ভারতীয় ক্রিকেট ২০২২: কোহলি, রোহিতদের পাশে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছেন ঝুলুদি, মিতুরা

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত বনাম নেদারল্যান্ডস ম্যাচ তখন সবে শুরু হয়েছিল। এর মাঝেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সচিব জয় শাহ একটি টুইট করেছিলেন। যে টুইট পুরো ভারতীয় ক্রিকেটের ক্ষেত্রেই ছিল বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ। ছেলে এবং মেয়ে ক্রিকেটাররা সমান ম্যাচ ফি পাবেন বলে জানিয়েছিলেন জয় শাহ। ২০২২ সালে ভারতীয় ক্রিকেটের চিন্তাভাবনার বদলের একটি চিহ্ন হয়ে রইল সেই সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই ২০২২ সালটা মাঠে কেমন কাটল রোহিত শর্মা এবং হরমনপ্রীত কৌরদের দলের?

বছরের শুরুতেই ছেলেদের ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ় হেরে লাল বলের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন বিরাট কোহলি। এর পরেই সব ধরনের ক্রিকেটে নেতা করা হয় রোহিতকে। বছর শেষে যদিও তাঁর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে। এমনকী আগামী বছর তাঁকে সাদা বলের ক্রিকেটের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। এই বছর ভারত মোট ৭১টি ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে সাতটি টেস্ট, ২৪টি এক দিনের ম্যাচ এবং ৪০টি টি-টোয়েন্টি।

এশিয়া কাপ এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো দু’টি বড় প্রতিযোগিতা ছিল এ বছর। যে দু’টির একটিও জিততে পারেনি ভারত। পাঁচ বারের আইপিএলজয়ী অধিনায়ক রোহিতকে দেশের নেতৃত্বের দায়িত্ব দিলেও ট্রফি ভাগ্য এখনও ফেরেনি ভারতের। আগামী বছর হয়তো হার্দিক পাণ্ড্যর শরণাপন্ন হবে বোর্ড। এ বছর তিনিই আইপিএল জিতেছেন। ইতি মধ্যে দেশকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নেতৃত্বও দিয়েছেন। এ বছর সব ধরনের ক্রিকেটে রোহিত নেতা হলেও বার বার চোট এবং বিশ্রামের কারণে অনেক ম্যাচেই খেলতে পারেননি। আইপিএলের পরেই দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ় ছিল। যে সিরিজ়ের সময় ভারতের বেশ কিছু সিনিয়র ক্রিকেটারকে টেস্ট ম্যাচের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকায় ছিলেন রোহিত। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নেতা করা হয় লোকেশ রাহুলকে। যিনি শেষ মুহূর্তে চোট পান। সেই সিরিজ়ে দলকে নেতৃত্ব দেন ঋষভ পন্থ।

ভারতের ছেলে এবং মেয়েদের দলের পরিসংখ্যান।

বিরাট নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর ভারতীয় দলে রোহিতকে নেতা করা হলেও এই বছর একাধিক ক্রিকেটার ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে যেমন অভিষেক হয় নেতা হার্দিকের। ইংল্যান্ডের মাটিতে একটি টেস্ট খেলে ভারত। যেটিতে চোটের কারণে ছিলেন না রোহিত। সেই টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দেন যশপ্রীত বুমরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে আবার দেখা যায় নেতা শিখর ধাওয়ানকে। এক দিনের সিরিজ়ে নেতৃত্ব দেন তিনি। জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে রাহুল দলে ফিরলে তাঁকে অধিনায়ক করা হয়। এর পর এশিয়া কাপ এবং ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রোহিত দলে ছিলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর আবার বিশ্রামে যান। নিউ জ়িল্যান্ডে তাই আবার দেখা যায় নেতা হার্দিক এবং ধাওয়ানকে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজ়ে চোট পান রোহিত। শেষ এক দিনের ম্যাচ এবং টেস্ট সিরিজ়ে তাই নেতৃত্ব দেন রাহুল।

গোটা বছর ধরেই ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব তাই ভাগ করে নিয়েছেন অনেকেই। এটা দলের পক্ষে কতটা ভাল হল? সারা বছরের জয় এবং হারের পরিসংখ্যানের দিকে যদি নজর দেওয়া যায় তা হলে ‘বোকা’ স্কোরবোর্ড বলবে ৭১টি ম্যাচের মধ্যে এ বছর ভারত জিতেছে ৪৬টি এবং হেরেছে ২১টি। বাকি চারটি ম্যাচ বৃষ্টিতে ভিজেছিল। অর্থাৎ ৬৪.৭৮ শতাংশ ম্যাচ জিতেছে ভারত। কিন্তু ট্রফির বাক্স ভরেনি। বিদেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে টেস্টে হারাতে পারেনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হারতে হয়েছে এশিয়া কাপে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাংলাদেশ টেস্টে পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে তারকাখচিত ভারতীয় দলকে। তাই পরিসংখ্যান দেখে বিচার করলে একটু ভুল হতেই পারে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মেলবোর্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিরাটের ইনিংস ভোলা অসম্ভব।

