মৃত্যু সবসময় বিষাদের। বড্ড যন্ত্রণার। যে একেবারের জন্য যান, তিনি কষ্ট পান। তাঁর কাছের মানুষগুলো, তাঁকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কষ্ট হয়তো আরও অনেকটা বেশি। তবে সব মানুষের চলে যাওয়া নিয়ে কষ্ট পেতে নেই। পেলে-র (Pele) মতো মানুষের জন্য একেবারেই নয়। তাঁর প্রিয় ব্রাজিল (Brazil) যখন কাতার বিশ্বকাপে (FIFA Qatar World 2022) হেক্সা করার স্বপ্ন নিয়ে লড়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই পেলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শেষ যুদ্ধটা লড়ছিলেন। কিন্তু এবার আর কর্কট রোগের বিরুদ্ধে ম্যাচটা জিততে পারলেন না। ‘মৃত্যু’ নামক ডিফেন্সের জালে চিরতরে আটকে গেলেন। ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) কাছে চলে যাওয়ার সময় বয়স হয়েছিল ৮২। রেখে গেলেন পরিবার-সহ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা অগণিত শুভানুধ্যায়ীদের।
এডসন অ্যারানটিস দো নাসিমেন্ট (Edson Arantes do Nascimento) সারা বিশ্বে যিনি পেলে নামে বিখ্যাত, চার দশকেরও বেশি সময় আগে ১৯৭৭ সালে অবসর নেওয়ার পরেও প্রাক্তন এই ফুটবলার সারা দুনিয়ায় এখনও সবচেয়ে পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। মূলত তিনবার বিশ্বকাপ জয় করার জন্য পেলে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনিই একমাত্র ফুটবলার, যিনি নারী কিংবা পুরুষ- যিনি এতবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন। এছাড়াও তিনি তার ক্লাব ও দেশের হয়ে ১,৩৬৩টি ম্যাচ খেলে মোট ১,২৮১টি গোল করেছেন যা বিশ্ব রেকর্ড। ইতিহাসের বিখ্যাত এই ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কিছু গল্প আছে যা অনেকেই হয়তো এখনও শোনেনি। এমন ১০টি গল্প ঘটনা তুলে ধরা হল…
Home Image:
পেলে ১৯৯০ সালে সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ব্রাজিলে ১৯৯৪ সালের সভাপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। তবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন ঠিকই। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই তিন বছর তিনি ব্রাজিলের ক্রীড়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সময় তাঁর নেতৃত্বে কিছু আইন তৈরি হয়েছিল। সেই আইনে ব্রাজিলের পেশাদার ফুটবলাররা অনেক সুবিধা পেয়েছিলেন। ক্লাবের সঙ্গে দর কষাকষির ব্যাপারে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। যা তাঁর নিজের প্রজন্মের ফুটবলারদের ছিল না।
ভক্তরা আনন্দের সঙ্গে গান ধরতে পারে ‘আছে মাত্র একজনই পেলে!’ কিন্তু আসলে এটি আক্ষরিকভাবে পুরোপুরি সত্য নয়। তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে সারা বিশ্বে মাঠে ও মাঠের বাইরে এই নামের আরও অনেককেই পাওয়া যায়। আফ্রিকার বিখ্যাত ফুটবলারদের একজন আবেদি এইও-র নাম হয়েছিল ‘আবেদি পেলে’। তিনি ঘানা ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। কেপ ভার্দের ডিফেন্ডার পেদ্রো মন্টেইরো যিনি ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে যোগ দিয়েছিলেন, তিনিও ‘পেলে’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই ডাকনাম তিনি পেয়েছিলেন তাঁর শৈশবে। কিন্তু ফুটবলার পেলের প্রভাব কতটা পড়েছিল ব্রাজিলের সমাজে, সেটা বোঝা যায় পেলের আসল নাম ‘এডসন’ থেকে। ব্রাজিলের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ভূগোল ও পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউটের হিসেবে প্রচুর শিশুর নাম রাখা হয়েছে ‘এডসন’। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ব্রাজিলে ৪৩৫১১ জনের নাম ছিল এডসন। কিন্তু এর দুই দশক পর, পেলে যখন এক হাজারেরও বেশি গোল করেন এবং তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেন, তখন এই নামের মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১১ হাজারেরও বেশি।
