৯-কারের বিলোপসাধন প্রসঙ্গে কিছু আত্মগত কথা

ঌএমন একটি ব্যাকরণ রচনা করা সম্ভব যে যাকে প্রকৃতার্থে বিশ্বের সাধারণ ব্যাকরণ বলা যাবে, কারণ বিশ্বের প্রতিটি ভাষাই কোন না কোন ভাবে একটি সূত্রে বাঁধা আর তা হল মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সামর্থ্য। বাস্তবিকও তাই, বাক্যে যাকে আমরা “কর্তা” বলি সেই “কর্তা” সব ভাষাতেই “কর্তা” অর্থাৎ তিনিই সেই বাক্যের ক্রিয়া সম্পাদনের নায়ক। কেবল সেই কর্তাকে নানা সংজ্ঞা বা টেকনিকাল টার্মে বা নাম ধরে ডাকা হয়। এই চিন্তা থেকেই ঐ বৈশ্বিক সাধারণ ব্যাকরণ এর কল্পনা। যার দ্বারা সব ভাষার ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে বলে বিশ্ববিশ্রুত ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কি মনে করেন। সেই চিন্তা থেকে তিন দশক ধরে তিনি কাজ করলেন, তার পর একবার আক্ষেপ করে বললেন যে “স্প্যারোন্ত”(কৃত্রিমভাবে তৈরি করা আদর্শ ভাষা) আদি কূহকে পরিণত হয়েছে, গত তিন দশক ধরে আমরা পণ্ডশ্রম করলাম। অথচ এই কাজটি আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে কোন এক ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিক করে রেখেছেন। তাঁর কাজের কণামাত্রও আমরা করে উঠতে পারিনি। তিনি পাণিনি, যার শব্দানুশাসন বাস্তবিক অর্থে একটি “কমন ওয়ার্ল্ড গ্রামার” কেবল তার থেকে সংস্কৃত ভাষার উদাহরণটিকে সরিয়ে নিয়ে যেকোনো ভাষা বসিয়ে দিলেই তার জন্য এই ব্যাকরণ যথাযোগ্য।

এই গৌরচন্দ্রিকার কারণ এই যে – সম্প্রতি নিজের সন্তানের পাঠ্যপুস্তক দেখে হতবাক হয়েছি। আমি তাকে যে বর্ণসমাম্নায় কণ্ঠস্থ করিয়েছি, তা এই পুস্তকের সঙ্গে সাযুজ্যমান নয়। ঔ শিশুপাঠ্য পুস্তকটিতে ঌ-কার একেবারেই অনুপস্থিত। তাহলে কি এই ঌ-কার অপ্রয়োজনীয়? অথচ আমি নিজেই এইতো সেদিন শৈশবে ঌ-কার যেন ডিগবাজি খায়… ইত্যাদি দুলে দুলে কণ্ঠস্থ করেছি।

কেন হঠাৎ বর্ণসমাম্নায় থেকে একটি বর্ণকে বাদ দেওয়া হল, এটি যেন ছেলে খেলা! বলতে গেলে এটি একটি পুরাতন রোগ। হঠাৎ করে আমরা কোন বর্ণকে জুড়ে দিলাম, অথবা হঠাৎ মনে হল এটা অপ্রয়োজন একে বাদ দাও। জুড়ে দেওয়ার উদাহরণ থেকেই শুরু করি- বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মনে হল যে ‘ৎ’ (খণ্ডত বা ত্) বলে একটি বর্ণের সংযোজন প্রয়োজন। প্রসঙ্গত সেটি (‘ৎ’) কখনই একটি সম্পূর্ণ অক্ষর নয়, স্বর বর্জিত ত, অথবা বলা যায় সুদ্ধ ত ব্যঞ্জন। এমন কি ‘ক্ষ’ বলে একটি সংযুক্ত অক্ষর কে সংযুক্ত করা হল। যেটি ক্+ষ্+অ এর সম্মিলিত রূপ। এর সপক্ষে কেউ বলতেই পারেন যে বহুল ব্যবহার জন্য প্রাথমিক বর্ণমালায় স্থান প্রাপ্ত হয়েছে। এখানে কোনো উত্সাহী ছাত্র প্রশ্ন করতেই পারে যে- তবে ‘ষ্ণ’ ‘জ্ঞ’, ‘প্ত’, ‘ক্ত’ এর মত সংযুক্ত অক্ষর গুলি কি দোষ করলো। তারা কেন বাদ পড়লো? চতুরতার সঙ্গে এটিকে একটি উদাহরণমাত্র বলে পাস কাটিয়ে যাওয়া যেতে পারেন। কিন্তু ‘ৎ’ (খণ্ডত বা ত্) প্রসঙ্গে কি যুক্তি ? – সেটিও কি উদাহরণমাত্র। অথবা বর্ণমালায় একটি বিশেষ লেখন শৈলীর আগমনকে স্বীকৃতি দেওয়া হল অথবা অন্য কিছু ?

