উৎসবের আলোতেও অন্ধকারে ডুবে বাংলার এই ‘শিল্প-গ্রাম’

যখন শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা আরাধনায় মেতেছে গোটা দেশ সহ এই রাজ্য ঠিক তখন উল্টো ছবি। বাঁকুড়ার ‘শিল্প গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত কেঞ্জাকুড়ায়। কাঁসা শিল্পের জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম একটা সময় বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষ্যে ঢাকের বাদ্যি আর আলোর রোশনাইয়ে ভেসে উঠত।

প্রতিটি বাড়িতে আলাদা আলাদাভাবে পুজোর পাশাপাশি গ্রামে বিশালাকার প্যাণ্ডেল তৈরী করে প্রতিমা এনে পুজো হত। এখন সে সব অতিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঁসা শিল্পের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। ফলে এই গ্রামের ঐতিহ্যবাহি শিল্প ও শিল্পী দু’জনেই বিপন্ন। ফলে এখন পুজো করতে হয়, তাই ধারাবাহিকতা রক্ষায় যেটুকু না করলেই নয়, সেভাবেই পুজো হয়। আগের সেই জৌলুস আর নেই।

বাঁকুড়া শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের তীরে কেঞ্জাকুড়া গ্রামে এক সময় পাঁচশোর বেশী কাঁসার বাসন তৈরীর কারখানা ছিল। সারা দিন ছিনি, হাতুড়ি, বৈদ্যুতিক যন্ত্র আর হাপরের শব্দে মুখরিত থাকতো পুরো গ্রাম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কয়েক হাজার মানুষ।

বর্তমানে সেই সংখ্যাটা অনেকটাই কমে এসেছে। এখানকার তৈরী কাঁসার তৈরী জিনিষপত্র রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি দিত ভীন রাজ্যে। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামালের অভাব ও উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা ক্রমশ কমতে থাকায় এই শিল্প আজ ধুঁকছে। ফলে শিল্পীর ঘরেই যখন টান, তখন শিল্পের দেবতা বিশ্বকর্মা পুজো এখন একরকম নিয়ম রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফলে বর্তমান প্রজন্ম আস্তে আস্তে সরে আসছে এই কাজ থেকে। তিনি আক্ষেপের সূরে বলেন, সরকারী চাকুরিজীবিরা যেমন অবসর নেওয়ার পর পেনশান, এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের একটা বয়সের পর পেনশান হিসেবে মেলে যক্ষ্মা সহ নানান জটিল রোগ। শিল্প যেখানে ধুঁকছে সেখানে শিল্পীর ঘরে বিশ্বকর্মার পুজো আনন্দ কি করে আসতে পারে বলেও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

এই শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত এই গ্রামের শিল্পী সুজন চঁন্দ জানান কাঁচা মাল আমদানি ও উৎপাদিত সামগ্রী রপ্তানীতে পুলিশী হায়রানির অভিযোগ তুলে বলেন, বংশরম্পরায় চলে আসা এই শিল্প থেকে অনেকেই সরে আসছেন। কিছু কাজ না পেলে হোটেলে কাজ করেও সংসার চালাচ্ছেন তারা। উচ্চ শিক্ষিতরা শহরে গিয়ে প্রাইভেট টিউশান করছেন। এক সময় ভীষণ ভালো চাহিদা ছিল ঠিক, কিন্তু এই মুহূর্তে যা অবস্থা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থেকে দিনপাত করা সম্ভব নয়।

আর এক শিল্পী জবা কর্মকার বলেন, আমাদের ছোটো বেলায় প্রতিটি বাড়িতে ঠাকুর আসতো, পুজো হতো। তাছাড়া গ্রামে একটি বড় পুজো হতো। বাইরে থেকে শিল্পী এনে অনুষ্ঠান হতো। এই মুহূর্তে কাঁসা শিল্প ভীষণ শোচনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। কাজ থাকলে হাতে টাকা আসবে তাহলেই পুজোর আনন্দ। সেই সুদিন আর ফিরবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তার। এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারীভাবে উদ্যোগ নেওয়া না হলে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে কয়েকশো বছরের প্রাচীণ এই শিল্প। কেঞ্জাকুড়া গ্রাম হারাবে তার ‘শিল্প গ্রাম’ তকমা। এখন এই বিষয়টাই বেশী করে ভাবাচ্ছে গ্রামের শিল্পী থেকে জেলার শিল্প দরদী মানুষদের।

তিমিরকান্তি পতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.