বিস্মিত হয়েছেন জনৈক ঐতিহাসিক কারণ মতের বিভিন্নতাকে , বৈচিত্র্যকে মান্যতা দেওয়ার দর্শন ভারতবর্ষের বাইরে পাওয়া দুষ্কর।
কি মন্ত্রবলে এতো বড় দেশ ‘এক অখন্ড ভারত’ এ পরিণত হলো তা গবেষণা করতে ভারতবর্ষের উৎসবগুলো নিয়ে চর্চার প্রয়োজন , উৎসবগুলোর অংশ হয়ে উপলব্ধির প্রয়োজন — এ শুধু পুঁথিগত বিদ্যা দ্বারা জানা সম্ভব নয়।
সমগ্ৰ ইউরোপ বিভিন্ন ভাষায় ভাগ হয়ে যেদিন আলাদা অনেকগুলো দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল , তারও হাজার হাজার বছর আগে আমাদের সমাজ-সংস্কারক , ত্যাগব্রতী ঋষিগণ ঐক্যের মন্ত্র এবং তা অনুশীলনের ক্ষেত্ররূপে এই উৎসবগুলো কে সমাজে প্রচলিত করেছিলেন।
কোনো এক কবির ভাষায় তাই বলতে হয় ‘যত বিশ্ববাসী ছুটে আসবে কাছে , জানবে হেথায় কি যে মন্ত্র আছে’।
এই মন্ত্র ভারতবর্ষ কে শত বিপদ , হিংসার মধ্যেও আপন সংস্কৃতি কে জাগ্ৰত রাখতে সাহায্য করেছে।
উৎসবের স্নেহের বন্ধন , আকর্ষণ ভাষার বিভিন্নতাকে , আঞ্চলিকতা কে উপেক্ষা করে আমাদের ভারতবর্ষ কে বিচ্ছিন্নতাবাদের ভ্রুকুটি থেকে হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা করছে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ঔঁ সচ্চিদানন্দরূপায় নমোহস্তু পরমাত্মনে। জ্যোতির্ময়স্বরূপায় বিশ্বমাঙ্গল্যমূর্তয়ে।।

অদ্বৈতবাদীরা উপনিষদের পরমেশ্বরকে , ব্রক্ষ্মকে সচ্চিদানন্দ রূপে ব্যাখ্যা করেছেন। সচ্চিদানন্দ একটি সংস্কৃত সংমিশ্রিত শব্দ যা তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘সৎ’ অর্থাৎ সত্য , ‘চিৎ’ অর্থাৎ চেতনা এবং ‘আনন্দ’ অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধের ফলে ঐশ্বরীক আনন্দের অনুভূতি।আনন্দের অনুভূতির মাধ্যমে এই একাত্মতার উপলব্ধির অনুশীলনই ‘উৎসব’। উৎসবের মাধ্যমে সমাজ ও ব্যক্তির দ্বৈতসত্ত্বার যেনো বিলোপ ঘটে, ব্যক্তি যেনো সমাজের সঙ্গে মিশে যায়।
ষোড়শ সংস্কার, সনাতনীদের জীবনে অত‌্যন্ত প্রয়োজনীয় ষোলটি বহিরঙ্গ সংস্কার যা গর্ভস্থ অবস্থা থেকে শুরু হয়ে পরিণতি পায় অন্তিম সংস্কারে। বিভিন্ন প্রথা ব্যক্তিকে সমাজের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সুযোগ এনে দেয়— ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে এই যোগের চেষ্টা ব্যক্তির দিক থেকে থাকে আর ‘উৎসব’ হচ্ছে সমাজের সেই একমাত্র ‘সংস্কার’ যেখানে সমষ্টির আহ্বান থাকে ব্যষ্টির প্রতি।
উৎসবের মাধ্যমে ব্যষ্টিকে সমষ্টির দিকে টেনে ভারতীয় সমাজ আপন শক্তির জাগরণ করে।
ভারতবর্ষে সগুণ ও নির্গুণ ব্রক্ষ্মের উপাসনা একইসাথে চলেছে, আপন উপাসনা পদ্ধতি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ভারতবর্ষে ছিল না কারণ এই দেশ ‘যত মত , তত পথ’ এর আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু যখন মূর্তি পূজার শাস্তি হিসেবে
উপাসনা পদ্ধতির নামে অত্যাচার , নৃশংসতার শিকার হয়েছে ভারতীয় সমাজ সেই সময় মানসিক আঘাত থেকে বের হয়ে সমাজ স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে, নিজেদের মধ্যে ঐক্য ফিরে পেয়েছে উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে।