ভারতীয় দলে এ বছরের সব থেকে বড় চিন্তার কারণ যদিও কোনও প্রতিপক্ষ দেশ নয়। এ বছর ভারত সব থেকে বেশি লড়াই করেছে চোটের বিরুদ্ধে। তাই এ বছর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর বোর্ড প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে রজার বিন্নী প্রথমেই বলেন, “ক্রিকেটারদের বার বার চোট পাওয়া খুব চিন্তার কারণ। কী ভাবে ক্রিকেটারদের চোট পাওয়ার সম্ভাবনা কমানো যাবে, সে দিকে নজর দেব। বেঙ্গালুরুতে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভাল মানের চিকিৎসক ও ফিজিয়ো রয়েছেন। তাঁদের কাজে লাগাতে চাই। আমি এর শেষ দেখে ছাড়তে চাই।” চোটের তালিকা দীর্ঘ করেছেন রবীন্দ্র জাডেজা, যশপ্রীত বুমরার মতো ক্রিকেটার। যাঁদের বাদ দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে হয়েছে ভারতকে।

দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় জয়ের গর্ব নিয়েই বছর শেষ করা ভারতীয় দলের প্রাপ্তি অবশ্যই বিরাটের শতরান। গত দু’বছরে যা দেখা যায়নি। আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শতরান করেন বিরাট। তাঁর ব্যক্তিগত কীর্তিগুলির মধ্যে অবশ্যই রিকি পন্টিংকে শতরানের তালিকায় টপকে যাওয়াটা থাকবে। এখন তাঁর সামনে শুধুই সচিন তেন্ডুলকর। ১০০টি শতরান করে বিরাট তাঁকে ছুঁতে বা টপকে যেতে পারবেন কি না তা জানা নেই, তবে বিরাটের রানে ফেরার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও যিনি সব থেকে বেশি রান করে ভারতকে স্বস্তি দিয়েছিলেন।

অর্থাৎ, ভারতীয় দল চারটি টেস্ট, ১৪টি এক দিনের ম্যাচ এবং ২৮টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এ বছর জিতলেও মনে রাখার মতো প্রায় কিছুই রইল না। মেলবোর্নে ভারতীয় সমর্থকরা পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দ পেলেও দিনের শেষে ট্রফি আসেনি। আগামী বছর দেশের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপ। ১২ বছর পর সেই ট্রফি জেতাই এখন পাখির চোখ ভারতীয় দলের।

ছেলেদের ক্রিকেটে রান এবং উইকেটের বিচারে সেরারা।

ভারতে ক্রিকেট মানেই মাঠ ভর্তি দর্শক। কেউ অফিসে কামাই করে, কেউ হাজার কিলোমিটার পার করে খেলা দেখতে পৌঁছে যান মাঠে। কিন্তু এ সবই এত দিন বলা হত ছেলেদের ক্রিকেট সম্পর্কে। ২০২২ দেখাল অন্য ক্রিকেট। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া মেয়েদের ম্যাচ দেখার জন্য মুম্বইয়ে এসেছিলেন ৪৭ হাজার দর্শক। মেয়েদের ক্রিকেটে ভারতে যা রেকর্ড। ধারণা পাল্টে দিয়েছিল সেই সিরিজ়। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হরমনপ্রীতদের লড়াই দেখার জন্য এত মানুষ যে আসবেন তা ভাবেনি বোর্ডও। সেই কারণেই প্রথম দু’টি ম্যাচের টিকিট পাওয়া গিয়েছিল বিনামূল্যে। সিরিজ়ের মাঝ পথেই সিদ্ধান্ত বদল করা হয়। শেষ তিনটি ম্যাচে টিকিট কিনতে হয় দর্শকদের। সিরিজ়ের মাঝে এই সিদ্ধান্ত বদলটাই মেয়েদের ক্রিকেটে বড় জয় বলা যেতে পারে।

