বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স। ২০১৮-র পর আবার। গত ছ’টি বিশ্বকাপে এই নিয়ে চতুর্থ বার। ইতিহাস বলছে, কোনও বারই ফ্রান্সকে সেমিফাইনালে আটকানো যায়নি। গত ২৪ বছরে যে ক’বার সেমিফাইনালে উঠেছে তারা, প্রতি বারই ফাইনাল খেলেছে। এর মধ্যে ২০০৬ বাদে দু’বার জিতেছে কাপও। এ বারও কিলিয়ান এমবাপেরা যে ভাবে খেলছেন, তাতে কাপ জেতার যোগ্য দাবিদার তাঁরা। সে ক্ষেত্রে পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জয়ের নিরিখে ব্রাজিলকে ছোঁবে ফ্রান্স। ৬০ বছর আগে এই কীর্তি গড়েছিল পেলের ব্রাজিল। ফ্রান্সের সামনে হাতছানি রয়েছে টানা দু’বার বিশ্বকাপ জেতার।
সন্দেহ নেই যে, বিশ্বকাপের আগেই ট্রফি জেতার দাবিদার হিসাবে খেলতে নেমেছিল ফ্রান্স। কিন্তু অনেকেই তাঁদের এত দূর এগোনো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তার পিছনে মূল কারণ ছিল একের পর এক ফুটবলারের চোট। বিশ্বকাপের আগে রোজই খবর ভেসে আসত, ফ্রান্সের কোনও না কোনও ফুটবলার চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছেন। বাড়তে বাড়তে চোটের সংখ্যা বিশ্বকাপের আগেই গিয়ে দাঁড়াল পাঁচে। পল পোগবা, করিম বেঞ্জেমা, এনগোলো কঁতে, প্রেসনেল কিমপেম্বেরা। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই চোট পেয়ে ছিটকে যান লুকাস হের্নান্দেস। তার পরেও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফ্রান্সের খেলা দেখে মনেই হয়নি, তাদের দলে কোনও ফুটবলারের খামতি রয়েছে। প্রত্যেক পজিশনে রয়েছেন একাধিক ফুটবলার। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলের যে দল সেরা ছিল, এই ফ্রান্স কি তাঁদের সমকক্ষ? নাকি তার থেকেও বেশি?
প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাব হোসেন এই বিশ্বকাপে প্রচুর খেলা দেখেছেন। তাঁর মতে, দু’প্রজন্মের দলেই প্রতিভার কোনও অভাব নেই। বলেছেন, “এক-এক প্রজন্মে এক-একটা দল সেরা থাকে। আমি পেলের সময়ের দলের খেলা দেখিনি। কিন্তু শুনেছি, ওদের দলে প্রচুর প্রতিভা ছিল। পেলে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হন। কিন্তু তাঁর পাশে একটা ভাভা, ডিডি, গ্যারিঞ্চা ছিল। এই ফ্রান্স দলেও সেটা দেখতে পাওয়া যাবে। এখানেও এমবাপেকে নিয়ে মাতামাতি হয়। কিন্তু আঁতোয়া গ্রিজম্যান, অলিভিয়ের জিহুদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না।”
মেহতাবের কথার সূত্র ধরেই ফ্রান্সের এই দলকে বিশ্লেষণ করার আগে ব্রাজিলের সেই দলের পরিচয় দিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে খেলার সময় পেলে নেহাতই ১৭ বছরের উঠতি ফুটবলার। কিন্তু সেই দলে ছিলেন গ্যারিঞ্চা, মারিয়ো জাগালো, নিলটন সান্তোস, ভাভা, দিদার মতো প্রতিভাবানরাও। পেলে গ্রুপ পর্বের প্রথম দু’টি ম্যাচে না খেললেও ব্রাজিলের পারফরম্যান্সে কোনও প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে কম বয়সে ব্রাজিলের হয়ে ফাইনালে গোল করে নজির গড়লেও, সেই ব্রাজিল দলের ক্ষমতা ছিল পেলেকে ছাড়াই বিশ্বকাপে জেতার। গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করা ছাড়া আর কোনও হোঁচট ছিল না ব্রাজিলের। সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে বিপক্ষ ফ্রান্স এবং সুইডেনকে পাঁচ গোল করে দেয় তারা।
