স্বামী বিবেকানন্দের পথে ‘নতুন ভারত, বিজয়ী ভারত’

ভারতের দক্ষিণপ্রান্তের শেষ শিলাখণ্ডে কন্যাকুমারীতে যেখানে তিন সাগরের জলরাশি শ্রীপাদ শিলার উপর অঙ্কিত দেবী কন্যাকুমারীর চরণ ধৌত করছে, সেখানে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের ভব্য মন্দির ও স্মারক তৈরি করা হয়েছে। আজও মানুষ দর্শন করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। এই শিলাতে বসেই স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনদিন অখণ্ড সাধনা করেছিলেন। মা ভগবতীর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন— যাতে ভারত আবার নতুন উদ্যমে জেগে উঠে।
ওই স্থানে বিবেকানন্দের স্মৃতি জিইয়ে রাখার জন্য কীভাবে কাজ শুরু করা যায় তা নিয়ে অদ্ভুত ও অবিশ্বাসনীয় কাহিনি আছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক তথা তৎকালীন সরকাৰ্যবাহ একনাথ রাণাডের। মতো ব্যক্তিত্ব শুধু যে স্মারক নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন তাই নয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, শেখ আবদুল্লা ও করুণানিধির মতো বিপরীত মেরুর শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতা আদায় করেছিলেন এবং তাদের উদ্ঘাটন সমারোহে শামিল হতে রাজি করিয়েছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ সালের কথা, যখন কন্যাকুমারীতে স্থানীয় নাগরিকেরা ওই শিলাতে স্বামী বিবেকানন্দের স্মারক নির্মাণ করার জন্য সমিতি তৈরি করেছে, কিন্তু কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় তারা তৎকালীন সরসঙ্চালক শ্রীগুরুজীর পরামর্শ চান। তিনি এই পরিকল্পনার গুরুত্ব বিবেচনা করে একনাথ রাণাডেকেই এই কাজের দায়িত্ব। দিলেন। একনাথজী জানতেন এই কাজ বড়ো কঠিন। প্রথমেই তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের তদানীন্তন অধ্যক্ষ স্বামী মাধবানন্দের আশীর্বাদ নিলেন। তখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কংগ্রেসের ভক্তবৎসল। মুখ্যমন্ত্রী জানতেন ওই শিলাতে স্থানীয় চার্চের কিছু লোক মা মেরী বা সেন্ট জেভিয়ারের মূর্তি লাগাতে চাইছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন— যদিও ওই শিলার সঙ্গে স্বামীজীর সম্বন্ধ জড়িয়ে আছে, তবুও কারও মূর্তি বসাতে দেবেন না। বিবেকানন্দের মূর্তি বসানাের ব্যাপারে এটা বড়াে বাধা ছিল। একনাথজী তখনকার গৃহমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজের সব পরিকল্পনার কথা বললেন। শাস্ত্ৰীজী বললেন—পরিকল্পনা ভালাে, কিন্তু পণ্ডিত নেহরুর অনুমতি প্রয়ােজন। আপনি যদি তার সঙ্গে দেখা করতে চান তাহলে কয়েক জন সাংসদের স্বাক্ষর -সহ আবেদনপত্র নিয়ে আসুন আমি দেখা করিয়ে দেব। একনাথজী কয়েকজন নয়, সমস্ত দলের সাড়ে তিনশাে সাংসদের স্বাক্ষর-সহ আবেদনপত্র নিয়ে শাস্ত্রীজীর কাছে গেলে তিনি অবাক হন। শাস্ত্রীজীর এই পত্র পেয়ে নেহরু বললেন— অধিকাংশ সাংসদ যখন চাইছে তখন এটা দেশের সমস্ত লােকেরই ইচ্ছা।
এই খবর পত্রকার মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী ভক্তবৎসলম্ শুনে বললেন— তিনি বিবেকানন্দের মূর্তি বসানাের বিরােধী নন, কিন্তু সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত। একনাথজী বুঝে গেলেন। ভক্তবৎসলমের সঙ্গে মাদ্রাজে গিয়ে দেখা করলেন এবং অনুমতি নিলেন। এই কাজে কাঞ্চীমঠের শঙ্করাচার্য, রাষ্ট্রপতি ড. রাধাকৃষ্ণন, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মহম্মদ চাগলার মতাে মহানুভব ব্যক্তিবর্গের সাহায্য ও সমর্থন পাওয়া গেল। নেহরুর দেহাবসানের পর শাস্ত্ৰীজী ও পরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলেন। শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে একনাথজী দেখা করলেন। তিনি খুবই আনন্দ প্রকাশ করে তখনকার মতাে ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘােষণা করলেন। একনাথজীর ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই ও প্রভাবশালী। ইতিমধ্যে দ্রাবিড় নেতা আন্নাদুরাই ভেবেছিলেন সঙ্ঘের প্রচারক হিন্দু নেতা বােধহয় তার কাছে আসবে না, কিন্তু একনাথজী তার কাছে ও করুণানিধির কাছে গেলেন। সব নেতাই একটা কথা বলেছেন সঙ্ঘের সঙ্গে বৈচারিক মতভেদ থাকলেও বিবেকানন্দের কাজে তাঁরা সহযোগিতা করবেন। তারপরের প্রশ্ন— ধনসংগ্রহ। ভারতের প্রত্যেক রাজ্য একনাথজীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ৫ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা সহযোগিতা করেছে। এমনকী জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লা ও নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী তথা চার্চ পন্থী হোকিশেী সেমাও পর্যাপ্ত সহায়তা করেছেন। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি মহাসমারোহে এই স্মারক উন্মোচন করেন। করুণানিধি স্বয়ং এসেছিলেন এবং শ্রীমতী গান্ধী শুভকামনা জানিয়ে পত্র লিখেছিলেন—“এই স্মারক উন্মোচনের পর এমন কিছু কাজ করবেন যা স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নকে সাকার করতে সাহায্য করবে। একনাথ রাণাডে নতুনভাবে বিবেকানন্দ আন্দোলন সৃষ্টি করলেন ও শিলা স্মারককে মহান তীর্থে পরিণত করে। বিবেকানন্দ কেন্দ্র স্থাপন করলেন।
একনাথজীর কল্পনা ছিল, এই বিবেকানন্দ কেন্দ্র ভবিষ্যতে এক কেন্দ্রীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করবে এবং বিশ্বে হিন্দু সভ্যতার প্রসারের সহায়ক হবে। তার রূপরেখা অনুসারে দিল্লিতে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন স্থাপন করা হয় এবং বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রথম প্রমুখ হিসেবে কাজ শুরু করেছে। এই বছর ২ সেপ্টেম্বর বিবেকানন্দ কেন্দ্রের নীতি নির্ধারক কার্যকর্তাগণ ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে ‘এক ভারত, বিজয়ী ভারত’ বর্ষব্যাপী অভিযান সূচনা করেছেন। আমরা নিশ্চিত, বিবেকানন্দের শক্তি দ্বারা স্পন্দিত এই অদ্ভুত অভিযান নবযুবকদের নব উদ্যোগে ‘নতুন ভারত, বিজয়ী ভারত’ নির্মাণ করবে।
তরুণ বিজয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.