পেলে যদি ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ ছবিতে গোলকিপারের ভূমিকায় অভিনয় করতেন তিনি কিন্তু দর্শকদের মোটেও হতাশ করতেন না।
বাস্তব জীবনেও তিনি ক্লাব ও দেশের বিকল্প গোলকিপার ছিলেন। প্রথম একাদশের গোলকিপার আহত হলে তাঁর জায়গায় পেলে তেকাঠির নিচে দাঁড়িয়ে যেতেন। পুরো কেরিয়ারে পেলে স্যান্টোস এফসি ক্লাবের হয়ে চারবার গোলকিপারের গ্লাভস পরেছিলেন। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলিয়ান কাপের সেমিফাইনালেও তাঁর গোলকিপিং করতে দেখা গিয়েছিল। পেলে কিন্তু গোলকিপার হিসেবে একটিও গোলও হজম করেননি।
১৯৮০ সালে যখন ‘এসকেপ টু ভিক্টরি’ সিনেমাতে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন পেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি একাদশ ও বন্দীদের মধ্যে একটি কাল্পনিক ফুটবল ম্যাচের গল্প সেই সেলুলয়েডে তুলে ধরা হয়। সেই সিনেমায় পেলে-র সঙ্গে ছিলেন ববি মুরের মতো আরও কয়েকজন পেশাদার ও প্রাক্তন ফুটবলারও। সেই কাল্পনিক খেলায় গোলকিপারের ভূমিকায় অভিনয় করেন সিলভেস্টার স্ট্যালোন। ছবির একটি দৃশ্যে পেলে অ্যাক্রোবেটিক বাইসাইকেল কিক নিয়েছিলেন। এবং জানা যায় যে প্রথম শটেই তিনি এই কিকটি নিতে সফল হয়েছিলেন।
স্যান্টোস এফসি ক্লাবের ফুটবলাররা ১৯৭২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে খেলতে যাওয়ার ব্যাপারে খুশি ছিলেন না।
সেই সময় নাকি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর রাস্তায় বড় ধরনের অশান্তি চলছিল। এমনকি রাস্তায় ট্যাঙ্ক জ্বলতেও দেখা যায়। যদিও সঠিক নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়েই সেখানে খেলতে রাজি হন পেলে-রা। তবে সব পরিস্থিতি বদলে যায় ম্যাচের ৪৩ মিনিটে। কারণ গোল করে বসেন পেলে। খেলা শেষ হওয়ার পর পোর্ট অফ স্পেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে থাকা সমর্থকরা দৌড়ে মাঠের ভেতরে চলে আসে এবং পেলেকে কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যায়। সেখান থেকে পেলেকে উদ্ধার করে আনতে বেশ কিছু সময় লেগেছিল।
পেলে তাঁর পুরো ফুটবল কেরিয়ারে মাত্র একবারই অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরেছিলেন। ক্লাব ও দেশের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার জন্য তাঁকে যখনই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটা তিনি সবসময় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় পেলের ৫০ বছর বয়সে। সেটা ছিল ১৯৯০ সালের ঘটনা, জাতীয় ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার ১৯ বছর পরে। সেই বছর ব্রাজিলের সঙ্গে বাকি বিশ্বের একটি প্রীতি ম্যাচ হয়েছিল মিলানে। সেই ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন পেলে। তাঁর ৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই ম্যাচের আয়োজন করা হয়। প্রথমার্ধের ৪৫ মিনিট তিনি মাঠে ছিলেন। যদিও সেই ম্যাচে ব্রাজিল ২-১ গোলে হেরে যায়।