এবার আসা যাক অপসারণ প্রসঙ্গে। এটিও সদ্য ঘটে চলা বিকৃতির উদাহরণ মাত্র। যেখানে বলা হলো যে ঌ-কার নাকি ব্যাকডেটেড। তার প্রয়োগ হয় না, তাই তা শেখানোর দরকার নেই, ওটি বোঝা মাত্র।

শেখানোর দরকার নেই অথবা আছে এটাই এক্ষণে আলোচ্য বিষয়। এখানে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু প্রশ্ন এসেই যাবে যে- বর্ণমালায় স্বরবর্ণ-এর সংখ্যা নিশ্চিত ভাবে কয়টি? বর্ণমালায় ব্যঞ্জনবর্ণ-এর সংখ্যা কয়টি? আমি এই দুটি প্রশ্নে আমার জ্ঞান অনুযায়ী বক্তব্য রাখতে চাই। ভুল থাকলে সুধরেও নিতে চাই।

প্রাক্পাণিনিকালে মাহেশ ব্যাকরণ প্রচলিত ছিল, সে সময় প্রক্রিয়া ক্রমেই পাঠদান করা হত, তখন অ-কারাদি ক্রমেই বর্ণসমাম্নায় বা বর্ণমালার পাঠদান করা হত। সে সময়কার ঋক্প্রাতিশাখ্যে বর্ণমালায় ৫০ টি বর্ণকে গ্রহণ করা হয়েছিল (১৩টি স্বর, ৩৩টি ব্যজ্ঞন, তিনটি অযোগবাহ বর্ণ নিয়ে)। ঋক্-তনন্ত্রে বর্ণমালায় ৫৭ টি কে গ্রহণ করা হয়েছিল। শুক্লযয়ুর্বেদপ্রাতিশাখ্যে ৬৫টি। তৈত্তরিয় প্রতিশাখ্যে ৬০টি। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতার শ্রীধরটীকায় ৬৩টি । শঙ্করাচার্য প্রপন্নসারতন্ত্রে বর্ণমালায় ৫১ টি কে গ্রহণ করেছিলেন (১৬টি স্বর, ২৫টি ব্যজ্ঞন, ব্যাপক বলে আবশিষ্ট ১০টি)। লৈকিক বর্ণমালার সংখ্যা মোটামুটি ভাবে বলাযায় – স্বর ১৩ টি, ব্যঞ্জন ৩৩ টি, অযোগবাহ ৬ টি।

বস্তুত কেবল ‘অ’কারের মোট সংখ্যা আঠারোটি। যে গুলি হল – হ্রস্ব, দর্ঘ, প্লুত এই তিনটি প্রত্যেকটি -উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত ভেদে নয়টি তারাই আবার প্রত্যেকে নাসিক্য, অননুনাসিক্য দুই ভেদে আঠারোটি। সরবর্ণের স্থানে কেবল দুটিকে (অ, আ) গ্রহণ করলে সেই লাঘবতায় দুষিত হয়ে যায় বৈকি, বাকি ষোলটির প্রতি অন্যায় হয়, যেখানে একটি ‘অ’-কারের গ্রহণই যথেষ্ট, যার দ্বারা ১৮-টি ‘অ’কারকেই গ্রহণ করা হল – এমন ই উ ঋ এদের প্রসঙ্গেও বলা যায়, কারণ এরাও ১৮ প্রকার। ঌকার দ্বাদশ প্রকার (তার দীর্ঘ হয় না), এঐওঔ এরাও দ্বাদশ বিধ (তাদের হ্রস্ব হয় না)।

