বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ভেসে যাচ্ছে গোটা মুম্বই। অন্তঃসত্ত্বা মোনার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করতে না পেরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে কলেজের মধ্যেই প্রসব করায় র্যাঞ্চো (আমির খান)। ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর এই দৃশ্য নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়েছিল। কিন্তু জানেন কি বাস্তবেও ঘটেছিল এমন কাণ্ড? মাঝ আকাশে কাঁটা-চামচ, আঠা, কোট ঝোলানোর হ্যাঙ্গার দিয়ে হওয়া অস্ত্রোপচারে প্রাণ বাঁচে এক যাত্রীর।
ছবি: সংগৃহীত।
০২২১
ছুরি, কাঁটা-চামচ, জলের বোতল, আঠা এবং একটি কোট ঝোলানোর হ্যাঙ্গার। এ সব ‘অস্ত্রেই’ মাঝ আকাশে এক মহিলা বিমানযাত্রীর ফুসফুসে অস্ত্রোপচার করে তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের এক শল্যচিকিৎসক। তাঁর সহকারীর ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল বিমানের আর এক চিকিৎসককে।
ছবি: সংগৃহীত।
০৩২১
১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের বোয়িং বিমানে ওই মহিলার প্রাণ বাঁচিয়ে শিরোনামে উঠে এসেছিলেন স্কটিশ শল্যচিকিৎসক উইলিয়াম অ্যাঙ্গাস ওয়ালেশ। ওই অস্ত্রোপচারে ওয়ালেশকে সাহায্য করেছিলেন টম ওং নামে স্কটল্যান্ডের আর এক চিকিৎসক।
ছবি: সংগৃহীত।
০৪২১
নব্বইয়ের দশকে ওই অস্ত্রোপচারের আগে থেকেই অবশ্য চিকিৎসকমহলে বেশ নামডাক ছিল ওয়ালেশের। ফিফা বিশ্বকাপের দু’বছর আগে ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের ফুটবলার ওয়েন রুনির চিকিৎসা করেও নাম কামিয়েছিলেন তিনি। তবে মাঝ আকাশে একটি অস্ত্রোপচারেই রাতারাতি শিরোনামে উঠে আসেন ওয়ালেশ।
ছবি: সংগৃহীত।
০৫২১
’৯৫-এর মে মাসে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের বোয়িং ৭৪৭ উড়ানের যাত্রী ছিলেন ৩৯ বছরের পলা ডিক্সন। ১৪ ঘণ্টার বিমান সফরে হংকং থেকে লন্ডনগামী উড়ানের টিকিট ছিল তাঁর কাছে। বিমানে ওঠার আগেই তাঁর হাতে ব্যথা হচ্ছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
০৬২১
ওই উড়ানে পলার সহযাত্রী ছিলেন ওয়ালেশ এবং ওং। বিমানে ওঠার আগে পলার হাতব্যথার কথা শুনে ওয়ালেশরা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। পলাকে পরীক্ষা করে ওয়ালেশ এবং ওং জানিয়েছিলেন, তাঁর হাতের হাড় ভেঙেছে। সেই ভাঙা হাতে একটি স্লিং ঝুলিয়েই বিমানে উঠেছিলেন পলা।
০৭২১
পলার দাবি ছিল, বিমানবন্দরে আসার পথে তাঁর মোটরবাইকের সঙ্গে একটি গাড়ির ধাক্কা লেগেছিল। তাতেই পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন তিনি। তবে সফরে যাবেন মনস্থির করে ওই অবস্থায়ও বিমানবন্দরে পৌঁছন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৮২১
যদিও পলার ফুসফুসে অস্ত্রোপচারের পর ওয়ালেশের সন্দেহ হয়েছিল, বিমান থেকে মাঝপথে নামিয়ে দেওয়ার আশঙ্কায় গুরুতর চোট লুকিয়ে বিমানে উঠেছিলেন পলা।
ছবি: সংগৃহীত।
০৯২১
কারণ যা-ই হোক না কেন, মাটি থেকে প্রায় ৩৫,০০০ ফুট উচ্চতায় বিমান উড়তে শুরু করেছিল। বিমানে ছিলেন ৩০০ জনেরও বেশি যাত্রী।
ছবি: সংগৃহীত।
১০২১
মিনিট কুড়ি সফরের পর বুকে অসহ্য ব্যথা শুরু হয় পলার। আবারও পলার সাহায্যে এগিয়ে আসেন ওয়ালেশরা। তাঁকে পরীক্ষার পর বুঝতে পারেন, হাত ছাড়াও পাঁজরের হাড় ভেঙেছে পলার। সেই সঙ্গে তাঁর বাঁ ফুসফুস ফুটো হয়ে গিয়ে ফুসফুস এবং বুকের মাঝে অস্বাভাবিক মাত্রায় হাওয়া ঢুকে গিয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।