পৃথিবীর এমন কোনো সভ্যতা নেই, সমাজ নেই যেখানে সভ্যতার প্রবহমানতার পথে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর জন্য কিছু কুসংস্কার সভ্যতার গতিকে বাধা দিয়েছে—- ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সামাজিক উৎসব ভারতবর্ষে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি বিকৃতিকে নিশ্চিহ্ন করতে বড় ভূমিকা নিয়েছে। ভারতীয় সমাজ যখন সমুদ্রপারের , পাহাড়ের ওপারের লুটেরাদের থেকে নিজেদের বাঁচাতে প্রকাশ্যে মূর্তিপূজা থেকে বিরত থেকেছে তখন উৎসব তাদের সংস্কার , উপাসনা, আধ্যাত্মিকতাকে অনুশীলন ও অনুভবের সুযোগ এনে দিয়েছে। মূর্তি পূজাকে বাধা দেওয়া যায় কিন্তু মহাজাগতিক ঘটনাবলীকে উদযাপনের মাধ্যমে ঈশ্বরোপাসনাকে কিভাবে বাধা দিবে ? সেকথা তো কেতাবে উল্লেখই নেই।
সূর্যের ‘উত্তরায়ণ’ অর্থাৎ উত্তরদিকে যাত্রাকেই ‘মকর সংক্রান্তি’ উৎসব হিসেবে পালিত হয়। পৃথিবীর চারিদিকে সূর্যের আপাত গতিকে ১২ টি রাশির মাধ্যমে ভাগ করা হয়— মেষ , বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ,মীন।প্রত্যেক রাশিতে সূর্য একমাস করে অবস্থান করে এবং ১ বছরে একটি পূর্ণচক্র সম্পাদিত হয়।শাস্ত্রে সূর্যের ১২ টি নাম আমরা পাই —
যোগে ‘সূর্য নমস্কার’ এর ক্ষেত্রে ১২ টি অবস্থানে ১২ টি নামে সূর্যকে প্রণাম করা হয়— মিত্র , রবি , সূর্য, ভানু, খগ, পুষ্ণ, হিরণ্যগর্ভ , মরীচ , আদিত্য , সবিত্র, অর্ক, ভাস্কর।
মকর সংক্রান্তি, সূর্যের ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশের সময়। পৃথিবীর তিনধরনের গতির ফলে আকাশে সূর্যের অবস্থানের পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করে থাকি। পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারিদিকে গতি অর্থাৎ আহ্নিক গতির জন্য সূর্যকে পূর্বদিকে উদয় ও পশ্চিমদিকে অস্ত যেতে দেখি অর্থাৎ দিন ও রাত্রি হয়। পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য দিন-রাত্রির হ্রাসবৃদ্ধি ও ঋতু পরিবর্তন হয় এবং সূর্যকে আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্রসজ্জার স্বাপেক্ষে বিভিন্ন অবস্থানে দেখতে পায়।আকাশে সূর্যের এই অবস্থানকে চিহ্নিত করতেই পৃথিবীর চারিদিকে ১২ টি রাশি দিয়ে ৩৬০° কে ভাগ করা হয়েছে।
পৃথিবীর অক্ষ, কক্ষপথের তলের স্বাপেক্ষে ২৩.৫° কোণে হেলে থাকে।ফলে , আমরা সূর্যকে প্রতিদিন একজায়গা থেকে উদয় হতে দেখি না , উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সরতে দেখি।উত্তর গোলার্ধে তথা ভারতবর্ষ থেকে যেদিন সূর্য নিজের দক্ষিণতম অবস্থানে থাকে আর উত্তরদিকে যাত্রা শুরু করে সেই দিনটিকেই উত্তরায়ণ বলে।উত্তরায়ণের দিন ক্ষুদ্রতম দিন আর দীর্ঘতম রাত্রি হয়। একইভাবে, সূর্য উত্তরদিকে সরতে সরতে যখন উত্তরতম প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং দক্ষিণ দিকে তার যাত্রা শুরু হবার পালা সেইদিনটিকে দক্ষিণায়ন বলা হয়। ভারতবর্ষে সেই দিনটি হয় ২১শে জুন , সেই দিনে দীর্ঘতম দিন ও ক্ষুদ্রতম রাত্রি হয়।
সূর্যের ‘উত্তরায়ণ’ (দক্ষিণতম অবস্থান )থেকে ‘দক্ষিণায়ন’ (উত্তরতম অবস্থান) এ যাত্রার মাঝে এমন একটি দিন আসে যখন দিন ও রাত্রি সমান হয় ; সেই দিনটিকে বলে মহাবিষুব বা বসন্ত বিষুব(২০ মার্চ)। একইভাবে, ‘দক্ষিণায়ন’ থেকে ‘উত্তরায়ন’ এ সূর্যের যাত্রার মাঝে ২৩শে সেপ্টেম্বর দিন ও রাত্রি সমান হয় যাকে ‘জলবিষুব’ বা ‘শারদীয় বিষুব’ বলা হয়। এইভাবে একটি বছরকে চারটি বিশেষ দিন বা বিন্দু দিয়ে ভাগ করা হয়েছে এবং বিশেষ দিনগুলিকে চিহ্নিত করতে বিভিন্ন উৎসবের প্রচলন হয়েছে।মায়া , ভারতীয় সভ্যতা এই ধরনের মহাজাগতিক ঘটনাবলীকে উৎসবের মাধ্যমে পালন করে আসছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে।