কিন্তু পাণিনি নিয়ে এলেন নতুন পথ সেখানে কোন বর্ণের সবর্ণগুলিকে যথেচ্ছ সংখ্যায় ব্যবহার বন্ধ করে একটিমাত্রের প্রয়োগ করা হল। অনেক ভাবে তাদের স্থানের পৌর্বাপর্যের অদল বদল ঘটানো হলো। সেখানে ‘অ আ, ই ঈ, উ ঊ, ঋ ৠ, ঌ ৡ ’ এদের স্থানে ‘অ ই উ ঋ ঌ’এদের একটি মাত্র কেই গ্রহণ করা হলো। তেমনি ব্যঞ্জনবর্ণগুলির ক্রমের অনেকের স্থানেই পৌর্বাপর্যের পরিবর্তন করা হলো, এবং অবশ্যই সেটা করা হলো নানান ব্যকরণের টেকনিকাল টার্ম তৈরির জন্য। এর সমর্থনে অনেক যুক্তি আছে। পাণিনির মতে – স্বর নয়টি, ব্যঞ্জন ৩৪টি মোট ৪৩ টি। যাই হোক পাণিনি প্রবর্তিত এই নতুন পথে- চতুর্দশ মাহেশ্বর সূত্র ও অচ্-আদি প্রত্যাহার ব্যবস্থা। সংস্কৃত ব্যকরণচর্চার ক্ষেত্রে যা সবথেকে জনপ্রিয়। এখানে- ‘অ ই উ ঋ ঌ এ ও ঐ ঔ’ এই নয়টি মাত্র স্বরের গ্রহণ করলেন তিনি। এবার আসা যাক আধুনিক কালের বাংলা বর্ণমালা প্রসঙ্গে ১৭৬৭তে হালেদ সাহেব (হ্যালহেড ) এর বাংলা ব্যকরণ বইয়ে ১৬টি স্বর (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৠ ঌ ৡ এ ঐ ও ঔ অং অঃ), মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের বইয়ে ঐ একই ১৬ সংখ্যা ছিল। বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২তে (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ঌ এ ঐ ও ঔ) নামালেন। রামসুন্দর বসাক এর বাল্যশিক্ষা বইটি ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয়, যাতে ১২টি স্বর গ্রহণ করা হয়। তারাচাঁদ দাসও ১২টি স্বর গ্রহণ করলেন বিদ্যাসাগরের অনুকরণে। এদের প্রত্যেকটিতেই ঌ-কারের গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি পাণিনির মত ভাষাতাত্ত্বিকেরও যাঁর এত সংক্ষেপ প্রিয়, তিনিও ঌ-কারকে ত্যাগ করতে পারলেন না। পরবর্তিকালে বিদ্যাসাগর ঌ-বর্ণকে বাদ দিয়ে ১১টি স্বরবর্ণ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ক্ষ, ব (অন্তস্থ) -দেরও ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে বাদ দিলেন সেখানে ঁ, ঃ, ঁ – এদের ব্যঞ্জনবর্ণের পাঠে গ্রহণ করলেন, সেব কথা অন্য কোথাও আলোচনা করা যেতে পারে।

প্রসঙ্গত “ঌ-কার এর বাংলা ভাষায় ব্যবহার নেই” – এই তর্কে বর্ণমালা থেকে তার বহিষ্কার করা হয়েছে পরবর্তিকালে। প্রশ্ন জাগে শিক্ষার তদানীন্তন উদ্দেশ্য এবং আজকের উদ্যেশ্যে অনেক ফারাক আছে, সে কথা ভুলে গেলে চলবে কেমন করে। যেমন হালেদ স্পষ্টকরে বলেছেন যে-

“বোধপ্রকাশং শব্দশাস্ত্রং

ফিরিঙ্গিনামুপকারার্থং

ক্রিয়তে হালেদঙ্গ্রেজী

A GRAMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE

BY NATHANIEL BRASSEY HALHED

ইন্দ্রাদয়োপি যস্যান্তং ন যযুঃ শব্দবারিধেঃ।

প্রক্রিয়ান্তস্য কৃত্স্নস্য ক্ষমো বক্তুং নরঃ কথম্।।”[1]

