সুপ্রাচীন কাল হতে ভারতে সার্জারী বা শল্যবিদ্যার প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে। বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারী, চোখের ক্যাটারেক্ট অপারেশন ও দাঁতের সার্জারীতে। রাজায় রাজায় যুদ্ধজনিত বৰ্ণনাতীত শারীরিক জখম এবং সামাজিক প্রয়োজন ও প্রণো এর বিকাশের দু’টো মুল কারণ। অন্যূন আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন নগরী কাশী তথা বর্তমান বারাণসীতে বসবাসরত মেডিক্যাল থিওলজিয়ান তথা চিকিৎসা বিষয়ক তাত্ত্বিক এবং প্র্যাকটিসিয়ান সুশ্রুত তাঁর রচিত ‘সুশ্রুত সংহিতা’য় অন্ততঃ সার্জারীর সাতটি বিভাগ উল্লেখ করেন। কেটে বাদ দেওয়া (এক্সিশন), কোন একটা অংশকে দাগ এ পরিণত করা (স্কারিফিকেশন), ছিদ্র করে দেয়া (পাংচারিং), একটা অঙ্গে ঢুকে পরখ করে দেখা (এক্সপ্লোরেশন), টেনে বের কর ফেলে দেয়া (এক্সট্রেকশন), একটি অংশ খালি করা পরিষ্কার করা (ইভাকুয়েশন), এবং সেলাই করা (সিউচারিং)। এই গ্রন্থে আরো রয়েছে রাইনোপ্লাস্টি নামক নাকের অপরাশেন। সার্জারীকে তৎকালে বলা হতো শস্ত্রকর্ম, এবং এটা আয়ুর্ব্বেদের আটটি শাখার একটি। সুশ্রুত সার্জারী খুব পরদর্শী ছিলেন এবং এই বিষয়টিকে একটা আ পরিণত করেছিলেন। রাইনোপ্লাস্টি তথা প্লাস্টিক সার্জারীর প্রথম ধারণা তাঁরই অবদান। তৎকালে যুব এবং সামাজিক শাস্তি বিধানে নাক কাটার ঘটনায় জনসমক্ষে যে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতো তা থেকে এই রাইনোপ্লাস্টির উৎপত্তি। আজকালকার যুগেও এই ‘নাক কাটা গেছে’ বা ‘নাক খত দেওয়া’ ইত্যাদি কথা প্রচলিত আছে। এছাড়া ক্যাটার্যাক্ট বা চোখে মোতি হলে তা ফেলে দেয়াও তাঁর আবিস্কৃত। আজকের দিনের মতো হাজার হাজার বছর আগেই তিনি প্রতিটি অপরারেশন প্রক্রিয়ায় তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ ও সৃষ্ঠ ধাপগুলো মেনে সুশৃঙ্খলভাবে তা সম্পন্ন করতেন।
স্বভাবতঃই তাঁর অপারেশনের সাফল্যের হার বেশ উঁচু ছিল এবং তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর রোগীরা ছিযেন দেশ ও বিদেশ উভয় স্থানে।
: পরবর্তী সময়েও এমন প্লাসটিক সার্জারির ঘটনা ঘটেছিল। হয়তো সেগুলো ততও প্রাধান্য পায় নি ইতিহাসে। তবে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা ভীষণ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। সেই ইতিহাস ই আজ বলব।
1792 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং মহীশূরের টিপু সুলতানের মধ্যে তৃতীয় অ্যাংলো-মহীশূর যুদ্ধের সময়, কর্ণাটকের সেরিঙ্গাপটমে সুলতান কর্তৃক বন্দী হন কাওয়াসজি, একজন পার্সি গরুর গাড়ি চালক এবং অন্য চারজন ব্রিটিশ সৈন্য। সেইসময় বর্বর ইসলামিক উপায়ে, অপমানের চিহ্ন ও শাস্তি হিসাবে তাদের নাক কেটে ফেলা হয়।। প্রায় এক বছর ধরে, এই সকল ব্যক্তি সৈন্যরা নাক ছাড়াই জীবন যাপন করছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন পুনার পেশোয়া দরবারে একজন ব্রিটিশ মন্ত্রী স্যার চার্লস ওয়ার ম্যালেট নাকে একটি সূক্ষ্ম দাগসহ একজন তেলবস্ত্র ব্যবসায়ীকে দেখতে পান। বণিককে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি উত্তরে বলেন যে , ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে তার নাক কেটে ফেলা হয়েছিল এবং পরে পুনা কুমোর তাঁর কপালের চামড়া ব্যবহার করে পুনরায় নাকটি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। ব্যবসায়ী কখনই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি যে তাঁর উল্লিখিত ঘটনাটি এমন এক শৃঙ্খল তৈরি করবে যা বিশ্বব্যাপী নাক পুনর্গঠনের মান হিসাবে “হিন্দু চিকিৎসা পদ্ধতি”কে পুনশ্চঃ প্রতিষ্ঠা করবে।