‘উত্তরায়ন’ থেকে সূর্যের তেজ বাড়তে থাকে, দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে সাথেই কর্মচঞ্চলতা বাড়ে , দিনের আলোয় কাজের সময় বেশি পাওয়া যায়।কৃষক-শ্রমিক শীতের জড়তা কাটিয়ে নিজের শ্রমক্ষমতা ফিরে পায় , গাছ আবার পল্লবিত ও কুসুমিত হওয়ার পথে এগিয়ে যায় ; শীতকালে শীতজনিত যে সমস্ত শারিরীক সমস্যার মুখোমুখি আমরা হই সেগুলোও কমতে থাকে।
পৃথিবীর প্রাণশক্তির উৎস সূর্য — আর এ যেনো সূর্যেরই পুনর্জন্ম। তাই ‘উত্তরায়ন’ বা ‘মকর সংক্রান্তি’ সূর্যোপাসনার এক উত্তম সময়।
মকর সংক্রান্তি উৎসব থাইল্যান্ডে সোংক্রান , কম্বোডিয়ায় মহা সোংক্রান , মায়ানমারে থিংইয়ান , লাওসে পি মা লো নামে পালিত হয় যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তৃতিকে তুলে ধরে।

ঋকবেদ, পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্ৰন্থ।ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ৩৫ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকটি হল—-
“বি জনাঞ্ছ্যাবাঃ শিতিপাদো অখ্যন্ রথং হিরণ্য প্রউগং বহন্ত।
শশ্বদ্বিশঃ সবিতুর্দৈব্যস্যোপস্থে বিশ্বা ভুবনানি তস্থূ্ঃ।।”

অর্থাৎ, সূর্যরশ্মিজনিত হিরণ্যসদৃশ উত্তরদিকের অক্ষ ও শিশিরের নিম্নাখ্য এই দুই অক্ষের মাঝেই পৃথিবীর সবকিছুই অবস্থানরত।
ঋকবেদের সময় থেকেই সূর্যের ‘উত্তরায়ণ’ ও ‘দক্ষিনায়ণ’ গতির ধারণা ভারতবর্ষের ছিল।
ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ২২ তম সূক্তের ১৮তম ঋকে বলা হচ্ছে,
“ত্রীণি পদা বি চক্রমে বিষ্ণু র্গোপা অদাভ্যঃ
অতো ধর্মাণি ধারয়ন্।।”
এবং (১।২২।২০।) ঋকে বলা হয়েছে,
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ
দিবীব চক্ষুরাততম্।।”
এই দুটি ঋকে বিষ্ণুর বা সূর্যের তিনটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।এই তিন পদক্ষেপ একটি উত্তরায়ণ বিন্দুতে, একটি বাসন্ত বিষুবে(জলবিষুব) এবং একটি দক্ষিণায়ণ বিন্দুতে। শেষের টি পরম পদ বলে বিবেচিত কারণ এখান থেকেই সূর্যের দক্ষিণায়ণ যাত্রা শুরু এবং বর্ষাকালেরও শুরু।
এইভাবে ঋকবেদ, তৈত্তিরিয় ব্রাক্ষ্মণ , শতপথ ব্রাক্ষ্মণে সূর্যের গতি , বিশেষ অবস্থান ও তার ফলে ঋতু পরিবর্তনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কখনো বসন্ত , কখনো বর্ষাকে বছরের শুরু হিসেবে ধরে কালপঞ্জী নির্মিত হয়েছে আর সূর্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানকে উদযাপন করা হয়েছে উৎসবের মাধ্যমে।এই উৎসবগুলি ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার প্রাচীনত্ব ও গুরুত্বকে তুলে ধরে। বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে মহাজাগতিক ঘটনাবলীকে ঋকবেদ , বিভিন্ন ব্রাক্ষ্মণ গ্ৰন্থে তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতবর্ষ নাকি ইতিহাস লিখতে জানতো না। কিন্তু ভারতবর্ষ নিজের ইতিহাস কে পাথরে লিখেছে বিভিন্ন মূর্তির কারুকার্যে , রামায়ণ-মহাভারত , ব্রাক্ষ্মণ গ্ৰন্থে ইতিহাসের ঘটনাবলীকে মহাজাগতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে মিলিয়ে দিনক্ষণ পর্যন্ত এমনভাবে উল্লেখ করেছে যে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে —– লৌকিক বিশ্বাস , ভক্তির ফলে কিছু অতিরঞ্জন হয়েছে কিন্তু এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সফটওয়্যার সিম্যলুশেন সহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে আসল ইতিহাস বের হয়ে আসছে।
