স্বামীজিকে স্মরণ করে আমরা যদি আপন শক্তি সঞ্চার করতে না পারি, তাঁকে স্মরণ-মনন বৃথা। স্বামীজির জন্মদিনের প্রাক্কালে কলম ধরলেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। যুব সমাজের প্রতি স্বামীজির বার্তাটি প্রস্তুত-নিবন্ধে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি।
যুব সমাজের প্রতি স্বামীজীর বার্তা।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।
১৯৯৯ সালে লিসবনের সভায় ইউনাইটেড নেশনস ১২ ই আগষ্ট দিনটিকে ‘ইউথ ডে’ ঘোষণা করে। তার পরের বছর থেকে ভারতবর্ষে ১২ই জানুয়ারি ‘সর্বভারতীয় যুব দিবস’ পালন করা হয়। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঈঙ্গিতবহ দিনে যুবদিবস পালনের নির্দেশই ছিল ইউনাইটেড নেশনস্-এর। প্রশ্ন উঠবে, ভারতে কেন ১২ই জানুয়ারি যুব দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল?
বলা বাহুল্য, ১২ই জানুয়ারি, ১৮৬৩ — স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। তিনি তো এক সন্ন্যাসী! তবে যুবসমাজকে কীভাবে তিনি জাগরিত করতে পারেন? ‘সন্ন্যাসী’ শব্দটির সঙ্গে তো প্রথাগতভাবে ‘অধ্যাত্ম’ ও ‘অধ্যাত্ম’ শব্দের সঙ্গে তথাকথিতভাবে ‘বার্ধক্য’-র নিকট-সম্পর্ক। তবে বিবেকানন্দের সঙ্গে যুবসমাজকে কীভাবে যুক্ত করা হল? কেনই বা যুক্ত করা হল? এবার সেই আলোচনায় আসবো।
উত্তর কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীর এটর্নী সাহেবের দুরন্ত ছেলে নরেন্দ্রনাথ দত্ত, মা ভুবনেশ্বরীর ‘বিলে’ বন্ধুদের কাছে ছিলেন ভীষণ প্রিয়। তাই সে ছিল বন্ধুদের নেতা। ইচ্ছা ছিল ভবিষ্যতে সে হবে ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান, যে কিনা সম্পূর্ণ গাড়িটিকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে ছুটতে পারবে। সঙ্গবদ্ধ শক্তিকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছা, শক্তি দুই-ই ছিল বিলের। যুবক নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে এসে বুঝেছিলেন, ভারতাত্মায় আছে বিশ্বকে উত্তরণের মন্ত্র। কিন্তু সে শিক্ষা জগতের গোচরে আনতে হবে। চোখ ফোটাতে হবে। তাই তাঁর শিকাগো যাত্রা। গুরু তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কর্মযোগে বিভোর হতে। তাই তাঁর রামকৃষ্ণ-মিশন প্রতিষ্ঠা। তিনি শুধু সন্ন্যাসী নন, তিনি বীর সন্ন্যাসী, যিনি ভারতকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসাতে চেয়েছিলেন, নিজের মোক্ষ তাঁর কাম্য ছিল না। গুরুর কাছে শিখেছিলেন বাস্তব জীবনচর্যার পাঠ। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন – আগে ফুটবল খেলো, পরো গীতা পড়ো। এমন যুবক-কর্মযোগী তরুণ যে যুবশক্তির প্রেরণা হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
