আর্জেন্টিনা বলতে অধিকাংশ বাঙালী ল্যাটিন আমেরিকার দরিদ্র বা আন্ডারডেভেলপড দেশগুলির একটি ভাবে। যারা ফুটবলে সমৃদ্ধ ইউরোপিয়ান কলোনিস্টদের প্রতিস্পর্ধী।
আর্জেন্টিনার ইতিহাস ভূগোল এবং অর্থনীতি- ইউরোপের থেকে সমৃদ্ধ।
১৯২০-৪০ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ছিল পৃথিবীর সপ্তম ধনী দেশ। বৃটেন, কানাডা, আমেরিকার সাথে তখন প্রতিযোগিতা। স্পেইন, ফ্রান্স ইটালির থেকে অনেক এগিয়ে অর্থনীতিতে। শুধু তাই না। আর্জেন্টিনা ১৯৪০ সালের মধ্যেই ৯০% সাক্ষরতা অর্জন করেছে। রাজনৈতিক ভাবেও দেশটি এত এগিয়ে ছিল-বিংশ শতাব্দির শুরুতে ইউরোপিয়ান ভাগ্যন্বেশীদের প্রথম চয়েস ছিল আর্জেন্টিনা। আমেরিকা না। এই জন্য আর্জেন্টিনার জনগনের মধ্যে ইউরোপিয়ান পূর্বপুরুষ % ইউ এস এর থেকেও বেশী। বেসিক্যালি আর্জেন্টিনা সমস্ত সূচকে ইউরোপ এবং ইউ এসের প্রতিদ্বন্দী ছিল এককালে। ল্যাটিন আমেরিকার অন্যদেশগুলি আর্জেন্টিনার থেকে প্রায় ৫০-১০০ বছর পিছিয়ে ছিল। আর্জেন্টিনাতে স্থানীয় নেটিভ এবং ব্ল্যাক জনসংখ্যাও নগন্য। ইউ এস এর থেকে অনেক কম। এখন বোধ হয় ফ্রান্স, ইউ কের থেকেও কম। যার জন্য আর্জেন্টিনা টিমের সবাই সাদা ইউরোপিয়ান।
আর্জেন্টিনা ইউরোপের এক্সটেন্ডেড অংশ চিরকাল। নাৎসি পার্টির লোকজন এখানে পালিয়ে এসেছিল এইজন্যেই। এককালে আর্জেন্টিনার পার ক্যাপিটা ইনকাম ফ্রান্সের থেকে ৫০% বেশী ছিল। কেন এখন এমন নেই ? আর্জেন্টিনার সেই বামপন্থী ইতিহাস সবার জানা উচিত। )যেখানেই বামেরা ক্ষমতায় যাবে, সেখানকার অর্থনীতি ধ্বংস হবে। এটা মহাজাগতি সূত্র।
আর্জেন্টিনার উন্নতি কারন ছিল- এর লিব্যারাল গণতন্ত্র -১৮৭০-১৯১০ সাল পর্যন্ত। যেখানে ধনতান্ত্রিক বিকাশের আদর্শ পরিবেশে শিল্পায়ন বাণিজ্যায়ন হয়। এই সময় জনসংখ্যা বাড়ে ৫ গুন। অর্থনীতি বেড়েছিল ১৫গুন। ফলে আর্জেন্টিনা পৃথিবীর সপ্তম ধনী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। স্কিল্ড ইউরপিয়ান ইমিগ্রেশনের ঢল নামে।
কিন্ত একটা দেশ শিক্ষিত এবং সমৃদ্ধ হলে, সাথে সাথে তাদের বামপন্থী মানসিকতা বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সাল থেকেই আর্জেন্টিনাতে প্রগ্রেসিভ বাম রাজনীতির উদ্ভব। ১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনার বামপন্থীরা ক্ষমতা দখল করে। লেবার পার্টির জুয়ান পেরন প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি আর্জেন্টিনার কলকারখানা, ব্যাঙ্কের ন্যাশানালাইজেশন শুরু করেন।
একটা দেশের অর্থনীতি ন্যাশানালাইজ করলে, সরকার বিজনেস করলে সেই দেশের কি হাল হবে, তা প্রতিটা ভারতীয়, এবং বিশেষত বঙ্গবাসীরা ভালোই জানেন। বাই দ্যা ওয়ে আর্জেন্টিনার শিক্ষা এবং চিকিৎসা কিন্ত চিরকালই সরকারি ছিল। তাতে অর্থনীতির ক্ষতি হয় না। বরং তাতে ক্যাপিটালিজমের ভাল হয়। মুশকিল হয় যখন ব্যাঙ্ক, কারখানা, ট্রেন-ইত্যাদি সব কিছু সরকার চালানোর চেষ্টা করে।
এই পেরন ভদ্রলোক হচ্ছেন আর্জেন্টিনার জ্যোতি বোস। দ্বায়িত্ব নিয়ে দেশটাকে জ্যোতি বোসের মতন ডুবিয়েছিলেন। উনি আর্জেন্টিনাতে বামপন্থা এতই জনপ্রিয় করেছিলেন বলতে গেলে আর্জেন্টিনার প্রায় সব সরকার প্রধানই ছিল [ যদি না মিলিটারি ডিক্টেটর না হয়] পেরনিস্ট। মানে যে পেরন থেকে প্রেরনা পেয়েছে আর কি।
তবে বর্তমানে আর্জেন্টিনা আবার উঠছে। কারন এই দেশের ন্যাচারাল রিসোর্স, শিক্ষা, ম্যানপাওয়ার সবই আছে। এবং তারাও বামেদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে শুরু করেছে গত দশ বছর ধরে।