যে দল ১৯৫৮ বিশ্বকাপে খেলেছিল, সেই দলের মোটামুটি সব ফুটবলারই ছিলেন চার বছর পরের বিশ্বকাপে। সঙ্গে যোগ হয়েছিল আমারিলদো, জেকিনহা, কুটিনহোর মতো নাম। সে বারেও ব্রাজিল গ্রুপের একটি ম্যাচে ড্র করে। কিন্তু নকআউটে তারা ছিল অপ্রতিরোধ্য। কেউ তাদের ধারেকাছে আসতে পারেনি। পর পর দু’বার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার নজির ছিল উরুগুয়ের। ১৯৩০ এবং ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল তারা। কিন্তু পর পর দু’বার ট্রফি জেতার নজির প্রথম তৈরি করে ব্রাজিলই। এখনও পর্যন্ত তাদেরই সেই কৃতিত্ব রয়েছে। মাঝে ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ বাদ দিলে, ১৯৭০-এ আবার বিশ্বকাপ জিতে পাকাপাকি ভাবে জুলে রিমে ট্রফি ব্রাজিলে নিয়ে যান পেলেরা। অর্থাৎ, ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০— এই ১২ বছরে ব্রাজিল দলের ধারেকাছে আসতে পারেনি কেউ। এতটাই ছিল সেই দলের ক্ষমতা।
পর পর দু’বার ট্রফি জেতার নজিরের কাছে আরও এক বার চলে গিয়েছিল ব্রাজিল। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জেতার পর ১৯৯৮-এও ফাইনালে ওঠে তারা। কিন্তু জ়িনেদিন জ়িদান নামক এক ফুটবলারের কাছে হার স্বীকার করতে হয় রোনাল্ডো নাজ়ারিয়ো, কাফুদের।
কোন ব্রাজিল দল সবচেয়ে ভাল, এ নিয়ে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই মতবিরোধ রয়েছে। অনেকেই ১৯৫৮ এবং ১৯৬২-র দলের বদলে ১৯৭০-এর ট্রফি জয়ী দলকে এগিয়ে রাখেন। সেই দলে পেলে ছাড়াও ছিলেন কার্লোস আলবার্তো, জাইজ়িনহো, টোস্টাওয়ের মতো ফুটবলার। কোচ হিসাবে ছিলেন জাগালো। দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে জাগালো ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করে ট্রফি জিতিয়েছিলেন। সেই দলে অন্তত পাঁচ জন ফুটবলার ছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকে স্ট্রাইকার হিসাবে প্রথম একাদশে থাকার যোগ্য।
কেন সেই ব্রাজিল দল সেরা ছিল? বেশ কিছু কারণ রয়েছে তাঁর পিছনে। প্রথমত, পেলের মতো ফুটবলারের উপস্থিতি। ছোট বয়স থেকেই প্রতিভার জেরে তিনি নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা এখনও পর্যন্ত ব্রাজিলের কোনও ফুটবলার পারেননি। এই বিশ্বকাপে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে রয়েছেন তিনি। কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে আসা অগণিত ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে যতটা খুশি ছিল নেমারদের জন্য, তার থেকে বেশি উদ্বেগ ছিল পেলের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে এক ঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার দলে পেয়ে যাওয়া। আগেই বলা হয়েছে ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল কোচের নাজেহাল অবস্থার কথা। তার আগেও যাঁরা কোচ ছিলেন, তাঁরাও হিমশিম খেতেন প্রথম দল গড়া নিয়ে। কাকে ছেড়ে কাকে বসাতেন? প্রত্যেকেই তো মাঠে নেমে দুরন্ত খেলে দিচ্ছেন। ব্রাজিলের খেলার সঙ্গে মিল পাওয়া যেত না আর কোনও দলের। এক কথায় শৈল্পিক ফুটবল। যেমন পায়ের কাজ, তেমনই দৌড়, তেমনই ড্রিবলিং, তেমনই জোরালো শট। বেশ কয়েক বছর পরে যে শিল্প ফিরিয়ে এনেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। তিনি নিজ গুণে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি, মারামারি না করে যে সুন্দর ফুটবলও খেলা যায়, এটা গোটা বিশ্বকে প্রথম বার দেখিয়েছিল ব্রাজিল।