স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবক্রমে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহে বধূ হয়ে এলেন প্রতিমা দেবী। ১১ বছর বয়সে প্রতিমা দেবীর স্বামী নীলানাথ গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে মারা যান। বালক নীলানাথ ছিলেন ঠাকুর বাড়িরই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা)-এর ছোটোবোন কুমুদিনী দেবীর কনিষ্ঠ পৌত্র। রবীন্দ্র-পত্নী মৃণালিনী দেবী তাঁর জীবিতকালে এই বালিকাকে বিয়ের আগেই দেখে রথীর বধূ করে আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সে ইচ্ছে অপূর্ণ ছিল মৃণালিনীর অকাল প্রয়াণের কারণে। ইতোমধ্যে প্রতিমার বিবাহ হয়ে গেলো। অকাল প্রয়াত হলেন নীলানাথ। ১১ বছর বয়সের মেয়েটির জীবনে নেমে এলো এক করুণ বৈধব্য। মর্মাহত হলেন রবীন্দ্রনাথ। এবার সামাজিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই প্রস্তাব করলেন নিজের পুত্রের সঙ্গে এই বিধবার বিবাহ দেওয়া যায় কিনা। রথী তখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন। যুক্ত হবেন তাঁরই পিতার স্বপ্নের বিশ্বভারতীর কর্মযজ্ঞে। পিতার অনুরোধে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেলো রথীর। স্বামীর সঙ্গে জুড়ে রাবীন্দ্রিক স্নেহ সান্নিধ্য নিয়ে বিশ্বভারতীকে বাস্তবিক শান্তির নিকেতন করে তুললেন প্রতিমা। কী গুণ তাঁর ছিল না! একজন যথার্থ চিত্রশিল্পী ছিলেন তিনি। কারুশিল্পকে বিশ্বভারতীর চত্বরে প্রবর্তন করাতে তিনি ছিলেন এক অগ্রগণ্য ব্যক্তি, তন্বিষ্ট উদ্যোগী। রবীন্দ্র নৃত্য-নাট্য রূপায়ণের পরিকল্পনাতে তাঁর যে অসীম উদ্যোগ এবং সহযোগিতা ছিল, তা আজও শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে ধরা আছে। মঞ্চসজ্জাতেও তাঁর অনুপম অংশগ্রহণ দেখতে পাওয়া যায় সেই সময়। রবীন্দ্র নাটক পরিবেশনের মধ্যে যে অনুপম সৌকর্য ও সৌন্দর্য থরে বিথরে ছড়িয়ে পড়তো সেদিন, তা প্রতিমা দেবীর নন্দনতত্ত্বের আলোকেই তো! সাহিত্য প্রতিভাতেও তিনি ছিলেন অনন্যা। ‘কল্পিতাদেবী’ এই ছদ্মনামে লিখেছেনও বহু কবিতা। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে ঠাকুরবাড়ির কিছু ইতিহাস ধরা আছে। যেমন – ‘নির্বাণ’, ‘স্মৃতিচিত্র’। আর রয়েছে ‘নৃত্য’, ‘চিত্রলেখা’। নারীদের নিয়ে তাঁর সদর্থক ভাবনাও আমাদের মুগ্ধ করে। ‘আলাপিনী’ সমিতি গঠন তাঁর প্রমীলা-ভাবনার এক প্রিয়-প্রকাশ। নারীশিক্ষা ও কল্যাণই তার মূল লক্ষ্য ছিল সেদিন; মহিলাদের সংঘটিত করা। পার্শ্ববর্তী গ্রামের মেয়েরাও প্রতিমার মতো এই নারীর স্নেহ সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছেন। প্রতিমা ঠাকুরের জন্ম হয় ১৮৯৩ সালের ৫ ই নভেম্বর।
অরিত্র ঘোষ দস্তিদার