আরেকটা ছোট ট্রিভিয়া। মারাদোনা যতই ফিদেলের ট্যাটু করান না কেন, পশ্চিম বঙ্গের মতন, আর্জেন্টিনাতেও বামপন্থা বাতিলের খাতায়। বর্তমানে দক্ষিন পন্থী উদার অর্থনীতির পার্টি [ আলবার্টো ফার্নান্ডেজ ] ক্ষমতায়।
১৯৮৬/৯০ এর আর্জেন্টিনা ছিল নেহেরুর ভারতের মতন। যে দেশটা দীর্ঘদিন বামপন্থা এবং মিলিটারি জুন্টার ক্ষমতা দখলের লড়াই এর জাঁতাকলে- আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছিল। এককালের ধনী দেশ ক্ষয়িষ্ণু এক শক্তিতে পরিনত তখন।
১৯৩০ সালে যখন জুলে রিমে কাপ শুরু হয়, তখন আর্জেন্টিনা পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। ওই কাপের ফাইনালেও আর্জেন্টিনা খেলেছে, কিন্ত হেরেছে উরুগুয়ের কাছে। আসল সত্য হল ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডের বাইরে যে দেশটা সবার আগে ফুটবল শিখেছে, তার নাম আর্জেন্টিনা। তখন ব্রাজিল আর্জেন্টিনার তুলনায় পিছিয়ে থাকা একটা গরীব দেশ! আর্জেন্টিনা ইউরোপের থেকেও এক সমৃদ্ধ ধনীদেশ ১৯০০ সালের শুরুর দিকে।
অনেকেই হয়ত জানেন না- ইংল্যান্ডের বাইরে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ হয় ১৯০২ সালে। আর্জেন্টিনা বনাম উরুগুয়ে।
ইংল্যান্ডে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত রাগবি এবং ফুটবল একই খেলা ছিল। ইউনিভার্সিটি টিমগুলো খেলত। হাত এবং পা দিয়ে। শেফিল্ড ফুটবল ক্লাব সবার প্রথমে ১৮৭৩ সালে ফুটবলকে আলাদা করে শুধু পা দিয়ে খেলা শুরু করে। ১৮৭৭ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং এর প্রথম ফুটবল খেলার নিয়মগুলো লিপিবদ্ধ হয়।
ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য কেন ফুটবলের জন্ম? কারন দুটো। তখনো ক্লাব কালচার আসে নি। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বহু। ইংল্যান্ডের সরকার এবং জনতা মনে করতেন, না খেলাধূলো করলে, ছেলেরা মেয়ে হয়ে যাবে (!) । ইংল্যান্ড তখন পৃথিবীশ্বর। সারা পৃথিবীতে রাফ এন্ড টাফ অফিসার সাপ্লাই করা দরকার-যারা ভারতীয়দের মতন অধীনস্থ প্রজাদের ওপর ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে ছড়ি ঘোরাতে পারবে। এই সব অফিসারদের সাপ্লাই লাইন কেম্ব্রিজ, অক্সফর্ড ইটন সহ ইংল্যান্ডের সব বিশ্ববিদ্যালয়। এবং এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা যাতে রাফ এন্ড টাফ হয়ে তৈরী হতে পারে, তার জন্য আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। তবে সেই খেলাটা হত হাত এবং পা দিয়ে। গোলপোষ্ট থাকত না। এখনকার আমেরিকান ফুটবল হচ্ছে সেই খেলার উত্তরসূরী।
১৮৭৭ সালে রাগবী এবং ফুটবল আলাদা হল। আলাদা হল মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুর্নামেন্টে হাত দিয়ে আর পা দিয়ে খেলাকে আলাদা খেলা বলে নথিভুক্ত করা হয়। পা দিয়ে খেলাটাকে বলা হল ফুটবল। হাত দিয়ে হল হ্যান্ডবল। আর আগের ফর্মাট হাত এবং পা দিয়ে খেলাকে বলা হল রাগবি। আমেরিকা এসব মানে নি। তারা আগের ওই হাত এবং পা দিয়ে খেলা, গোলপোষ্ট বিহীন খেলাটাই চালিয়ে গেছে। সেটাই এখন আমেরিকান ফুটবল এবং আমেরিকার জনপ্রিয়তম খেলা।
যাইহোক ফ্রান্স সহ ইউরোপিয়ান কন্টিনেন্ট, বৃটিশ কলোনি ছাড়িয়ে ১৯০২ সালের মধ্যে-ফুটবল খেলা আবিস্কারের মাত্র ২০ বছরের মধ্যে কিভাবে আর্জেন্টিনা উরুগুয়েতে ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হয়? তখন ও ব্রাজিল পিছিয়ে পড়া একটা দেশ। সেখানে ফুটবল কেউ খেলে কিনা কেউ জানত না!