স্যার চার্লস তেল-কাপড়ের ব্যবসায়ীর সুপারিশকৃত কুমোরকে ডেকে পাঠালেন কাওসজী এবং অন্য চার সৈন্যের নাক পুনর্গঠনের জন্য। এই নাসিকাসাধনা শিল্প সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে চর্চা করা হয়েছিল এবং একক পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। অন্যদিকে কাওসজীর কপালের ফ্ল্যাপ নাকের পুনর্গঠনটি বোম্বে প্রেসিডেন্সির দুই ব্রিটিশ চিকিৎসক মিঃ থো ক্রুসো এবং মিঃ জেমস ফিন্ডলে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
স্যার চার্লস তেল-কাপড়ের ব্যবসায়ীর সুপারিশকৃত কুমোরকে ডেকে পাঠালেন কাওসজী এবং অন্য চার সৈন্যের নাক পুনর্গঠনের জন্য। এই নাসিকাসাধনা শিল্প সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে চর্চা করা হয়েছিল এবং একক পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। অন্যদিকে কাওসজীর নাকের পুনর্গঠনটির ঘটনা বোম্বে প্রেসিডেন্সির দুই ব্রিটিশ চিকিৎসক মিঃ থো ক্রুসো এবং মিঃ জেমস ফিন্ডলে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
অপারেশনের পরে, রোগীকে 5-6 দিন তার পিঠ উপরে করে শুয়ে থাকতে হয়েছিল। দশম দিনে, কাপড়ের টুকরোগুলি নাকের ছিদ্রে পর্যাপ্তভাবে খোলা রাখার জন্য দেওয়া হয়। এই শল্য চিকিৎসা পদ্ধতি সফল হয়েছিল, এবং নতুন নাক প্রায় এক প্রাকৃতিক নাকের অনুরূপ ছিল। কিছুদিন পর কপালের দাগও আর দেখা গেল না।
সফল অস্ত্রোপচারের চিত্রিত কাওয়াসজীর প্রতিকৃতিটি দশ মাস পরে, 1794 সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জেমস ওয়েলস দ্বারা আঁকা হয়। 1794 সালের মার্চ মাসে, প্রতিকৃতিটি বোম্বেতে নিয়ে আসা হয়। 1794 সালের 4 আগস্ট মাদ্রাজ গেজেটে খবরটি প্রকাশিত হয় এবং 1794 সালের অক্টোবরে দ্য জেন্টলম্যানস ম্যাগাজিনের সম্পাদককে একটি চিঠিতে সিলভানাস আরবান লেখেন –
“একজন মানুষের মুখে একটি নতুন নাক লাগানোর” ঘটনা। তিনি লেখেন “খুবই কৌতূহলী চিরারজিকাল পদ্ধতি” । যে ভারতকে আমরা অশিক্ষিত বলি সেই ভারতে বংশ পরম্পরায় যা প্রচলিত ছিল তা সভ্য ইউরোপীয়দের কাছে অজানা ছিল।
জানুয়ারী 1795 সালে, অস্ত্রোপচার পদ্ধতি “একটি একক অপারেশন” হিসাবে প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত প্রবন্ধের পাশাপাশি কাওয়াসজীর প্রতিকৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। 1795 সালের এপ্রিলে, “মালবার উপকূলের স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা কৃত্রিম নাক সরবরাহের পদ্ধতির হিসাব” শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, ভারতীয় পদ্ধতির আধিপত্য দাবি করে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওয়ার্ডের (কোয়াসজির কমান্ডিং অফিসার) সাথে বিশদ আলোচনার পর, ব্রিটিশ সার্জন, জে.সি. কার্পু, 1814 সালে দুইজন রোগীর উপর সফলভাবে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেন এবং 1816 সালে তার গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। পদ্ধতিটি “ভারতীয় পদ্ধতি” হিসাবে ইউরোপে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর থেকে অনেক পরিবর্তন সত্ত্বেও, পদ্ধতিটি সময়ের পরীক্ষায় সফল হয়েছে এবং এটি আজও নাক পুনর্গঠনের সেরা পদ্ধতি।
