এত ভুয়ো নাম! প্রধানমন্ত্রী আবাস প্লাস যোজনার তালিকা থেকে ‘বেনোজল’ সরাতে গিয়ে কার্যত বিস্মিত রাজ্য ও জেলা প্রশাসনের একাংশ। হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তাদের। এই শোরগোলে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে শাসকদলের একটা বড় অংশ। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সর্ব স্তরে ‘দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ’-এর অভিযোগ তুলে পঞ্চায়েত ভোটের আগে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে বিরোধীরা। অন্য দিকে, তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, তালিকায় নাম থাকা দলের অধিকাংশ নেতারই এক সময়ে কাঁচা বাড়ি ছিল। পরে তাঁরা সচ্ছল হয়ে উঠলে তাকে ‘দুর্নীতি’ বলা যায় না। কেউ কেউ আবার তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে স্বচ্ছতার বার্তাও দিচ্ছেন। প্রশাসনও চাইছে, কোনও ত্রুটিরই যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়!
পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের কথায়, ‘‘সবটাই হচ্ছে ভুল বোঝা আর ভুল বোঝানোর কারণে। চার বছর আগের সমীক্ষার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হয়েছে। বিগত ৪ বছরে অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থায় বদল এসেছে। যাঁরা যোগ্য থেকে অযোগ্য হয়েছেন, তাঁদের নাম নিশ্চিত ভাবে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অযোগ্য, তাঁদের বিষয়টিও সরকার দেখছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ মতো পঞ্চায়েত দফতর সকলকে এই সমস্যার কারণ বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বোঝাতে পারলেও কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো দুঃখ থেকে যাবে। কিন্তু ক্ষোভ থাকবে না।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরে যাচাই পর্বের শুরুতে তালিকায় নাম ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৬৬ হাজার জনের। অনুমান, ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত তালিকায় নাম থাকতে পারে সাড়ে ৩ লক্ষের কাছাকাছি। ঝাড়গ্রামে জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিকের দাবি, তালিকায় ৭০ হাজার জনের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ গরমিলের হিসাব ধরা পড়েছে। জলপাইগুড়িতেও প্রায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার জনের তালিকায় অন্তত ২০ হাজার ভুয়ো নাম ছিল। বাকি জেলাগুলিতেও সম শতাংশ বা তার বেশি নাম কাটা যেতে পারে বলেই অনুমান রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরের একটি সূত্রের।
কিন্তু এই পরিমাণ অযোগ্যদের নাম তালিকায় উঠল কী করে? রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরের এক কর্তা জানান, শুরুতে জাতিগত ভাবে সংরক্ষিত শ্রেণি এবং আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীই আবাস যোজনার আওতাভুক্ত ছিল। কিন্তু পরে যখন সমীক্ষায় দেখা যায়, বহু দুঃস্থ মানুষই ওই প্রকল্পের সুবিধা পাননি, তখন নরেন্দ্র মোদী সরকার একটি সিদ্ধান্ত নেয়। স্থির হয়, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকেই এই প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হবে। কেন্দ্রের করা সমীক্ষার ভিত্তিতে পঞ্চায়েতগুলিকে তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কর্তার দাবি, তখনই যা ঘটার ঘটে গিয়েছে! নেতারা নিজেদের পছন্দের লোকের নাম তালিকায় তুলে দিয়েছেন।
রাজ্যের ব্লক প্রশাসন সূত্রের দাবি, বছর চারেক আগে তৈরি তালিকা যাচাই করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছে সমীক্ষাকর্মীদের। তালিকায় নাম থাকা বহু মানুষের পাকা বাড়ি, চারচাকার গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, একাধিক বাইক ও ট্রাক্টর রয়েছে। এমনকি, একই পরিবারভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও একাধিক সদস্য আবাস প্রকল্পের টাকা পাওয়ার জন্য আলাদা আবেদনও করেছেন। সমীক্ষাকর্মীদের দাবি, ওই সব আবেদনকারীদের অধিকাংশই শাসকদলের ‘ঘনিষ্ঠ’।