পেলের সমালোচকরা বলেন, ইউরোপীয় কোনও ক্লাবের হয়ে না খেলার কারণে তাঁর কেরিয়ার জীবন অনেক সহজ হয়ে উঠেছিল। ব্রাজিলের অন্যান্য অখ্যাত ও বিখ্যাত ফুটবলাররা বিদেশি ক্লাবে খেললেও, পেলের কেরিয়ারের সোনালি সময় তাঁকে বাইরে খেলতে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। পেলেকে নেওয়ার জন্য স্যান্টোস এফসিকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ থেকে শুরু করে এসি মিলানের মতো ক্লাবও। সেই সময় ফুটবলাররা কোনও ক্লাবে খেলবেন সেই বিষয়ে তাঁদের কথা বলার সুযোগ ছিল খুব কম। তাছাড়া পেলেকে ব্রাজিলে রেখে দেওয়ার জন্য চাপ ছিল সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও। ১৯৬১ সালের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জানিও কোয়াদ্রস একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। পেলেকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করে তাঁকে ‘রপ্তানি করা যাবে না’ বলে নির্দেশ জানিয়েছিলেন।
তবে ব্রাজিলের এই ফুটবলার পরে অবশ্য একটি বিদেশি ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কসমসে যোগ দিয়েছিলেন।
পেলে নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে চলে যান। সেখানে গিয়ে একটি স্কুলে তিনি ইংরেজি শিখতেন। কোনও একদিন ক্লাসের ফাঁকে সংগীত গোষ্ঠী বিটলসের জন লেননের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ‘লেনন সেই স্কুলে জাপানি ভাষা শিখতে যেত।’ পেলে তাঁর আত্মজীবনীতে সেই ঘটনার কথা লিখেছিলেন। পেলে সেখানে আরও লিখেছিলেন, ‘জন লেনন আমাকে বলেছে যে ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ চলার সময় লেনন এবং বিটলসের অন্য শিল্পীরা হোটেলে গিয়ে ব্রাজিলের টিমের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের কর্তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয়নি।’
পেলের স্যান্টোস এফসি ফুটবল ক্লাব ছিল ষাটের দশকে বিশ্বের জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর একটি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এই ক্লাবটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নিত। এই খ্যাতির কারণে পেলে-র ক্লাব বাড়তি কিছু সুবিধাও পেয়েছিল। এমন একটি প্রীতি ম্যাচ ছিল যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নাইজেরিয়ায়, ১৯৬৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। বেনিন সিটিতে অনুষ্ঠিত ওই খেলায় স্যান্টোস ২-১ গোলে স্থানীয় একাদশকে পরাজিত করে। নাইজেরিয়াতে তখন রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চলছিল। দেশ থেকে বায়াফ্রা রাজ্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। গবেষক গুইলহের্ম গুয়াশের মতে, এমন পরিস্থিতিতে নাইজেরিয়াতে ফুটবলারদের পাঠানোর ব্যাপারে ব্রাজিলের কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তবে পেলে পরবর্তী সময় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, তাঁর দল নাইজেরিয়ার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেও খেলতে গিয়েছিল।
১৯৬৮ সালের ১৮ই জুন। কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় খেলা হচ্ছিল পেলের ক্লাব স্যান্টোস এফসি-র সঙ্গে কলাম্বিয়ান অলিম্পিক স্কোয়াডের। ওটা প্রীতি ম্যাচ ছিল। দর্শকে উপচে পড়ছিল স্টেডিয়াম। হঠাৎ করেই গ্যালারি থেকে দর্শকদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে যখন রেফারি গুইলেরমো ভেলাসকোয়েজ পেলেকে মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখনও লাল কার্ডের প্রচলন ঘটেনি, সেটা শুরু হয় ১৯৭০ সালে। কলাম্বিয়ার একজন ডিফেন্ডারকে ফাউল করা এবং রেফারির মতে ওই ফুটবলারকে অপমান করার কারণে পেলেকে মাঠ থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের জন্য মাঠে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। স্যান্টোসের ফুটবলাররা উত্তেজিত হয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরেন। সেই খেলার যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় রেফারি ভেলাসকোয়েজের চোখ কালো হয়ে আছে।