এর কারন আগেই বলেছি- ১৮৭০ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ইউরোপের লোকেরা আর্জেন্টিনাতে পাড়ি জমাত ভাগ্যের খোঁজে। কারন আর্জেন্টিনা তখন ইউরোপের থেকেও উন্নত অর্থনীতির। ফলে তারাই খেলাটা ওখানে নিয়ে যায়। আর্জেন্টিনাকে সবাই ইউরোপের দেশ হিসাবেই ভাবত। ইউরোপের রাজনীতি দর্শন সংস্কৃতি-ফলত খেলা-যা লেটেস্ট হচ্ছে সব কিছুই সবার প্রথমে আসত আর্জেন্টিনাতে।
রাগবি খেলা-মানে এখনকার আমেরিকান ফুটবল-এটার কয়েক শতাব্দির আঁতুর ঘর উত্তর ফ্রান্স এবং দক্ষিন ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড রাগবি ছেড়ে ফুটবলে মন দিলে ফ্রান্স ও অনুসরন করে। ফিফা প্যারিসেই তৈরী হয়। তবে ফুটবলের জন্ম যেহেতু ইংল্যান্ডে, এবং এটি বৃটিশ খেলা হিসাবেই পরিচিত ছিল- ফ্রান্সে ফুটবলের এক্সেপ্টান্স, জনপ্রিয়তা এত দ্রুত আসে নি। যা এসেছিল আর্জেন্টিনাতে। ১৯০২ সালে ইংল্যান্ডের বাইরে দুটিই আর্ন্তজাতিক ম্যাচ হয়। যার একটি খেলেছে উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা। এই দুটি ছিল পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিংশ শতাব্দির শেষে দিকে ফ্রান্স ফুটবল বিশ্বের অমিত শক্তিধর হিসাবে উদ্ভব হলেও ফুটবলের প্রথম লগ্নে ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানী-এরাই ছিল মূলশক্তি। ইনফ্যাক্ট ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম ফুটবল শক্তি।
যাইহোক, ২০২২ সালের আর্জেন্টিনা আলাদা। তারা সবে বামপন্থী রাহু থেকে “প্রায় ( সেনেট এখনো বামেদের দখলে) মুক্ত। দেশের গণতন্ত্র এখন সুস্থির। উদারপন্থী ক্যাপিটালিজমের জন্য আর্জেন্টিনার অর্থনীতি এখন উর্ধগগনে ওড়ার চেষ্টা করছে। আর্জেন্টিনাতে জনপ্রতি জমির পরিমান ৭ হেক্টর-যার মধ্যে ৬ হেক্টর আবাদি। এটা আর্জেন্টিনার বিশাল এডভান্টেজ। রাজনীতি সুস্থির হলেই দেশটা সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যায় সব দেশকে পেছনে ফেলে। বিংশ শতাব্দির শুরু তার সাক্ষী-যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল আর্জেন্টিনা থেকে আসত। ইউরোপের অন্যদেশগুলিতে ফুটবল শুরু হওয়ার আগে, ফুটবল শুরু হত আর্জেন্টিনাতে।
সেখানে ফ্রান্স এখন ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশিক শক্তি। যদিও ফুটবলের শক্তিতে আজকে তারাই এগিয়ে। আমি বাজি রাখছি আর্জেন্টিনার পক্ষে। এই আর্জেন্টিনা এখন রাজনীতির কুম্ভীপাক মুক্ত সেরা হওয়ার স্বপ্ন দেখা আর্জেন্টিনা। তাদের স্বপ্ন আজকে সফল হোলো।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : বিপ্লব পাল