আজ থেকে ২০ বছর আগে অর্থ্যাৎ ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ গঙ্গাবক্ষে নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন বাংলা সিনেমার সর্বকালের সেরা গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বেসিক গানেরও কি নন? আসলে মাথার উপর বসে আছেন তিনি—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই ওই জায়গাটায় ওয়াক ওভার পাবেন তিনি। পুলকের জায়গা যুগ্মভাবে দ্বিতীয়। আপরজন অবশ্যই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
তুলনা থাক। আমরা বরং আজকের এই নিবন্ধে পুলক চর্চা করি। প্রিয় পাঠক, পুলক আর মান্না যে সমার্থক শব্দ এ তো আপনারা সবাই জানেন। পুলকের যত গান মান্না দে গেয়েছেন, অন্য কারওর গান মান্না দে অত গাননি। আর মান্না স্বয়ং আমাকে বলেছেন, “আরে পুলকবাবু আমার ব্যাপারে যা পজেসিভ ছিলেন তা বলবার নয়। গৌরী কিংবা শ্যামলবাবুর গান গাইলেই ওর গোঁসা। অথচ গৌরীকে দ্যাখো। কী নম্র। পুলকের ভালবাসার রাজপ্রাসাদে শুনে বলেছিল, মান্নাদা কী গানটাই না লিখেছে পুলক। অসাধারণ।“
পুলক-মান্না ম্যাজিক জারি ছিল ১৯৯৮ সালেও। তখন মান্না আর ফিল্মের গান গান না। কিন্তু গাথানি মিউজিকের শশীভাই গাথানির নাছোড়বান্দা মনোভাবের কাছে হার মেনে রাজি হতে হল ক্যাসেট করার। আর সেই সময় দুটো বা চারটে গানের রেকর্ড নয়। একবারে আটটা বা দশটা বা বারোটা। তা মান্না নিশ্চিন্ত পুলক যখন আছেন কোনও চিন্তা নেই। আর লিখলেন বটে পুলক। মৃণাল ব্যানার্জির সুরে গাইলেন মান্না—আমায় একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি। সে বছর তো বটেই পরের বছরেও সেই ক্যাসেটের বিক্রি এক নম্বরে। তবে সেই ১৯৯৮ সালের দুর্গা পুজা-ই যে পুলকের জীবনের শেষ পুজো কে জানত।
আরও একবার পুজোর আগের ঘটনা। মার্চ-এপ্রিল হবে। মান্না দে গেছেন ধানবাদে গান গাইতে। সঙ্গে গেছেন পুলক। কারণ সেই কয়লা শহরে পুলকের শ্যালিকা থাকেন। এখন গান গেয়েই সে রাতেই মান্না ফিরবেন রাজধানী এক্সপ্রসে কলকাতা। হাতে কিছু সময় ছিল। তা পুলকের অনুরোধে মান্না যেতে রাজি হলেন সেই শ্যালিকার বাড়ি। যেতে যেতে মান্নার অনুযোগ পুলককে—আরে এইচ এম ভি রোজ তাগাদা দিচ্ছে। আপনি তো এখনও গান দিলেন না। হ্যাঁ, না করে পুলক এক বাড়িতে ঢুকে কড়া নাড়লেন। দরজা খুললেন এক অসাধারণ মহিলা। এর পর যা হল
পুলক : এটা কি মুখার্জিবাবুর বাড়ি?
মহিলা : না তো। আপনাদের বাড়ির নম্বর কত?
পুলক : ২৩৩।
মহিলা : এটা তো ৩৩৩। আপনি পরের গলিটায় যান। পেয়ে যাবেন।
বাড়ি খুঁজতে ভুল হওয়ায় কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ পুলক বেরিয়েই বললেন, আপনার গান হয়ে গেছে মান্নাদা। মান্না অবাক। কাল সকালে বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব। বিকেলে দিয়ে দোব। আশ্বস্ত মান্না তখন বলছেন, যাই বলুন ভদ্রমহিলা কিন্তু দারুণ সুন্দরী। পুলকের মুখে তখন ফিচেল হাসি। সেই গানটা হল–
ও কেন এত সুন্দরী হল
অমনি করে ফিরে তাকাল
দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই
আমি তো মানুষ।
বাকিটা, বলাই বাহুল্য, ইতিহাস।
শুধু মান্না নন, হেমন্তর গলায় কম সুপার হিট গান আছে পুলকের? স্ত্রী ছবিতে মান্না দে-রই সিংহভাগ গান। হেমন্তের ভাগে পড়ল একটাই।
খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার
এই তোমাদের পৃথিবী
এর বাইরেও জগৎ আছে
তোমরা মানো না…।
কিংবা বেসিক গান–
এক মুঠো রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম
চললাম।
শ্যামল মিত্রের গলাতেও ফিল্ম কিংবা বেসিক গানের হিটের তালিকাও কম নয়।
আমি তোমার কাছে ফিরে আসব
তোমায় আবার ভালবাসব (বালুচরী)
কিংবা ধর
কোনও এক গানের পাখী
সোনার খাঁচায় বন্দী যদি হয়
সে পাখি শোনাবে যে গান
সে গান নয়তো আমার নয়।
