তিনি পুণ্যানন্দ,তিনি পূর্ণানন্দ,তিনি খড়দহের আনন্দলোক।

সবে কয়েক মাস হল (১ লা সেপ্টেম্বর) অনাথ বালকদের নিয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার কয়েকজনকে আবার হিন্দু মহাসভার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী পাঠিয়েছেন। সে বছর (১৯৪৪ সাল) ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ রহড়ায় এলেন বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের পত্নী। ঘুরে দেখলেন সবকিছু। আশ্রমের আর্থিক সমস্যার বিষয়টিও এলো। গেরুয়া বসন পরিহিত সন্ন্যাসী জানালেন, আর্থিক সমস্যাকে তিনি বড় সমস্যা বলে মনে করেন না। কাজ ঠিকমতো করলে ভগবানের ইচ্ছায় প্রয়োজনমতো অর্থ আসবে। এবার প্রশ্ন এলো ফার্স্টলেডির কাছ থেকে — স্বামীজি, কি হলে আপনার কাজ সার্থক হয়েছে বলে মনে করবেন? সন্ন্যাসী উত্তর দিচ্ছেন, যে দিন বালকদের অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারবো যে এরা অনাথ, সেইদিনই আমি মনে করবো কৃতকার্য হয়েছি।

এই সন্ন্যাসীর নাম স্বামী পুণ্যানন্দ। তিনিই আধুনিক ও আধ্যাত্মিক রহড়ার স্থপতি। তাঁর একদা সহকর্মী ও আশ্রমিক শ্রী বিধুভূষণ নন্দ পুণ্যানন্দ স্মরণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “সর্ব জগতের হিতে/আপনারে পূর্ণরূপে বিকাইয়া দিতে/পুণ্যময় ‘পুণ্যানন্দ’ নামে পরিচিত হলে/সুবৃহৎ যজ্ঞভূমি তলে।” তিনি নিজে জানিয়েছেন, সাধন-ভজন, জপতপ বেশি করতে পারেন নি। কিন্তু ঠাকুরের কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করার চেষ্টা করেছেন। ঠাকুরের কাজ বলতে বালক-নারায়ণকে প্রতিপালন করার কাজ। তিনি এই সমগ্র কাজ করেছেন আনন্দের জন্য। ভোগবাদী বহুমুখী আকর্ষণের বিপ্রতীপে আনন্দতত্ত্বকে গ্রহণ করতে বলেছেন। আর হিংসার উন্মত্ততা পরিহার করতে বলেছেন। তিনি লিখেছেন, “সমগ্র বিশ্ব চরাচর, সমগ্র ভূত জগৎ … আনন্দ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে এবং পরিণামে আনন্দেই লীন হয়ে যাবে। মানুষও সেই আনন্দ-স্রোত থেকেই জন্ম লাভ করেছে এবং আবার আনন্দেই মিশে যাবে।” মানুষের অন্তর্নিহিত ব্রহ্মশক্তির জাগরণের জন্য তিনি জীবসেবার কথা বলেছেন। তা সেবা না হয়ে যেন ‘পূজা’ হয়ে ওঠে।

১৯০৪ সালের ১৫ ই জানুয়ারি পৌষ পার্বনের দিন তাঁর জন্ম, ঢাকার কাছে শিমূলিয়া গ্রামে। রহড়ার মানুষ তাঁকে যখন পেয়েছেন, তিনি তখন চল্লিশ বছরের যুবক। সৌম্য, স্থিতধী, প্রশান্ত-মুখ, গৈরিক বসনধারী এক উচ্চশির সন্ন্যাসী। তিনি রেঙ্গুনের রামকৃষ্ণ মিশনে কাজ করতে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন। দেখেছেন বাংলার পঞ্চারের মন্বন্তর, মৃত্যুর মহামিছিল। এরই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি দায়িত্ব পেলেন রহড়া বালকাশ্রমের। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অঙ্কুর নিজ হাতেই মহীরুহ করে গেলেন। রহড়া-খড়দহের মানুষ দেখতে পেলেন শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশাসন কেমন হওয়া উচিত। কী ছিল না তাঁর পাঠ্যসূচীতে! ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্মশিক্ষা, শারীরশিক্ষা, বাগান রচনা, অঙ্কন, মাটির কাজ, সঙ্গীত শিক্ষা, নাট্যাভিনয়, নীতিশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা — সবই রাখলেন আশ্রম বালকদের জন্য। তাঁরই প্রেরণায় গোটা এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এই ধারার শিক্ষানুরাগ। খড়দহের নাট্যচর্চা, সঙ্গীত সাধনা, ক্রীড়ামোদ তাঁরই সক্রিয়তার ফসল। খড়দহের আবহে মানুষের মনে আধ্যাত্মিকতার পরিমণ্ডল রচনা করে দিলেন। বামপন্থী মানুষেরাও মন্দিরে এসে স্নিগ্ধ হয়ে যেতেন। লোকসংস্কৃতির চর্চা করলেন তিনি; কবিগান, কীর্তন, তর্জা, লোকসঙ্গীতের নানান আসর বসতো উৎসবের দিনগুলিতে। তা অনুসরণ করতে শুরু করে দিলেন খড়দহের শিষ্ট সংস্কৃতির ধ্রুপদী ধারার মানুষ।

আধুনিক রহড়ার রূপকার স্বামী পুণ্যানন্দজী মহারাজের জন্মদিন আগামী ১৫ ই জানুয়ারি। তিনি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম কর্মসচিব। নিবন্ধের সঙ্গে ছবিটি এঁকেছেন শ্রীমান শীর্ষ আচার্য।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.