হরমনপ্রীতরা যদিও শুধু এই জয় নিয়ে বসে থাকেননি। তাঁরা দেশকে ট্রফি এনে দিয়েছেন। এশিয়া কাপ জিতে নিয়েছে ভারত। সপ্তম বার এশিয়া কাপ জিতেছে তারা। কমনওয়েলথ গেমসে রুপো পেয়েছেন হরমনপ্রীতরা। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হেরে যান তাঁরা। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে টেস্ট ড্র করেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে এক দিনের সিরিজ় জেতেন। যদিও সেই সিরিজ় জেতার পিছনে ছিল দীপ্তি শর্মার মাঁকড়ীয় ভাবে (নিয়ম অনুযায়ী এখন রান আউট) চার্লি ডিনকে আউট করা। যা নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। ইংরেজ ক্রিকেটাররা হরমনপ্রীতদের খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভারতীয়রা বলেন যে, ক্রিকেটের নিয়ম মেনেই খেলা হয়েছে।

সেই বিতর্কিত ম্যাচটাই ঝুলন গোস্বামীর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। প্রাক্তন অধিনায়ক এবং ভারতীয় দলের ‘ঝুলুদি’ বিদায় নেন লর্ডসে শেষ ম্যাচ খেলে। ২০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে তাঁর সংগ্রহ ৩৫৫টি উইকেট। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে ঝুলনের অবদান শুধু ওই উইকেটগুলি দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ বাংলা থেকে ভারত হয়ে গোটা বিশ্বে ছুটেছেন এবং মেয়েদের অনুপ্রাণিত করেছেন। অসংখ্য মেয়ে ঝুলনকে দেখে হাতে ক্রিকেট বল তুলে নিয়েছেন। ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন বুনেছেন ঝুলন।

কমনওয়েলথ গেমসে রুপো পেয়েছেন হরমনপ্রীতরা।

শুধু ঝুলন নন, এ বছর ভারতীয় ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন মিতালি রাজও। ভারতের দুই প্রাক্তন অধিনায়কই জার্সি খুলে রেখেছেন। ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলেন মিতালি। রাজ করেছেন ২৩ বছর। রাজস্থানের মিতালি গোটা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সগর্বে। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ১০,৮৬৮ আন্তর্জাতিক রান। সারা বিশ্বের বোলারদের শাসন করেছেন। তাঁকে তুলনা করা হয়েছে সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে। মিতালি হয়তো সচিন হতে চাননি, তিনি মিতালিই থাকতে চেয়েছেন। ভারতীয় সাজঘরে যাঁকে সবাই ডাকতেন ‘মিতু’ বলে। তিনিও এখন প্রাক্তন ক্রিকেটার। হরমনপ্রীত, স্মৃতি মন্ধানা, রেনুকা সিংহদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে এ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জার্সিটা খুলে রাখলেন ঝুলন এবং মিতালি।

পরিসংখ্যানের বিচারে এই বছর হরমনপ্রীতরা ৫৩.৪৮ শতাংশ ম্যাচ জিতেছেন। এ বছর তাঁরা খেলেছেন ৪৩টি ম্যাচ। এর মধ্যে ১৮টি ছিল এক দিনের ম্যাচে এবং ২৫টি টি-টোয়েন্টি। মোট ২৩টি ম্যাচ জিতেছেন দীপ্তিরা। এর মধ্যে ৫০ ওভারের ম্যাচ জিতেছেন ১০টি এবং টি-টোয়েন্টি ১৩টি। সংখ্যার বিচারে জয় এবং হারের ফারাক খুবই সামান্য। কিন্তু এর মধ্যে বেশ কিছু ম্যাচ রয়েছে যেখানে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন স্মৃতিরা। জয়ের খুব কাছে গিয়েও হারতে হয়েছে অনেক ম্যাচ।

আগামী বছর থেকে শুরু হবে মেয়েদের আইপিএল। ছেলেদের আইপিএলের আগেই যা হয়ে যাওয়ার কথা। শুধু ম্যাচ ফি নয়, সব দিক থেকেই ছেলে এবং মেয়েদের সমান জায়গায় বসাতে চাইছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা। যদিও ভারতীয় ক্রিকেটকে চালনা করে যে বোর্ড সেই বিসিসিআইয়ের নির্বাচন নিয়েও এ বছর কম চর্চা হয়নি। রাজনীতির হাওয়া সেখানেও বইছে পুরো দমে। এর মাঝেই আগামী বছর পাকিস্তানে গিয়ে এশিয়া কাপ খেলবেন না বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন সচিব জয় শাহ। সৌরভ প্রাক্তন হয়ে গেলেও তিনি এখনও দায়িত্বে রয়েছেন। সঙ্গে বিশ্বকাপজয়ী বিন্নী। তাঁদের নেতৃত্বে আগামী বছরও অনেক বদল দেখতে পারে ভারতীয় ক্রিকেট।

সমর্থকদের শুধু আশা, সেই বদল হোক ইতিবাচক এবং ট্রফি আসুক রোহিত, হরমনপ্রীতদের হাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.