ভারতের যুব সমাজই ছিল স্বামীজির লক্ষ্য। আধ্যাত্মিক ভারতের বিশ্বব্যাপী প্রসারে যে বিশ্বেও শান্তি আসবে, তা তিনি বুঝেছিলেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল যুবকদের প্রতি। তাঁর এই প্রত্যাশা দু’টি দিক থেকে বিচার করবো — ১. তাঁর জীবনাচরণ ও কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে, ২. তাঁর চিরস্মরণীয় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
প্রথম অংশে আসি। তাঁর জীবনাচরণ ও কর্মপন্থা সম্পর্কে। তিনি কিভাবে শিক্ষা দিয়েছেন? নিজে আচরণ করে সেই শিক্ষা দিয়েছেন; যাকে স্বামীজি নিজেই বলেছেন ‘প্র্যাক্টিকাল বেদান্ত’। ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবা’। সে সময় ভারতের যুব-সমাজের কৃচ্ছসাধনেরও প্রয়োজন ছিল। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ সমগ্র ভারতের অন্তরাত্মাকে চিনতে, জানতে চেয়েছিলেন, গোটা ভারতের দর্শনকে বুঝতে চেয়েছিলেন। পরিব্রাজনের নামে এই যে কৃচ্ছ্রসাধন, তা যুব সম্প্রদায়ের প্রতিও এক উজ্জ্বল শিক্ষার নিদর্শন; নিজের জীবন, আচরণ দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার শিক্ষা। কোন্ লক্ষ্যে যাত্রা করবেন তার জন্যই তৈরি হল মিশন; রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
এক। গুরুর কাছে দীক্ষার পরে বরানগরে কয়েকজন যুবক মিলে একসঙ্গে বসবাস করে দেশ ও দশের চিন্তায় উৎসর্গ করেন নরেন্দ্রনাথ। মিশন তৈরির গোড়াপত্তন এখান থেকেই বলা যায়। নিজ গন্তব্যের জন্য সর্বস্বত্যাগের শিক্ষা এখান থেকেই পাওয়া যায়। পারিবারিক পিছুটান, দারিদ্র্যের কাঠিন্য — কোনো কিছুই তাঁকে গন্তব্যচ্যুত করতে পারে নি। বর্তমান ভারতের Restless যুবশক্তি কথায় কথায় বিদেশ পাড়ি দেয়। এদেশে নাকি সুযোগ নেই উন্নতির। যে মানুষটা শুধু পাতা উলটিয়ে বই মুখস্থ করতে পারতেন, তাঁর প্রতিভার কী অভাব ছিল? তিনি তাঁর দরিদ্র ভারতবাসীর জন্য উৎসর্গীকৃত ছিলেন বলেই ব্যগ্র হয়ে ওঠেন নি নিজ উন্নতিকল্পে। এই রাষ্ট্রচেতনা প্রতিটি যুবকের মধ্যে থাকা দরকার।
দুই। সমগ্র ভারতবাসীকে চেনার জন্য সন্ন্যাস নেবার পরে স্বামীজি পদব্রজে ঘোরেন সমগ্র দেশ৷ ভারতবর্ষকে চিনে তবেই নিজেকে চেনেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, রাজবংশের উত্থান-পতনের খবর দেয়। কিন্তু স্বচক্ষে নিজ দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনাচর্যার পরিদর্শন প্রবাস ছাড়া সম্ভব নয়। নিজ রাষ্ট্রকে অন্তর থেকে চেনার প্রয়াস তো তাঁর জীবনচর্যাই শেখায়!