দ্য জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিনে অনুনাসিক পুনর্গঠনের প্রকাশনা এবং পরে কার্পু আধুনিক প্লাস্টিক সার্জারির ভিত্তি স্থাপন করে। “ভারতীয় পদ্ধতি” সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে এবং প্লাস্টিক সার্জারির জন্মস্থান হিসাবে ভারতকে স্বীকৃতি এনে দেয়।
প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম নীতিগুলি সুশ্রুত তাঁর গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতাতে 600 খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্ণনা করেছিলেন এবং 11 শতকে আরব, পারস্য এবং মিশরে ভ্রমণ করে আরব ইবনে আবি উসাইবিয়াতে অনুবাদ করেছিলেন; যাইহোক, পশ্চিমা বিশ্ব এটি সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল অনেক পরে। সুশ্রুত 300 টিরও বেশি অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি এবং প্রায় 120টি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি (তার সমস্ত আবিষ্কার) বর্ণনা করেছেন।
উদ্ভিদ-উত্পাদিত, 57টি প্রাণী-উত্পাদিত এবং 64টি খনিজ-উত্পাদিত ওষুধের কথাও বলেন। ওষুধগুলি পাউডার, ডিস্টিলেটস, ক্বাথ, মিশ্রণ, জেল আকারে উত্পাদিত হয়েছিল। তিনি 24 ধরণের স্বস্তিক, 2 ধরণের স্যান্ডাস (প্লিয়ার), 28 ধরণের সূঁচ এবং 20 ধরণের ক্যাথেটারের কথা বলেছেন। সুশ্রুত ছয়টি হাড়ের স্থানচ্যুতি এবং হাড়ের 12 ধরণের ফাটল ছাড়াও 14 ধরণের ব্যান্ডেজের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বইয়ে কানের ২৮টি এবং চোখের সঙ্গে যুক্ত ২৬টি রোগের কথা বলা হয়েছে।
যদিও কাওসজী ব্রিটিশ প্রকাশনা, চিত্রকর্ম এবং খোদাইতে অমর হয়েছিলেন। শল্যচিকিৎসক যার দক্ষতা কাওসজীকে প্রায় স্বাভাবিক নাক দিয়েছিল এর মাধ্যমে অলক্ষিত হয়ে গেছিলেন।
: ব্রিটিশরা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল যে তারা তাদের সৈন্যদের ভাল যত্ন নিয়েছে। শল্যচিকিৎসকের নাম গোপন করে তারা নিশ্চিত করেছে যে ভারত যেন তার যথাযথ স্বীকৃতি না পায়।
কেসটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি চিকিৎসা ইতিহাসের কয়েকটির মধ্যে একটি যেখানে রোগী সার্জনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। যাইহোক, ইভেন্টটি এখনও প্লাস্টিক সার্জারির উত্স হিসাবে ভারতের সঠিক স্বীকৃতি এবং এর সম্মান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। আজকের প্লাস্টিক সার্জারির বিপরীতে, এটি প্রাচীন ভারতে কখনই সুপারফিসিয়াল কসমেটিক সার্জারির কথা ছিল না। এটি সর্বদা গুরুতর বিকৃতির চিকিত্সার বিষয়ে ছিল।
আজও, কোভিশিল্ডের মতো ভারতীয় ভ্যাকসিন সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষকে বাঁচাতে চলেছে।
Source :
https://m.facebook.com/groups/419166349367441/permalink/849972769620128