১১২১
অর্থোপেডিক সার্জন ওয়ালেশের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পেরেছিল, শীঘ্রই পলার ফুসফুসে অস্ত্রোপচার করে হাওয়া বার করা প্রয়োজন। ওই অবস্থায় তাঁকে বিমান থেকে নামানোও ঝুঁকির হয়ে উঠবে। কারণ, বিমান অবতরণের সময় সামান্য চাপে মৃত্যু হতে পারে পলার।
ছবি: সংগৃহীত।
১২২১
পলাকে বাঁচাতে মাঝ আকাশেই অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন ওয়ালেশ। কিন্তু অস্ত্রোপচারের ছুরি-কাঁচি তো আর সঙ্গে নিয়ে বিমানে ওঠেননি তিনি! তাই হাতের কাছে যা কিছু ছিল, সে সব দিয়েই অস্ত্রোপচার করবেন বলে ঠিক করেন।
ছবি: সংগৃহীত।
১৩২১
বিমানের ফার্স্ট এড বক্স থেকে একটি লিডোকেইন (অ্যানাস্থেটিক) এবং ক্যাথিটার পেয়ে যান ওয়ালেশ। তবে সে ক্যাথিটার ছিল প্রস্রাব বার করানোর কাজে ব্যবহারের জন্য এবং তা বেশ নরম টিউবের মতো। ফলে অস্ত্রোপচারে তা কাজে আসবে কি না, সে নিয়ে সংশয় ছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
১৪২১
অ্যানাস্থেটিক এবং ক্যাথিটার তো জোগাড় হল। কিন্তু অস্ত্রোপচার হবে কী দিয়ে? এ বার বিমানযাত্রীদের কোট ঝোলানোর হ্যাঙ্গার বাঁকিয়ে তা ওই ক্যাথিটারের ভিতরে ঢুকিয়ে সেটি শক্তপোক্ত করে তোলেন ওয়ালেশ।
ছবি: সংগৃহীত।
১৫২১
এর পর একটি জলের বোতলের খাপে ফুটো করে সেটিকে ‘চেক ভাল্ভ’ হিসাবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করে ফেলেন ওয়ালেশ। বস্তুত, ‘চেক ভাল্ভ’-এর মাধ্যমেই তরল একমুখী প্রবাহ সম্ভব।
ছবি: সংগৃহীত।
১৬২১
অস্ত্রোপচারের আগে প্রতিটি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করতে কনিয়াক (এক প্রকারের ফরাসি ব্র্যান্ডি) ব্যবহার করেছিলেন ওয়ালেশ। জোগাড়যন্ত্র সেরে শুরু হয় অস্ত্রোপচার। সে সময় কম্বল দিয়ে পলাকে ঘিরে ধরেন বিমানসেবিকারা।
ছবি: সংগৃহীত।
১৭২১
হাতের কাছে থাকা ছুরি-কাঁটা নিয়েই এ বার অস্ত্রোপচারে লেগে পড়েন ওয়ালেশ। প্রথমে পলার বুকে ফুটো করেন তিনি। তবে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি না থাকায় ওই কাটা জায়গাটি ছুরি-কাঁটা দিয়ে খুলে ধরেন ওং। ওই ফুটোয় এ বার ক্যাথিটার ঢুকিয়ে দেন ওয়ালেশ।
ছবি: সংগৃহীত।
১৮২১
পরে লন্ডনের একটি ট্যাবলেডকে ওয়ালেশ বলেছিলেন, ‘‘ফুসফুসের হাওয়া বার করতে বুকে একটি ‘নর্দমা’ তৈরি করতে হত।’’ সে দিন তা-ই করেছিলেন ওয়ালেশ।
ছবি: সংগৃহীত।
১৯২১
পলার বুকে ক্যাথিটার ঢোকানোর পর তা স্থির রাখার জন্য একটি আঠা লাগানো টেপ আটকে দিয়েছিলেন ওয়ালেশরা। এর পর ওই টিউবটির অন্য প্রান্তটি মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ঢুকিয়ে দেন। সেটি একটি ভাল্ভের মতো কাজ করেছিল। যার মধ্যে দিয়ে ফুসফুসের আশপাশের হাওয়া বেরিয়ে গিয়েছিল।
ছবি: সংগৃহীত।
২০২১
গোটা অস্ত্রোপচারটি করতে সময় লেগেছিল মোটে ১০ মিনিট। তবে তাতে প্রাণ পেয়েছিলেন পলা। অস্ত্রোপচারের পর উড়ানে খাওয়াদাওয়া করে সিনেমাও দেখেন পলা।
ছবি: সংগৃহীত।
২১২১
মাঝ আকাশে এই অস্ত্রোপচার নিয়ে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন ওয়ালেশ এবং ওং। এই ঘটনা নিয়ে তদন্ত নেমেছিল পার্লামেন্টের এক কমিটি। তাতে সাক্ষ্য দিতে গিয়েও ওয়ালেশ জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ়ের ওই বিমানে যথাযথ মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি পর্যন্ত ছিল না।