আরতি মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ বাব বার সরব হয়েছে পুলকের কথায়।
যদি আকাশ হত আঁখি
তুমি হতে রাতের পাখি
উড়ে যেতে যেতে
আবার কোথায় দেখা হত নাকি।
কিংবা সিনেমার গান
ওগো বন্ধু আমার
আঁধার রাতে যদি এলে
হাতখানি রাখো মোর হাতে
আমি নির্ভয় তোমার হাতের ছোঁয়া পেলে (অজানা শপথ)
পুলকের লেখা হিট গানের কথা বলতে বসলে কথায় কথায় রাত কাবার হয়ে যাবে। কিন্তু কথা শেষ হবে না। বরং এখন অন্য পুলকের কথা শুনুন। হৈমন্তি শুক্লাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে গান গাইতে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ফিরে এসে প্রচণ্ড বিতর্ক। এতটাই যে হেমন্তজায়া বেলা বাড়ি থেকে প্রায় তাড়িয়েই দিলেন হৈমন্তিকে। ক্যারিয়র শেষ হওয়ার মুখে উঠতি গায়িকার। ধরলেন পুলককে। পুলক নিয়ে গেলেন মান্না দে-র কাছে। পুলকেরই লেখা দুটো গান ছিল মান্নার কাছে। সেই গান দুটোর সুরও সারা। পুলক আর মান্না নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দিয়ে দিলেন হৈমন্তিকে।
আমার বলার কিছু ছিল না
না গো
চেয়ে চেয়ে দেখলাম
তুমি চলে গেলে
এবং সেই রেকর্ডের অন্য পিঠে ঠিকানা না রেখে ভালই করেছ বন্ধু। হৈমন্তির পুনর্জন্ম হল।
তরুণ মজুমদার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। তা ভালবাসা ভালবাসা ছবিতে হেমন্তের সুর মন ভরাল তনুবাবুর। কিন্তু কন্ঠ যেন ঠিক ভাল লাগছে না। নতুন কাউকে চাইছেন তরুণবাবু। হেমন্তের ফোন গেল পুলকের কাছে। পর দিন সকালে হেমন্তকে সঙ্গে নিয়ে পুলক চলে গেলেন বিরাটিতে শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। প্রায় পাঁজাকোলে করে তুলে আনলেন তরুণ গায়ককে। খোঁপার ওই গোলাপ.. গেয়ে শিবাজি সেই যে ক্যারিয়র শুরু করলেন এখনও তা থামেনি।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর অকালে চলে গেলেন কিশোর কুমার। কুমার শানু তখন মুম্বইতে স্ট্রাগল করছেন। কিশোরকন্ঠী শানু পরের বছর তাঁর গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য ধরলেন পুলককে। পুলক লিখলেন অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার/ তোমাই জানাই প্রণাম। রাতারাতি গান হিট এবং শানুও। বাবুল সুপ্রিয় তখন গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। কিন্তু স্বপ্ন দেখেন গায়ক হওয়ার। পুলকের বাড়িতে যাওয়া আসা করেন। কিন্তু তাঁর বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না ছেলেকে চাকরি ছাড়িয়ে মুম্বই পাঠাতে। বাবাকে নিয়ে একদিন বাবুল হাজির পুলকের সালকিয়ার বাড়িতে, যার নাম সালিখা হাউস। বাবুলের বাবাকে বোঝালেন পুলক, “আপনার ছেলে ব্যাঙ্কে অন্য লোকের টাকার হিসেব রাখে। এক দিন আসবে, যেদিন আপনার ছেলের টাকার হিসেব রাখার জন্য লোক রাখতে হবে।“ পুলকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাবুলের বাবা খানিকটা নিমরাজি হয়ে মত দিলেন। বাকিটা তো আবার বলি, ইতিহাস।
এই মানুষটা লিখলেন মান্না দে-র জন্য
যখন এমন হয়
জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা
ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দি-ই
রেলের লাইনে মাথা রাখি
কে যেন হঠাৎ বলে
আয় কোলে আয়
আমি তো আছি
ভুললি তা কি
মা সে কী তুমি?
পুলকেরমরদেহ পড়ে ছিল মেডিক্যাল কলেজের মর্গের সামনে। সুপুরুষ পুলকের পেটটার মধ্যে জল ঢুকে গিয়ে সেটা ঢাউস হয়ে গেছে। এক পায়ে চটি নেই। অন্য পায়ের সুন্দর চটিটা পায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। দেখলে গা শিউরে উঠবে।
সে দৃশ্য দেখতে হয়নি মান্নাকে। তিনি তখন আমেরিকায়। পরে জিগ্যেস করেছিলাম, আপনি কি জানতেন পুলকের মনের এই কষ্টের কথা? নিরুত্তর মান্না অনেকক্ষণ চুপ। একটু পরে দেখলাম চশমাটা চোখ থেকে খুলে রুমাল দিয়ে সেটা মুছছেন।