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্তারা জানাচ্ছেন, অন্যের কাঁচা বাড়িকে নিজের বলে দেখিয়ে বহু মানুষ ওই প্রকল্পের জন্য আবেদন করেছিলেন। ভুয়ো নথি দিয়ে সরকারি তালিকায় নাম তোলার অভিযোগও রয়েছে। প্রশাসনের রিপোর্টে আরও একটি তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। অন্য ব্যক্তির নথি, অর্থাৎ আধার কার্ড বা ১০০ দিনের জব কার্ড জমা দিয়ে সরকারি বাড়ি হাতানোর চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ! জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় জেলায় এমন প্রায় আট হাজার নাম কম্পিউটারে ধরা পড়েছে। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘সমীক্ষায় উঠে আসা অযোগ্য প্রাপকদের নামের তালিকা আমরা আবার যাচাই করছি। কারণ, এক বার বাদ দিলে তা আবার তালিকায় ঢোকানো সম্ভব নয়। আমরা চাই না, কোনও যোগ্য ব্যক্তি বাদ পড়ুক।’’
সমীক্ষকদের একাংশের দাবি, সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পেতে বেশ কিছু উপভোক্তা নানা ‘ছলচাতুরি’র আশ্রয় নিয়েছিলেন। সমীক্ষা চলাকালীন নিজেদের পাকা বাড়ি ছেড়ে পাশের মাটির বাড়িতে গিয়ে থাকছিলেন অনেকে। জব কার্ড বা আধার কার্ড দেখতে চাইলে অন্য কাউকে পাকা বাড়িতে পাঠিয়ে সেই সব নথি আনাতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান তাঁরা। পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ব্লকের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘জব কার্ডের লিঙ্ক করানোর জন্য অন্যের জব কার্ড ব্যবহার করছিলেন কয়েক জন। এ-ও দেখা গিয়েছে, আধিকারিকেরা সমীক্ষা করতে আসছেন শুনে নিজের মোটরবাইক অন্যের খামারে রেখে দিয়েছিলেন কয়েক জন।’’ প্রশাসনের বক্তব্য, ১০০ শতাংশ বাড়ি সমীক্ষা করা হয়েছে। হয়েছে ‘সুপার চেকিং’। সেই কারণেই অযোগ্য উপভোক্তাদের এই সব কৌশল ধরা পড়ে গিয়েছে।
বিরোধীদের দাবি, চোখ কপালে ওঠার মতো ‘দুর্নীতি’ হয়েছে! যা অবস্থা, তাতে ঠগ বাছতে গিয়ে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে! সেই কারণে প্রশাসনের আধিকারিকেরা সব বাড়ি পরিদর্শনই করেননি। কোথাও কোথাও আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের পঞ্চায়েত থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে, ফর্মের ফরম্যাট অনুযায়ী পাকা বা কাঁচা বাড়ির ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছু লেখার দরকার নেই। কেবল উপভোক্তাদের ফোন নম্বর ও আধার নম্বর লিখে আনলেই চলবে।
মুর্শিদাবাদ বিজেপির জেলা সভাপতি শাখারাভ সরকারের অভিযোগ, ঘর পাওয়া তো দূর অস্ত, নাম সুপারিশ করতেই তৃণমূলের পঞ্চায়েত স্তরের নেতারা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এই ভাবে যাঁদের নাম উঠেছিল তালিকায়, তাঁদের নাম এখন বাদ যাচ্ছে। এই কারণে গ্রামে মুখ দেখাতে পারছেন না শাসকদলের নেতারা। মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে শুধুমাত্র বিজেপি কর্মী-সমর্থক বা সাধারণ মানুষের নাম বাদ যায়নি, যে সব দুঃস্থ তৃণমূল কর্মীর কাটমানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁদেরও নাম জমা দেননি দলের পঞ্চায়েত সদস্যরা। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে এই ধরনের বহু অভিযোগ উঠেছে।’’ কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি কল্লোল খাঁর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘যারা আবাস যোজনার টাকা বিভিন্ন অছিলায় আটকে রেখেছিল, তাদের মুখে এত বড় বড় ভাষণ মানায় না। মানুষকে খেপিয়ে অস্থির অবস্থা তৈরি করে প্রকল্পটাই বন্ধ করে দিতে চাইছে বিজেপি! ভুল কিছু থাকলে অবশ্যই সংশোধন করা হবে। রাজ্য সরকার স্বচ্ছ ভাবে কাজ করছে। সেই কারণেই তো অভিযোগ প্রমাণ হলে নাম বাতিল করা হচ্ছে।’’
দুয়ারে পঞ্চায়েত ভোট। গ্রামের ভোট। দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন নিয়ম করে বলছেন, এ বারের পঞ্চায়েত ভোট নির্বিঘ্নেই হবে। সেই ভোটের আগে আবাসে দুর্নীতির অভিযোগ দলকে বিড়ম্বনায় ফেলুক, স্বাভাবিক ভাবেই তা চাইছে না তৃণমূল। এ ব্যাপারে সতর্ক প্রশাসনও। অনেকের বক্তব্য, বিঘ্ন ছাড়াই পঞ্চায়েত ভোট করতে মরিয়া শাসক কোনও মতেই চাইছে না আবাস যোজনার মতো ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়ে জটিলতা বা বিতর্ক বাড়িয়ে বিরোধীদের হাতে গ্রামের আবেগকে উস্কে দেওয়ার হাতিয়ার তুলে দিতে। নিয়োগ দুর্নীতিতে জর্জরিত ঘাসফুল শিবির তাই আবাসে ‘রক্ষণাত্মক’।