আপন পুঁথির ঐতিহাসিকতা , বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিয়ে ইউরোপ আজ নীরব। কিন্তু বিজ্ঞান, আজ ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিকে নতুনভাবে চিনিয়ে দিচ্ছে।
ভারতবর্ষের ঋষিগণ এই কারণেই হয়তো যে কোনো ঘটনা উল্লেখের সময় বিভিন্ন নক্ষত্র ও গ্ৰহের অবস্থান উল্লেখ করেছেন এমনভাবে যেন তা কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। হারিয়ে যায় নি। ভারতবর্ষ দীর্ঘকাল পরাধীনতার ফলে আপন ভাষা থেকে দূরে সরেছে, নিজেদের ঐক্যসূত্র ভুলেছে, আপন ইতিহাস ভুলেছে কিন্তু উৎসবের মাধ্যমে আনন্দ করতে ভোলে নি — ফলে পরোক্ষে ভারতবর্ষের ইতিহাস, ভাষা, জাতীয়তার ঐক্যসূত্র বেঁচে থেকেছে।
মহাকাল জানেন যেদিন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক স্মৃতিসৌধগুলি একে একে ক্ষতিগ্ৰস্ত হবে সেদিন ভারতীয়দের মধ্যে বেঁচে থাকবে তাদের উৎসব আর নতুন প্রজন্ম যখন তার কারণ বিশ্লেষণ করতে বসবে একে একে বেরিয়ে আসবে তাঁর আপন ভাষা , ইতিহাস, সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের আকাঙ্খা—- এইভাবেই এক ‘সনাতন’ সংস্কৃতি নিজেকে কালজয়ী করার রসদ উৎসবের মাধ্যমে নিজের মধ্যে জিইয়ে রেখেছে।
মকর সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নের সঙ্গে পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু বরণ , গুরু গোবিন্দ সিং এর চল্লিশজন শিষ্যের বলিদান সহ ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাবলী জড়িয়ে আছে।সেই ইতিহাসকে স্মরণ করে সমাজের স্ফূর্তি , আশা ও উদ্যমের মাধ্যমে আত্মশক্তি জাগরণের উৎসব—-‘মকর সংক্রান্তি’।
যুদ্ধে পরাজিত হলেও রাষ্ট্রের পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা ততক্ষণ জীবিত থাকে যতক্ষণ সেই রাষ্ট্র আপন সংস্কৃতির বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে।
রাষ্ট্র শুধুমাত্র একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বা ভূমি নয় ; রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয় সেই সংস্কৃতির মাধ্যমে যা ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বন্ধন দৃঢ় ক’রে সমষ্টি তে পরিণত করে , এমন এক সমাজ তৈরি করে যারা তাদের সংস্কৃতির মূর্ত রূপ আপন রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।
সংস্কৃতির প্রতি গর্ব থেকেই রাষ্ট্রের প্রতি গর্ব এবং সেই গর্ব কে , সেই সাংস্কৃতিক পরিচয় কে বাঁচিয়ে রাখার চেতনার মধ্য থেকেই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা এবং স্বাধীনতার অঙ্কুর প্রাণবায়ু লাভ করে।
সাংস্কৃতিক চৈতন্য ব্যতীত রাষ্ট্রীয়তার বীজ কখনোই বৃক্ষে পরিণত হতে পারে না বা পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয়তা সেই দিন লুপ্ত হয়ে যায় যেদিন ছলনার দ্বারা ভ্রমিত হয়ে বা আপন সংস্কৃতির প্রতি অজ্ঞানতা থেকে জন্ম নেওয়া অনুকরণ প্রবণতা সাংস্কৃতিক চৈতন্য কে নষ্ট করে।
‘মকর সংক্রান্তি’ উৎসব পালনের মাধ্যমে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক অখন্ডতা ও গৌরবময় ইতিহাসের উপলব্ধির মধ্যেই নিহিত আছে এই উৎসব পালনের স্বার্থকতা।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.