আমার চিদাকাশে তুমি জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ – প্রথমপর্ব

উপনিষদ বলছেন – প্রজাপতি একবার বলেছিলেন :আত্মা নিষ্পাপ, জরাহীন, মৃত্যু হীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন ও তৃষ্ণাহীন। আত্মাই সত্যকে জানার ও সত্যনিষ্ঠার প্রেরণাস্বরূপ। এই আত্মাকে অনুসন্ধান করতে হবে। তাঁকে বিশেষরূপেজানতে হবে । যিনি এই যিনি এই আত্মার অনুসন্ধান করে তাঁকেকে বিশেষ রূপে জানতে পারেন তিনি সমস্ত লোক ও সকল কাম্য বস্তুকে লাভ করেন।

য আত্মাহপহতপাপমা বিজরো বিমৃত্যুর্বিশোকো বিজিঘৎসোহপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ সোহন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ স সর্বাংশ্চ লোকানাপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামান্ যস্তমাত্মানমনুবিদ্য বিজনাতীতি হ প্রজাপতিরুবাচ।

উপনিষদ নানাভাবে আত্মজ্ঞানের মহিমা কীর্তন করেন। কিন্তু এই আত্মা স্বরূপ কি? কিভাবে তাঁকে জানা যায় ? 

উপনিষদ এখানে একটি গল্পের মাধ্যমে উত্তর দিচ্ছেন – সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি একবার ঠিক করলেন যে এই আত্মার কথা শোনাতে হবে সকলকে – দেব, দৈত্য, দানবকে , গন্ধর্বকে  , নাগকে , মর্ত্যের মরণশীল জীবকে , মানবজাতিকে, শুচিকে অশুচিকে। তিনি বললেন ” আত্মা অপহতপাপ্মা ” আত্মা নিষ্পাপ। আত্মা সর্বপ্রকার কালিমা মুক্ত, আত্মা পবিত্র । এককথায় আত্মাই এক ও অন্যতম পবিত্রস্বরূপ। আত্মা “বিজরঃ” অর্থাৎ জরাহীন,  আত্মার কোন ক্ষয় নেই,  “বিমৃত্যুঃ” অর্থাৎ আত্মার মৃত্যুও নেই। তাই পুরুষোত্তম যোগাবিষ্ট ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে পার্থকে বলছেন – 

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিদ্যতে সতঃ ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ ॥

অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্।

বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিত্কর্তুমর্হতি।।

হে অমৃতস্বরূপ, আমার অন্তরাত্মার নিভৃত ধামে তুমি আনন্দং পরমানন্দং। সেখানে কোনোকালেই তোমার মিলনের অন্ত নেই। সেখানে তুমি কেবল আছ না, তুমি মিলেছ; সেখানে তোমার কেবল সত্য নয়, সেখানে তোমার আনন্দ। সেই তোমার অনন্ত আনন্দকে তোমার জগৎসংসারে ছড়িয়ে দিয়েছ।  অথচ এই দেহের ক্ষয় আছে , নাশ আছে। কোন বয়স্ক ব্যক্তির দিকে তাকালে আমরা সেই জরাকে উপলব্ধি করতে পারি। একটি জীবদেহ সে মানুষ হোক বা পশু  দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। শরীর দুর্বল হয় ,লোল চর্ম , পক্ক কেশ হয়, শরীরের অভ্যন্তরের যে অন্ত্র তারও জরা ধরে। তারপর একদিন সেই দেহ ধ্বংস হয়ে যায়। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে। এই দেহের জন্ম যেদিনই হয়ে থাক না কেন একদিন মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু আত্মা অমর , তাঁর কোন বিনাশ নেই। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ তাই বলছেন – 

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥

প্রজাপতি বলেছেন –  আত্মা ” বিশোকঃ ” আত্মার শোক নেই, মায়া নেই । আত্মা “বিজিঘৎসঃ”  – আত্মার খিদে নেই , আত্মা ” অপিপাসঃ” – আত্মার তৃষ্ণা নেই । কিন্তু সেই আত্মাই এক অন্য মাত্র এক অন্যতম সত্য। আত্মা তাই “সত্যকামঃ” এবং “সত্য সংকল্প” । সত্যই তার প্রতিষ্ঠা।  আত্মার স্বরূপ হল সত্য। সত্য এবং আত্মা এক ও অভিন্ন। তাই আত্মা সত্য থেকে তিনি কখনো বিচলিত হন না। তাই আত্মাই সুন্দর, সনাতন, শিব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন – অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ ॥অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে ।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি ॥

রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন – 

“হে সত্য, আমার এই অন্তরাত্মার মধ্যেই যে তুমি অন্তহীন সত্য–তুমি আছ। এই আত্মায় তুমি যে আছ, দেশে কালে গভীরতায় নিবিড়তায় তার আর সীমা নাই। এই আত্মা অনন্তকাল এই মন্ত্রটি বলে আসছে–সত্যং। তুমি আছ, তুমিই আছ। আত্মার অতলস্পর্শ গভীরতা হতে এই যে মন্ত্রটি উঠছে, তা যেন আমার মনের এবং সংসারের অন্যান্য সমস্ত শব্দকে ভরে সকলের উপরে জেগে ওঠে–সত্যং সত্যং সত্যং। সেই সত্যে আমাকে নিয়ে যাও–সেই আমার অন্তরাত্মার গূঢ়তম অনন্ত সত্যে–যেখানে “তুমি আছ” ছাড়া আর কোনো কথাটি নেই।”