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে মিশেল প্লাতিনির দলের তৃতীয় স্থানে শেষ করা ছাড়া ফুটবলে ফ্রান্সের অতীত সাফল্য সে ভাবে বলার মতো নয়। তাঁদের ফুটবলের গৌরবজনক অধ্যায়ের শুরুটা ১৯৯৮ থেকেই। সে বার ফ্রান্সকে কার্যত একার হাতে ট্রফি দিয়েছিলেন জ়িদান। ট্রফি জয়ের অন্যতম দাবিদার ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ফাইনালে হেডে জ়িদানের সেই দু’টি গোল বিশ্ব জুড়ে অগণিত সমর্থকের হৃদয় ভেঙে খানখান করে দিয়েছিল। একই সঙ্গে, বিশ্ব ফুটবল জেনেছিল নতুন এক ইউরোপীয় দেশের উত্থানের কাহিনি। বিশ্বকাপের দু’বছর পরেই ইউরো জেতে ফ্রান্স। সেই একই দল। সেই একই দাপট। ২০০২-এ গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও ২০০৬-এ আবার ফাইনাল খেলে ফ্রান্স। পরের তিনটি বিশ্বকাপ বাদ দিয়ে ২০১৮-এ আবার বিশ্বকাপ ওঠে তাদের ঘরে। এ বার সব ঠিকঠাক থাকলে কাতারেও ট্রফি উঠতে পারে ফ্রান্সের হাতে।
ফ্রান্সের উত্থানের পিছনে অন্যতম বড় কারণ মনে করা হয়, সে দেশের ফুটবলে অভিবাসীদের সংখ্যা দেখে। জ়িদান নিজেই আলজেরিয়ার। প্লাতিনি ফ্রান্সকে বিশ্ব ফুটবলে পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি জন্মসূত্রে ইটালীয়। এখনকার দলের অন্যতম সেরা তারকা কিলিয়ান এমবাপের বাবা ক্যামেরুনের, মা আলজেরিয়ার। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যিনি গোল করলেন, সেই অরেলিয়েঁ চুয়ামেনির জন্ম ক্যামেরুনে। পল পোগবার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে গিনির। বহু বছর আগে ফ্রান্সে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, যেখানে ৩৬ শতাংশ ফরাসি মনে করেছিলেন, তাঁদের ফুটবল দলে অনেক বেশি অভিবাসী খেলেন। কিন্তু বাকিরা এটাও জানিয়েছিলেন, তাঁরা কোনও ফুটবলারকে জন্মের দেশ দিয়ে বিচার করতে চান না।
এর উল্টো দিকও রয়েছে। ২০২২ বিশ্বকাপে ৯টি দেশের হয়ে এমন ৩৮ জন ফুটবলার খেলেন, যাঁদের জন্ম ফ্রান্সে। চার বছর আগে সেই সংখ্যাটা ছিল ৫২। অর্থাৎ, বিশ্বের সমস্ত ফুটবল খেলিয়ে দেশে একজন না একজন ফ্রান্সের ‘প্রতিনিধি’ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই ফ্রান্সের হয়ে বরাবরই অভিবাসী ফুটবলাররা খেলেন। এটাই ফ্রান্সের অন্যতম সাফল্যের কি না সেটা তর্ক সাপেক্ষ। তবে ফ্রান্সের যুব দলের সঙ্গে যে সব কোচেরা যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের একাংশের মত, অভিবাসী ফুটবলার উঠে আসার অন্যতম কারণ তাঁদের বাবা-মারা। মার্সেই, লিয়ঁ, প্যারিসের বিভিন্ন এলাকায় অভিবাসীরা থাকেন। ছেলেমেয়েরা যাতে একটু ভাল জীবনযাপন করতে পারেন, তার জন্য ছোট থেকে ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। কালক্রমে তাঁরাই এক একজন তারকা হয়ে ওঠেন।
এই ব্যাপারটাই বেশি টেনেছে মেহতাবকে। তিনি বলেছেন, “এই দলটা টিমগেম খেলে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এমবাপেকে কড়া ম্যানমার্কিং করা হল। খেলা বের করে নিয়ে গেল গ্রিজম্যান, জিহুরা। কমপ্যাক্ট ফুটবল বলতে যা বোঝায়, এই ফ্রান্সের খেলা হচ্ছে সে রকমই। পুরোপুরি টিমগেমের উপর নির্ভরশীল ওরা। তাই কঁতে, পোগবার মতো ফুটবলার ছিটকে যাওয়া সত্ত্বেও ওরা ভেঙে পড়েনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই গতিতে গোটা দল খেলে গিয়েছে।”
ব্রাজিল এবং ফ্রান্সের মধ্যে কাকে এগিয়ে রাখা যায়। মেহতাবের সাফ জবাব, “কোন দল বড় সেটা বলার মতো সময় আসেনি। দুই প্রজন্মে দুই দলই লোককে আনন্দ দিয়েছে ভাল ফুটবল খেলে। সমর্থকরা মুগ্ধ হয়েছেন। তবে সেই ব্রাজিল দলের মতো এই ফ্রান্সও কাপ জেতার ক্ষমতা রাখে।”