তিন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “শান্ত মোরা, ভদ্র অতি পোষ মানা এ প্রাণ/বোতাম আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।” এ বর্ণনা বাস্তব। কিন্তু কোনো বাঙালি এমনও জন্মান, যাঁরা ‘ব্যাঘ্রে-বৃষভে’ সমন্বয় ঘটান। তেমনি এক বাঙালি যুবক ছিলেন বিবেকানন্দ। শান্ত ছিলেন, ভদ্রও ছিলেন। কিন্তু নিদ্রিত ভারতকে জাগানোর আগুন ছিল তার প্রাণে। তাই শান্তিতে শুয়ে থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। বিশ্বের আঙিনায় ভারতীয় অধ্যাত্মের সাজি নিয়ে তিনি গেলেন সর্বপ্রথম ভারতীয় সন্ন্যাসী বিশ্ব ধর্মসভায়। বিশ্বমাঝে নিজ স্বাতন্ত্রের আসন তৈরি করার শিক্ষা আজ যুব সমাজের নেওয়া উচিত স্বামীজির থেকে৷
চার। বাঙালির বৃটিশ স্তাবকতাকে ব্যঙ্গ করে সুকুমার রায় লেখেন, “হুঁকো মুখো হ্যাংলা/বাড়ী তার বাংলা।” এই হ্যাংলা বাঙালি বৃটিশ প্রভুর জুতো চাটতো আর বৃটিশরা তাদের ‘নেটিভ’ বলে ঘৃণা করতো। শান্ত যুবক সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন ট্রেনে উঠে পড়েন বৃটিশদের কামরায়, কামরায় বসে ছিলেন দুজন সাদা সৈন্য। স্বামীজিকে দেখে এক সৈন্য তাঁর বুদ্ধির সমালোচনা করে বলেন, “The Ass is coming”. অন্য সৈন্য তাঁর শ্যামলা গাত্রবর্ণ দেখে বলেন, “No, there is a goat.” স্বামীজি ধীর গতিতে এসে তাদের মাঝখানে বসলেন এবং দু’জনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “I am sitting between the two.” স্বাজাত্যবোধ-জাত প্রতিবাদ আজকের যুবকদের শিখতে হবে তাঁর জীবনাচরণ থেকে।
এবার আসি তাঁর চিরস্মরণীয় বক্তব্যের বিষয়ে। স্বামীজি আগুনের ভাষায় যুবকদের মধ্যে অসীম শক্তি সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। নতুন উদ্যমে হিন্দু যুবককে উদ্বুদ্ধ করেছেন, আত্ম-চেতনা জাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমার মধ্যে অসীম শক্তি, তুমিই আনন্দময়।” বলেছেন এগিয়ে যাবার কথা, “Arise, awake and stopnot till the goal is reached.” বলেছেন, শক্তিই জীবন এবং শক্তির শুভ প্রয়োগই ধর্ম।
স্বামীজি নারীর উন্নতির কথা ভেবেছেন। বারবার তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; নারীর আদর্শের কথাও শুনিয়েছেন, “হে ভারত, ভুলিয়ো না তোমার নারী জাতির আদর্শ।” সমকালে দাঁড়িয়ে ইওরোপীয় মহাপুরুষের এটা বলার প্রয়োজন ছিল না, তারা বলেনও নি। কিন্তু ভারতের প্রেক্ষাপট তখন আলাদা। নবজাগরণের পর্ব। এবং তার অন্যতম প্রয়োজন নারীমুক্তি। ভারতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তাই স্বামীজি এই কর্তব্যবোধ দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতাকে বালিকা বিদ্যালয় গঠনের উপদেশ দিয়েছেন। একেই বলে সামাজিকভাবে চালিত হওয়া। এই শিক্ষা স্বামীজির সবচাইতে বড় শিক্ষা। অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
স্বামীজিকে দেখা গেছে গভীর-গহন তত্ত্বের শিক্ষা দিতে; মিশনের মাধ্যমে মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের শিক্ষা দিতে৷ পাশ্চাত্যের ভোগবাদের তীব্র প্রতিবাদ করে, প্রাচ্যের ‘পেটের চিন্তা’ দূর করতে তাঁর হাঁক। এ পথে যেতে হলে ঐশী অবগাহন জরুরি, “হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।”