(অর্থাত্ ইংরেজদের উপকারের জন্য শব্দবোধপ্রকাশক শব্দশাস্ত্র রচনা করছেন হালেদ, …. ইন্দ্রাদিরাও যে শব্দবারিধির শেষ নির্ণয় করতে সামর্থ হননি, প্রক্রিয়াক্রম নির্ণয়কারী পাণিনির তুল্য ব্যাকরণ রচনা করার মত মানুষ কোথায়) সেকালে কলোনিয়ান কলকে পাবার তাড়না থাকা সত্ত্বেও কোথাও একটি স্বতন্ত্র সত্যপ্রকাশের তাগিদ দেখা যেত। আজ কোন পরাধীনতার বাঁধন না থাকলেও কোথায় যেন সেই সত্যপ্রকাশের (শব্দবোধপ্রকাশক) তাড়নাটা হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

‘ঌ’কার সন্ধির কারণে ‘ল’ হতেই পারে, সন্ধির কথা ছেড়েই দিতে হয়, কারণ অ + উ = ব হয়ে যায় তাহলে অ উ এদেরও কি বাদ দেবো। তেমনি অ+ই=এ হয়, তাই বলে কি একার কে স্বরবর্ণমালা থকে বাদ দিয়েছি কি? এমনকি ঋ-ঌ এদের সবর্ণ বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও এদের পৃথক রূপে পাণিনি বর্ণসমাম্নায়ে গ্রহণ করেছেন।

এখন মহান প্রশ্ন আসবে তবে, আদর্শ বর্ণমালা কি হবে? আমার মতে –

অ ই উ ঋ ঌ এ ঐ ও ঔ (নয়টি)– স্বর বর্ণে এরাই যথেষ্ট। অথবা অধিক পক্ষে অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৠ ঌ এ ঐ ও ঔ (তেরটি) এদেরকে পর্যাপ্ত বলা যেতে পারে।

কেন এরূপ তেরটির গ্রহণ? এই প্রশ্ন উত্থাপনের আগেই ব্যাখ্যান উপস্থাপন বিধেয়- পূর্বেই উক্ত হয়েছে অ থেকে ঋ এরা আঠারো প্রকার। এবং ঌ থেকে ঔ বারো প্রকার। ঌ এর দীর্ঘ হয় না। এ থেকে ঔ এদের হ্রস্ব উচ্চারণ হয় না। কারণ একার থেকে ঔকার এরা প্রত্যেকে অন্য স্বরেদের মিশ্রণে উত্পন্ন, এরা মৌলিক স্বর নয়, এদের উচ্চারণ ক্রমও তথাবিধ। উচ্চারণ স্থান প্রয়ত্ন করণ ইত্যাদির উপরে নির্ভর করে, লাঘবতার কারণে সে আলোচনা এখানে বোধ হয় অপ্রয়োজনীয়। এখানে বরং শিশুপাঠ্যকে নিশ্চিত করা উচিত, যে শিশুর জন্য কোনটি যথার্থ পাঠ্য। তারা কন্ঠস্থ করার জন্য ১৩টিকেই পড়ুক। তবে ঌকারকে বাদ দিয়ে ১২টি নয় কেন? ঠিক যে কারণে জন্মের পরে মাতৃদুগ্ধ ও মাতৃদেশস্পর্শের এক গভীর প্রয়োজন শিশুর জন্য, এখানেও সেই একই বক্তব্য। কেননা এর পরে আবার নতুন করে ঌবর্ণের পরিচয় করালেও তা ততটা শ্রদ্ধা যুক্ত হবে না। অনেকেই সে যুক্তি মানতে চাননা, তারা ঌবর্ণের সম্পূর্ণ বর্জনের পক্ষপাতি।