 “সঃ অন্বেষ্টব্য” –  তাঁকে অনুসন্ধান করতে হবে। এটাই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। তবেই এই অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার সংসার থেকে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়ার জগতে প্রবেশ ঘটবে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন – ” মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হল ঈশ্বর লাভ করা”। অর্থাৎ অর্থ ক্ষমতা বা পাণ্ডিত্য নয় একমাত্র উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে লাভ করা। ঈশ্বর অর্থাৎ , সেই আত্মার সন্ধান করা এবং তাকে পরমব্রহ্মে বিলীন করা। তার জন্য তো আত্মাকে বিশেষ রূপে জানতে হবে  , ” সঃ বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ” অর্থাৎ আত্মাকে বিশেষ রূপে জানতে হবে।  আমরা নিজেরা কিছু করবোনা বসে থাকব, তিনি এসে আমাদের মধ্যে প্রকাশিত হবেন ;  তেমন তো হয় না। তার জন্য আপনার যিনি গুরু তাঁকে প্রশ্ন করত হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটু সংশয় থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্ন করতে হবে । আত্মা কি এরকম?  না অন্য কিছু?  অবশ্য যিনি আচার্য হবেন তাঁর নিজেরও তো আত্মজ্ঞান থাকা আবশ্যক। অন্ধ কি অন্ধকে পথ দেখাতে পারে ? আচার্য নিজেকে নিজে যদি আত্মাকে না জানলে তবে শিষ্যকে কিভাবে উপদেশ দেবেন? 

যথা প্রকাশয়ত্যেকঃ কৃৎস্নং লোকমিমং রবিঃ ।
ক্ষেত্রং ক্ষেত্রী তথা কৃৎস্নং প্রকাশয়তি ভারত ॥

আত্মজ্ঞান হলে কি হয়?  সকল আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। সর্বোচ্চ অবস্থা লাভ হয়। 

 উপনিষদ বলছেন – তখন তুমি অনুভব করবে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তুমি জয় করেছ । কিন্তু কিভাবে ? কারণ তখন তুমি উপলব্ধি করেছ যে , তুমি আত্মা। আত্মাই নিখিল বিশ্বের সকল অন্তর আত্মার মূল।  সবকিছুর মধ্যে তখন তুমিই রয়েছো। এইভাবে তোমার সকল ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তাই শ্রীকৃষ্ণ ভারতকে বলছেন – কেশাগ্রশতভাগস্য শতাংশসদৃশাত্মকঃ ।

জীবঃ সূক্ষ্মস্বরূপোহয়ং সংখ্যাতীতো হি চিৎকণঃ ।।বালাগ্রশতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ ।

ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয় ইতি চাহ পরা শ্রুতিঃ ।।

 আত্মজ্ঞান হওয়ার অর্থ সর্বোচ্চকে লাভ করা।  আমার হয়তো সবকিছুই রয়েছে, যেমন ধর – স্বামী, সন্তান, আত্মীয়, বন্ধু , পাণ্ডিত্য, জ্ঞান, সামাজিক মর্যাদা,  কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, একটু অর্থ আছে , কিন্তু আমার আত্মজ্ঞান নেই। তাহলে ? তাহলে তো এসবই বৃথা। তাই পার্থকে পুরুষোত্তম মধুসূদন বলছেন – সর্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্মাণি চাপরে ।

আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে ।।

উপনিষদ বলছেন – প্রজাপতি বলেছেন – ” এই হল আত্মার স্বরূপ। আত্মাকে জানলে সবকিছুর প্রাপ্তি ঘটে। ” 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখছেন –  “জ্যোতির্ময়, আমার চিদাকাশে তুমি জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ। তোমার অনন্ত আকাশের কোটি সূর্যলোকে যে জ্যোতি কুলোয় না, সেই জ্যোতিতে আমার অন্তরাত্মা চৈতন্যে সমুদ্ভাসিত। সেই আমার অন্তরাকাশের মাঝখানে আমাকে দাঁড় করিয়ে আমাকে আদ্যোপান্ত প্রদীপ্ত পবিত্রতায় ক্ষালন করে ফেলো, আমাকে জ্যোতির্ময় করো, আমার অন্য সমস্ত পরিবেষ্টনকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে সেই শুভ্র শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ জ্যোতিঃশরীরকে লাভ করি।”

প্রজাপতি সকলকে বলছেন – ” এস , আমার নিকট হবে এলই জ্ঞান নিয়ে যাও।  আত্মজ্ঞান লাভ করে অমৃতের সন্ধান করো। আত্মজ্ঞান লাভ করে আত্মাকে জানো। তবেই তো সেই পরমাত্মা পরম ব্রহ্ম প্রকৃতি ও পুরুষের সন্ধান পাবে।” 

উপনিষদ এখানে ইন্দ্র এবং বিরোচন কথার অবতারণা করছেন। দেবসুর উভয়েই শ্রবণ করলেন যে , ” প্রজাপতি সকলকে আত্মজ্ঞান দান করবেন। সেই জ্ঞান লাভ করলে সকল লোক এবং সকল।কাম্যবস্তু লাভ করা সম্ভব।” সুতরাং সেই আত্মার স্বরূপ জ্ঞান লাভের নিমিত্ত ইন্দ্র ও বিরোচন প্রজাপতি ব্রহ্মার নিকট এলেন সেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে। ইন্দ্র যেমন সুরকুলের প্রতিভূ তেমনি বিরোচন অসুরকুলের। কিন্তু দেব বা অসুর কারুর পক্ষে কি এত সহজেই এই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব ? তাহলে সংযম, ত্যাগ ইত্যাদি শব্দ তো ব্যর্থ হয়ে যাবে! কি করলেন প্রজাপতি? 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.