স্বামীজির শিক্ষাদর্শনের মূল কথা হল, সংবিৎ-গৃহ। জ্ঞানের বসতবাড়ি হল আমাদের অন্তর, আমাদের ভেতরের প্রকোষ্ঠ। সেই অন্তর-কে প্রকাশ করতে হবে। অন্তরবাসীকে বাইরে বোধন করতে হবে৷ এই বোধনের দায়িত্বটুকু পালন করবে শিক্ষাব্যবস্থা। আত্মনির্ভরশীল যুবসমাজ সেই কাজে বড় ভরসা। বলছেন, “জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভর হতে শেখানো না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।” শিক্ষা বলতে শুধু তথ্য সংগ্রহ তো নয়! তথ্য সংগ্রহ আর জ্ঞানার্জন এক নয়। “তথ্য সংগ্রহ করাই যদি জ্ঞান হয়, তাহলে লাইব্রেরির থেকে জ্ঞানী তো আর কেউ নেই।” অর্থাৎ স্বামীজি জীবনমুখী শিক্ষার অবতারণা করলেন এই মন্তব্যে। বই মুখস্থ নয়, চাকরি জোটানোর শিক্ষা নয়, কেরানি তৈরি নয়। অন্তর্নিহিত পূর্ণত্বের বিকাশ ব্যতিরেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়। দরকার ব্রহ্মচর্য পালন। ব্রহ্মচর্য মানে বিশুদ্ধতা, শুচিতা, পবিত্রতার সাধন। ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে চরিত্রবল আসে, মনের তেজ বিকশিত হয়। তাই ব্রহ্মচর্য পালন।
স্বামীজির পরামর্শ, “নেতা হতে যেয়ো না, সকলের সেবা কোরো। নেতৃত্বের এই পাশব-প্রবৃত্তি জীবনসমুদ্রে অনেক বড় বড় জাহাজ ডুবিয়েছে।” বলছেন, আদর্শ নেতারা আপন ব্যক্তিত্বের জন্যই সফল হতে পেরেছেন। নেতা যখন বলতে পারেন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ তখনই সাফল্য লাভ হয়। নিখুঁত ও শুদ্ধচরিত্রের নেতা চাই। আপাতদৃষ্টিতে শিশুকে মনে হয় সকলের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সে-ই তার শৈশব-সত্তা দিয়ে গোটা বাড়ি শাসন করে। শ্রেষ্ঠ নেতার চালিকাশক্তিও হবে শিশুর মতো; সরল, পবিত্র, বাল্যগাম্ভীর্য-ভাব মিশ্রিত, অথচ সকলের দ্বারা পরিচালিত। সকলের প্রভু তিনিই হতে পারেন, যিনি সকলের দাস। যার প্রেমে উচ্চ-নীচ নেই, কোনোরূপ অহংভাব নেই, সম্প্রদায়-বুদ্ধি নেই, তিনিই আদর্শ নেতা। নেতার সহায়ক সঙ্ঘশক্তি থাকতে হবে, যে সঙ্ঘশক্তি আজ্ঞানুবর্তিতার জন্ম দেয়। আদর্শ নেতা তিনিই, যিনি মহাশত্রুর প্রতিও সর্বদা হিতবচন প্রয়োগ করেন। নেতা সংগঠনে সমালোচনার বদলে ইতিবাচক কথা বলবেন। তার কাজ হল, যা বলার আছে বলা এবং যা শেখানোর আছে শেখানো। ঐখানেই তার কর্তব্য শেষ। বিরুদ্ধ সমালোচনা সকল সর্বনাশের মূল।
১৮৯৮ সালের আগষ্ট মাসে স্বামীজি কাশ্মীরের জাগ্রত দেবীস্থান ক্ষীরভবানী মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে দেখলেন মন্দিরের নিদারুণ ভগ্নদশা। মনে তীব্র ক্রোধ আর হতাশা জন্ম নিল, মনে মনে প্রবল বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন মন্দির ধ্বংসকারী মুসলমানদের উপর। “যবনেরা এসে তাঁর মন্দির ধ্বংস করে গেল, তবু এখানকার লোকগুলি কিছুই করল না। আমি যদি তখন থাকতাম, তবে কখনো চুপ করে সে-দৃশ্য দেখতে পারতাম না।” পরধর্মীদের আগ্রাসনে অন্য ধর্মীয় নেতার মনে যেমন ক্রোধের উদয় হয়, তেমনই হল স্বামীজির। তারপরই শুনলেন সেই দৈববাণী, “আমার ইচ্ছা আমি ভাঙা মন্দিরে বাস করব। ইচ্ছা করলে আমি কি এখনই এখানে সাততলা সোনার মন্দির তুলতে পারি না? তুই কি করতে পারিস?” তিনি মহাকালের উপরই সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলেন সমস্ত দায়ভার, তুরীয় অবস্থায় তাঁর উপর মহাশক্তি ভর করল। কিন্তু সুদূরের সলতে পাকানোর দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। লিখলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘Kali the Mother’, যার পরতে পরতে মহাকালীর তান্ডব, প্রগাঢ় মানসিক অভিভবে ধ্বংসলীলা। আপন বোধকে লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন তিনি। সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/কাল-নৃত্য করে উপভোগ,/মাতৃরূপা তারি কাছে আসে)। এ যে ভয়ঙ্করের পুজো, মৃত্যুর পুজো, এ যে কাপুরুষের আত্মহত্যা নয়, এ যে শক্তিমানের মৃত্যু সম্ভাষণ! কবিতার মধ্যে রয়েছে তাঁর ভাব-শিষ্যদের প্রতি শক্তি-সাধনার আহ্বান। সে কাজ স্বামীজির একলার পক্ষে তখন সম্ভব নয়। স্বামীজি তখন ক্লান্ত, অসুস্থ; সনাতনী ধর্মের প্রচার ও প্রসারে জীবনী-শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছেন। তাই কাব্যের মোড়কে স্পষ্টই বার্তা দিলেন আগামী প্রজন্মের প্রতি।
স্বামীজী বলছেন, “আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংসপেশী লোহা দিয়ে তৈরি, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরি আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা বজ্রের উপাদানে গঠিত।” এসব তো যুবশক্তির প্রতিই তাঁর আহ্বান। স্বামীজী মনে করতেন শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের এক তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা যে একসঙ্গে মিলতে পারিনা, পরস্পরকে ভালোবাসিনা, তোতাপাখির মত কথা বলে যাই, আচরণে পশ্চাৎপদতা দেখাই — তার আসল কারণ হল আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল।
স্বামীজী বলছেন, ভারতবর্ষের যে রাষ্ট্রীয় সৌধ, ভারত রাষ্ট্রের যে মেরুদণ্ড তার আত্মা রয়েছে ধর্মে। ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন নিহিত আছে হিন্দুধর্মে। রাক্ষসীর প্রাণ-পাখির মত ভারতবর্ষের ধর্ম-রূপ প্রাণ-পাখিকে বিনাশ করা যায়নি বলেই এত সয়ে এ জাতটা বেঁচে গেল। হাজার হাজার বছরের স্বভাব — তা মরবেই বা কী করে? স্বামীজী ভারতবর্ষের এই জাতীয় চরিত্র বদলের কথা বলেন নি। তাঁর মতে যে নদী পাহাড় থেকে হাজার ক্রোশ নেমে আসে তাকে ফের পাহাড়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বলছেন, যে দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম সে দেশকে ধর্মের মধ্য দিয়েই সব করতে হবে। “রাস্তা ঝেঁটানো, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তো হবে, নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামিচিই সার..।” স্বামীজীর পরামর্শ হল, যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি তা প্রাণপণে ধরে রাখতে হবে।
স্বামীজিকে স্মরণ করে আমরা যদি শক্তি সঞ্চার করতে না পারি, তাঁকে স্মরণ-মনন বৃথা। “ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ধর্ম করা”, আর ধর্ম জয়ের পথে অমিত শক্তির ব্যবহার করাই গীতার বাণী। যুবশক্তি স্বামীজির জীবনীপাঠ করে ধর্মের জন্য শুভঙ্করী শক্তি প্রয়োগ করবেন। ভারতবর্ষ যেমন সন্তভূমি, ভারতবর্ষ বীরভূমিও বটে। যুবসমাজ দৈনিক শরীরচর্চা করবেন, লাঠিখেলা, ক্যারাটে, কুস্তি, মার্শাল আর্ট শিখবেন, শিখবেন রকমারি রণকৌশল। হিন্দু নামে গর্ব অনুভব করবেন, করাবেন। তবেই বিবেক-শুভ্র বিবেকানন্দের জন্মদিন, প্রয়াণ দিন, শিকাগো বক্তৃতার দিন পালন করা সার্থক হবে।