এখানে প্রশ্ন জাগে তবে কি আজকাল সত্যই উত্তরকালে প্রমাণযোগ্য মুনিদের আবির্ভাব হলো? হতেই পারে, পাণিনি নিজেও বলেছেন উত্তরকালের বৈয়াকরণদের মতই প্রমাণ। দেখা যাক উত্তরকালে(বর্তমানে) কি ঘটছে ভারত সরকার এমনকি নাসাও ষষ্ঠ তথা সপ্তম জেনারেশনের সুপার কম্পিউটারের জন্য সংস্কৃত ভাষাকেই গ্রহণ করেছে। এখন কল্কে পেতে অথবা সত্যার্থেও সংস্কৃতজ্ঞান দরকার হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় উত্তরকালে যদি কম্পিউটার জানা আবশ্যিক হয়, তবে সম্ভবতঃ সংস্কৃত না জানলে পেটের ভাত জোটানো দুষ্কর হবে। অবশ্য এখন যেমন ইংরাজী না জেনে কম্পিউটার চালাতে পারি না, তেমন তার থেকে ভালো কোন স্থিতি আসবে তখন। এখন বলুন এই শিক্ষার উদ্যেশ্য কি?- সত্যলাভার্থ অথবা উদরপূরনার্থ? যেটাই হোক না কেন শিক্ষায় আমাদের মনোদ্বার উন্মুক্ত থাকুক। একটি লিপি, কেনো একটি মাত্র ভাষা শেখানোর কাজে ব্যবহারের উপযোগী বলে প্রতিপন্ন হয়ে থাকবে। কেনো সেই লিপিতে ইতরেতর ভাষাগুলি লেখার সামর্থ্য হবে না। আর যদি তা না হয়, তবে কালে তা হরিয়ে যাবে। একটি উদাহরণ দিই- আমাদের – ঙ ঞ ণ ন ম অং অঁ সাতটি নাসিক্য ধ্বনিঃ। তাদের কেবল n ও m এই দুটি নোজাল টোন। যা দিয়ে এই সবগুলিকে প্রকাশ করতে হয়। এত গুলি নাসিক্য ধ্বনিকে রোমান লিপিতে প্রকাশ করতে নাকানি-চোবানি দশা হয়। তাই তারা ডায়াক্রেটিক মার্কের আমদানি করেছে। যেমন ঙ = ṅa , ঞ = ña , ণ = ṇa , ন = na , ম = ma , অং = aṃ , অঁ = aḥ , আমরা সেখানে নিজেদের বর্ণমালা থেকে বর্ণদের ত্যাগ করে হালকা হতে চাইছি, যাকিনা মুর্খতার পর্যায় বাচি। তবে এদিকেও একটু দৃষ্টিপাত করুন।

এই যে বাদ উঠছে যে… ণ-ন, জ-য, ৰ-ব, শ-ষ-স … এসব বর্ণ গুলির একটিই গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। এর জন্য ঌ-কার পরিত্যাগকারী পক্ষ কি ঐ লাঘব পক্ষকেই অবলম্বন করবেন। সম্ভবত অনেকেই উক্তমতে দ্বিমত পোষণ করবেন। আজ এই মত বহুল ভাবে উঠে আসার পিছনের কারণও সেই একই, সংস্কৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া ও স্বরাষ্ট্রবিরধী তথা সামাজিক বিভেদকামী শক্তিকতৃক প্রবর্তীত শিক্ষানীতি দীর্ঘদীন প্রচলিত থাকা। যাঁরা সে বিষয়ে মত পোষণ করেন তাঁরা বলেন যে- আমার না জানা আমার দায় (অহঙ্কারও হতে পারে, কলঙ্কও হতে পারে) তাই বলে আমার না জানা কে আমি সত্য বলে দাবি করতে পারি না, আমি জানি বা না জানি- আমি প্রয়োগ করি বা না করি তাতে সত্য পরিবর্তিত হয়ে যায় না, অতএব শিক্ষা থাক সত্যান্বেষণের লক্ষ্যে উদার ও উন্মুক্ত। বাংলা লিপি অথবা বাংলা ভাষা ভারতের অখণ্ড সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গস্বরূপ। এতে সংযোজন বিয়োজন হতেই পারে। মানুষ কালের স্রোতে অনেক কিছু নতুন করে বলতে থাকে শিখতে থাকে, একই ভাবে ভুলতেও থাকে। কিন্তু যে স্বরাষ্ট্র, স্বসংস্কৃতি, স্বতন্ত্রতা, সভ্যতা … আমাদের এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, আশ্রয় দিয়ে রেখেছে, শিক্ষা হোক তা রক্ষার কর্তব্যে নিবেদিত, তা সে ভাষা হোক বা গণিত হোক, বিজ্ঞান হোক বা ভূগোল, ইতিহাস হোক বা দর্শন, সব বিষয়ের পাঠনের সময় সেই চরম সত্যকে ভুলে গেলে চলবে না। তাই ভাষার বর্ণমালা কেবল কতকগুলি ধ্বনির প্রকাশক মাত্র নয়, তা হল আমাদের অখণ্ড সভ্যতা, সংস্কৃতির প্রকাশক- একথা ভুলে গেলে চলবে না। যদি এমনটাই হয়, তবে আগামী দিনে কোনও বঙ্গের সন্তান “ৰালকোঽয়ং কৢপ্তঃ বিদ্যতে” (কৢপ্ত = সুসজ্জিত) বাক্যটি আর লিখতেই জানবে না। লিখতে জানবে না যে- চলতি(চলা) ক্রিয়াপদটির মূল ধাতু চেঌ, বেলতি(বেলা) ক্রিয়াপদটির মূল ধাতু বেলৢ, কেলতি(চলন) ক্রিয়াপদটির মূল ধাতু কেঌ, খেলতি(খেলা) ক্রিয়াপদটির মূল ধাতু খেঌ। বর্গীয় ৰ এবং অন্তঃস্থ ব -তো এখনই আমরা ভুলে মেরে দিয়েছি। কিন্তু সমগ্র ভারতে এই দুই ব-কারের পার্থক্য সযত্নে উচ্চারিত হয়, আমাদের গর্বের অনেক কিছুই আছে । তাই বলে দোষগুলিকে দেখবো না, এটা সত্যের অপলাপ মাত্র, ভণ্ডামি, পাখণ্ড -পাপাচার। পাণিনীয় শিক্ষায় অন্যান্য বৈয়াকরণরা এসকল বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন, হারিয়ে যাওয়া বিষয় নয় এগুলি চর্চা করলেই সব ফিরে আসে। এখন প্রসঙ্গ হলো এগুলোর প্রয়োজন কি? – সত্যার্থ বললে নাসিকা কুঞ্চন যারা করতে পারেন, তাদের জন্য বলি – রুটি-রুজির জন্য করুন আগে। ভালো দিন আসছে সংস্কৃত জানা লোকেদের জন্য, তাই বাঙালী শিশু সেই যুদ্ধে পিছিয়ে যাতে না পড়ে, তাই শৈশবেই তাদের প্রবঞ্চিত হতে দেবেন না। যে শিশু পাঠ্য পুস্তকে ঌ-কার নেই, জানবেন ঐ পাঠ্যক্রমের প্রণেতা সেই বিধ্বংসকারী চিন্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জেনে অথবা না জেনেই কেবল বাঙালীকেই নয় ভারতীয়দের ধ্বংস করতে চাইছে।

