ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং ভারতের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য রাশিয়া-চীন-পাকিস্তান (আরসিপি) ত্রিদেশীয় অক্ষকে নিস্ক্রিয় করা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় চীন ক্রমাগত তার সামরিক ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক নিয়মের পরোয়া না করে জোরকরে দখল করা কিংবা পুনরুদ্ধারকৃত দ্বীপগুলিতে সামরিক নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে চীন। যা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি সহ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী কৌশলগত অংশীদার দেশগুলির জন্য বাধা সৃষ্টি করছে। আরসিপি অক্ষ শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয় বরং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলির জন্যও উদ্বেগের কারন। ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বকে তাই উভয় দেশের রক্ষা কৌশল হিসাবে ধরা যেতে পারে।
ভারত এই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তৃতীয় ভিত্তিগত স্থায়ী সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে চলেছে।
ভারত ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ সামঞ্জস্য ও নিরাপত্তা চুক্তি বা কমুনিকেশনস্ কমপ্যাটিবিলিটি এন্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সি ও এম সি এ এস এ)[Communications Compatibility and Security Agreement (COMCASA)] সহ লজিস্টিকস্ এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট (এল ই এম ও এ)[Logistics Exchange Memorandum of Agreement (LEMOA)] –এই দুই ভিত্তিগত স্থায়ী সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু ভূ-অবস্থানগত সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন বেসিক এক্সচেঞ্জ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টে(বি ই সি এ)[Basic Exchange and Cooperation Agreement(BECA)]। তৃতীয় চুক্তি স্বাক্ষর এখনো বাকি। আমেরিকা থেকে আধুনিক অস্ত্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলি আনতে একটি দেশকে এই তিনটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন করে শুরু হওয়ার কারনে তৃতীয় সামরিক চুক্তির দ্রুত স্বাক্ষরিত হবার গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। পররাষ্ট্র নীতি ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা আরসিপি অক্ষটিকে আঞ্চলিক শান্তির জন্য বড় চিন্তার বিষয় বলে মনে করছেন। এই কারণে চুক্তিটির দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে সব রকমের প্রচেষ্টা চালাতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
ভারত ২০১৬ সালে LEMOA তে আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক হার্ডওয়্যার পেতে গেলে COMCASA চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়। উভয় দেশ এখনো পর্যন্ত তৃতীয় ভিত্তিগত স্থায়ী সামরিক চুক্তি BECA তে চুক্তিবদ্ধ না হলেও, শীঘ্রই এবিষয়ে আলোচনা শুরু করবে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
বিগত বছরে ভারতীয় ও মার্কিন সামরিকবাহিনী পাঁচটি প্রধান মহড়ায় ও ৫০ টিরও বেশি সামরিক বিনিময়ে অংশগ্রহণ করে ২০১৬ সালের এল ই এম ও এ চুক্তিকে কার্যকর করেছে। এই চুক্তি উভয় দেশকে সামরিক সরবরাহ ও মেরামতের জন্য একে অন্যের সুবিধা প্রদানে সাহায্য করবে।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সামরিক সম্পর্ক বিপন্ন হবার আশঙ্কার পাশাপাশি মার্কিন সামরিক বাহিনীর কাছে নিজেদের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রকাশ পাওয়ার ভয়ের কারণেই দীর্ঘদিন ধরে চুক্তিটি আটকে ছিল।প্রায় দশ বছর ধরে মুলতুবি থাকার পর, গত বছর COMCASA চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ফলে সংবেদনশীল মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম পেতে ভারতের সুবিধা হবে। পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী (এনএসজি)[Nuclear Suppliers Group (NSG)] -তে ভারতের সদস্য লাভের জন্য দুই দেশ এক সাথে কাজ করবে বলেও অঙ্গীকার করেছে। ২০১৬ সালে আমেরিকা তাদের “প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার” হিসাবেও ভারতকে মনোনীত করেছিল।
পারমাণবিক অস্ত্র, ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং সামরিক হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ভারতসহ দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির জন্য উদ্বেগের বিষয়। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মত অন্যান্য কৌশলগত অংশীদারদের সাথে ভারতকে অবশ্যই যুক্ত হতে হবে সহযোগিতামূলক নিরাপত্তা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে।
ভারত ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার সাথে দীর্ঘ কূটনৈতিক, সামরিক সম্পর্ক উপভোগ করেছে। কিন্তু নতুন দিল্লির কাছে চীন-পাকিস্তান অক্ষটি বর্তমানে উদ্বেগের কারন এতে কোনো দ্বিমত নেই। লাগাতর সন্ত্রাসকে মদত দিয়ে চলা অক্ষটিকে তাই অপরাজেয় মনে হচ্ছে। সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে ভারতের প্রয়োজনীয় গোপন তথ্যগুলির সুবিধা কেবল বেসিক এক্সচেঞ্জ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টে(বি ই সি এ) স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের জন্য এই চুক্তিটি তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পাকিস্তান ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল সহ প্রায় সমগ্র এশিয়া জুড়ে চীন এর বিস্তারের প্রভাবকে প্রতিহত করতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গত দশ বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের একটি মূল উপাদান।
এছাড়াও সুরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত অংশীদার দেশ গুলির সাথে সুরক্ষা পরিসরের সমস্যাকে যৌথ ভাবে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি যৌথ সামরিক অপারেশন পরিকল্পনা; গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি; সৈন্যদের সাথে যৌথ অনুশীলন ও কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ এবং যোগাযোগ সমন্বয় কে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।
ভারত তার অবস্থান তুলে ধরে নিজের জন্য উপকারী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়েছে। এল ই এম ও এ(LEMOA) এবং সি ও এম সি এ এস এ(COMCASA)-র মতো মৌলিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা মজবুত হয়েছে। মার্কিন-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত বি ই সি এ[Basic Exchange and Cooperation Agreement(BECA)] চুক্তির প্রয়োজন। এটা স্পষ্ট যে মার্কিন-ভারত কৌশলগত অংশীদারিত্ব ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারতকে তার লভ্যাংশ পরিশোধ করছে। মার্কিন-ভারত প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তিনটি চুক্তি একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। ইনফরমেশন সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (আইএসএ)Information Security Agreement (ISA) ভারতকে অন্যান্য দেশের সাথে মার্কিন প্রযুক্তি ভাগ করা আটকাবে। অপরদিকে বিইসিএ-র মাধ্যমে সামরিক ও অসামরিক উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ভারত ও মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তথ্য বিনিময় সহজতর হবে।