শাসকদলের জেলা নেতৃত্বও স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, সরকার যে ভাবে আবাস ক্লাসে তথ্য যাচাই করছে তেমনই করুক। সেখানে দলের কেউ যাতে যুক্ত না হয়। এমনকি ‘আমার নামটা তুলে দিন’— এই কথাটাও যেন কেউ না বলেন। জেলার নেতারা মেনে নিচ্ছেন, ভুলভ্রান্তি কিছু হয়েছে। তাই এখন দলের অনেকেই নাম বাতিল করে দিচ্ছেন। কোথাও দলের জেলার নেতারাই গোপন সমীক্ষা করে তালিকায় থাকা ‘শাসক-ঘনিষ্ঠ’ অযোগ্যদের নাম খুঁজে বার করছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের এক নেতার কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে এ ভাবে ঠগ বাছাইয়ের চেষ্টার ঘটনায় দল হয়তো অস্বস্তিতে পড়বে। তবে ভবিষ্যতে তা দলের ভাবমূর্তির পক্ষেই ভাল হবে।’’
আবার শাসকদলের অন্য একটি সূত্রের দাবি, দুর্নীতির অভিযোগের জেরে নিচু স্তরের বড় অংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তা আঁচ করতে পারছেন স্থানীয় নেতারা। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এমন পরিস্থিতির মুখে পড়ে অনেকে আবাস যোজনার গোটা প্রক্রিয়া ‘বিলম্বিত’ করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। একাধিক জেলায় দলীয় স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বলে দাবি ওই সূত্রের। যদিও রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে সব কাজ। তাঁর অভিমত, আবাসে দুর্নীতির অভিযোগের প্রভাব পঞ্চায়েত ভোটে পড়বে না। মন্ত্রীর দাবি, ‘‘শাসকদল একেবারেই চাপে নেই। নিশ্চিত ভাবে, দল দলের মতো করে রাজনৈতিক বিরোধিতা করবে। তবে এটুকু বলতে পারি, মানুষকে ভুল বোঝানো হয়েছে। সেই ভুল ভাঙিয়ে সঠিকটা বোঝানোর দায়িত্ব দলের। আশা করছি, সেই কাজে আমরা সফল হব।’’
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকৃত উপভোক্তাদের তালিকা তৈরির দাবি তুলতে শুরু করেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘১৭ দফা মাপকাঠি মেনে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপভোক্তাদের নামের তালিকা করতে হবে।’’ তা না মানলে প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ করা হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। বড় আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আপাদমস্তক দুর্নীতি। সর্ব স্তরে লুট হয়েছে। কাটমানি নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি সংঘবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে নামছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির প্রধান হাতিয়ার আবাস-দুর্নীতি। কেন্দ্রীয় সরকারের এই স্বপ্নের প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়িত করা গেল না শুধু এই লুটেরাদের কারণে।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীও দাবি করেছেন, ‘‘আবাস যোজনায় এ রাজ্যে কমবেশি ১৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। যাঁদের দোতলা, তিন তলা পাকা বাড়ি আছে, শাসকদলের সেই সব নেতাদের নাম উঠেছে। আমাদের দাবি, বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অন্যায় ভাবে যাঁদের নাম তালিকায় উঠেছে, তাঁদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে এবং প্রকৃত দাবিদারদের ঘর দিতে হবে। আর অন্যায় ভাবে যাঁরা নাম তোলার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছেন, সে পঞ্চায়েত প্রধানই হোন বা বিডিও, তাঁদেরও শূলে চড়াতে হবে!’’
বিরোধীদের জবাবে রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘সিপিএম যে এখন সাধু সাজছে, বিপিএল তালিকা তৈরি হওয়ার সময়ে তাদের অনেক নেতার নাম তো সেখানে ছিল! আর বিজেপি যেখানে পেরেছে, আবাস যোজনায় নাম ঢুকিয়েছে। কোথাও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের বাবা, কোথাও বিজেপি বিধায়কের স্ত্রীর নাম আছে। তৃণমূলের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া, প্রথম তালিকাটা আগের। তখন এক রকম বাড়ি ছিল, পরে হয়তো ঢালাই ইত্যাদি হয়ে একটু ভাল হয়েছে।’’ শাসকদলের মুখপাত্র কুণালের সংযোজন, ‘‘যা-ই হোক না কেন, আবাস যোজনার তালিকা যাতে স্বচ্ছ ভাবে হয়, রাজ্য সরকার সেটা দেখছে।’’