সত্যার্থের কথায় আসা যাক আমরা পরম ব্রহ্মে বিশ্বাসী। জগৎকে অখণ্ড সত্ত্বার অঙ্গরূপে জানি। সেখানে সবটাই অখণ্ডমণ্ডলের অঙ্গীভূত। সেই সত্যরূপ পরম জ্ঞানের লাভকেই আমরা জীবনের পুরূষার্থ বলে মানি। এই জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এমন কি স্বয়ং বিধাতা পুরুষ নচিকেতা, নাভানেদিষ্ট, প্রহ্লাদ, ধ্রুব – দেরকেও তা দান করতে পারেননি, তাদের তা অর্জন করতে হয়েছিল। ছাত্রীতুল্যা পরমপ্রিয়া পত্নী মৈত্রেয়ীকেও তা দান করতে পারেননি, কেবল বর্ণণা করেছেন যাজ্ঞবল্ক্য। ঋষিরা তার জ্ঞাতা হলেও তা প্রকাশ করেননি। সম্ভবত তা প্রকাশ করার সামর্থ্য কারও হয়নি, পাণিনি -আদি বৈয়াকরণরা বললেন, এই ধ্বনিই পরমব্রহ্ম। সেই জন্যই ব্যজ্ঞনযুক্ত সানুস্বর অথবা সুদ্ধ স্বরকেই অক্ষর বলা হয়। সেই অক্ষরই পরমব্রহ্ম। তাকেই লোপ ঘটানোর মতো ঋষি হয়ে গেলাম আমরা!! বটে, তা বেশ, তা বেশ !!

[1] হালেদের বাংলা ব্যাকরণ, অমিত্রসুদন ভট্টাচার্য ও নিখিলেশ চক্রবর্তী, বিজয়ন, কলকাতা, ২০০৯ (১৭৭৮ প্রথম প্রকাশের ২৩১ বছর পর দ্বিতীয় মুদ্রণ)

লেখক : ড. প্রণব বর, সংস্কৃতশিক্ষক, কালিনগর মহাবিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.