২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করেছিল বিজেপি। অনুমান করা হয়েছিল, গেরুয়া শিবিরের অপ্রতিরোধ্য সংগঠন বঙ্গে সাফল্যের মুখ দেখছে। দু’বছরের মধ্যে সে ধারণা পাল্টে গেল। দেখা গেল, ব্যক্তিগত ভাবে হারলেও সামগ্রিক ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপ্রতিরোধ্য।
এক ঝাঁক তৃণমূল নেতা নির্বাচনের আগে আগে বিজেপিতে যেতে শুরু করেছিলেন। নির্বাচনের পরে তাঁরাই নাকে খত দিয়ে তৃণমূলে ফিরে যেতে চাইলেন। লোকে বুঝে গেল উত্তরপ্রদেশ, গুজরাতে যতই সাফল্য মিলুক, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একটি ভিন্ন দল।
প্রকাশ্যে স্বীকার করুক না করুক, সমস্ত বিপর্যয় থেকেই রাজনৈতিক দল শিক্ষা নেয়। কংগ্রেস হয়তো নেয় না। কিন্তু বাকিরা নেয়। মমতা ২০১৯-এর পরে পেশাদার ভোটকুশলীর সহায়তা নিয়েছিলেন। শ্লথগতিতে হলেও মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে সিপিএম আন্তর্জাতিকতাবাদ ভুলে গিয়ে সাচ্চা বাঙালি কমিউনিস্ট দল হয়ে উঠতে চাইছে।
বিজেপির প্রধান শিক্ষা ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, তৃণমূল তৃণমূলে’। সময় লাগলেও অমিত শাহরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, নিজেদের মতো করে নেতা তৈরি করে নিতে হবে। পরপর এতগুলো ঘটনা আপাতত অসংলগ্ন। কিন্তু এর থেকে একটা সামগ্রিক চিত্র বেরিয়ে আসে।
প্রথমত, সুকান্ত মজুমদারকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি করা। সুকান্ত আগে সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। অপরিচিত মুখ। কিন্তু আরএসএস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাই গ্রহণযোগ্যতা দলের কাছে থাক বা না থাক, সাধারণের মানুষের কাছে হবে। অন্তত এটাই অঙ্ক। কিন্তু বাংলা বিজেপিতে কাঁকড়ার সংখ্যা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি।
দ্বিতীয়ত, দলের ‘পিছনের ঘর’ও সাজানোর চেষ্টা। পিছনের ঘরের বাসিন্দাদের বলা হয় ‘ব্যাকরুম বয়েজ’। তাঁরা সামনে আসনে না। কিন্তু পিছন থেকে রণনীতি তৈরি করেন। পিছনের ঘরের আবাসিকদের দেখলে বোঝা যাবে বিজেপি কোন পথে এগোতে চাইছে। সর্বাধিনায়ক হিসাবে থাকবেন সুনীল বনশল। সেই সুনীল বনশল, যিনি উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের দ্বিতীয় বারের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন। আর আছেন মঙ্গল পাণ্ডে। ভোট, বুথ ইত্যাদির বিষয়ে যিনি নীতীশ কুমারের মতো ঘুঘু রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্নাতক হয়েছেন।
বিজেপির ধারণা, বুথের অঙ্ক না শিখলে পশ্চিমবঙ্গ জেতা যায় না। মমতার সাফল্য শুধু জনপ্রিয়তার কারণে নয়, ভোটের বিজ্ঞান আয়ত্ত করাতেও। একদা সিপিএম এটা খুবই ভাল বুঝত। কিন্তু সেই সিপিএম তো আর নেই! গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যে কম ভোট পেয়েছে, তা-ও নয়। নির্বাচন কমিশনের হিসাব বলছে, তৃণমূলের থেকে বিজেপির ব্যবধান ৬০ লাখ ৬২ হাজার ৮০৭ ভোটের। তৃণমূলের যেখানে মোট প্রাপ্তি ২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৮ হাজার ২৮১ ভোট, সেখানে বিজেপির মোট প্রাপ্ত ভোট ২ কোটি ২৯ লাখ ৫ হাজার ৪৭৪। কিন্তু মানুষ ভোটপ্রাপ্তি দেখে না। গণতন্ত্রে দেখা হয় আসনসংখ্যা। এক ভোটে জিতলেও জয়। এ জন্যই রাজ্যের বুথ না বুঝলে ভোট করে কোনও লাভ নেই।
একটা সময় পর্যন্ত দেশে বুথদখলের ‘রাজধানী’ ছিল বিহার। সেই লড়াইয়ে লালুপ্রসাদ এবং নীতীশদের সমকক্ষ হওয়া কঠিন। এখন বিহারে বিজেপির যে পরিস্থিতি, তার পিছনে এটা অবশ্যই একটা কারণ যে, ওই রাজ্যে পুরোটা না হলেও বুথের রাজনীতিতে কিছুটা টক্কর দিতে পেরেছে বিজেপি। সেখানেই মঙ্গল পাণ্ডেকে বাংলায় নিয়ে আসার গূঢ় রাজনীতি। বাংলায় পদ্মে ঊষার আলো আনতে মঙ্গল সফল হবেন বলেই বিজেপির বিশ্বাস।
তৃতীয়ত, রাঁচি শহরের মেয়র আশা লাকড়াকে রাজ্যের সহ-পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া। লাকড়ার নিয়োগ বলছে, বিজেপি রাজ্যের জনবিন্যাস বুঝতে চাইছে। তারা এটা বুঝেছে যে, শহুরে শিক্ষিত বাংলার চেয়ে (যেখানে ‘হিন্দিভাষীর দল’ হিসাবে পরিচিত বিজেপির প্রবেশ তুলনামূলক ভাবে কঠিন) জোর দিতে হবে অনগ্রসর, সামাজিকভাবে বঞ্চিত গোষ্ঠীর দিকে। সংখ্যা কিন্তু এঁদেরই বেশি।
শেষ অবধি খেলা হবে কি? নাটক করে নয়, চটক দিয়ে নয়, অনেক ভাবনাচিন্তা করে অমিত শাহরা ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। পঞ্চায়েতে তার ফল পাওয়া যাবে কি না বলা শক্ত। কিন্তু বিজেপির ‘পাখির চোখ’ পঞ্চায়েত নয়, ২০২৪-এর লোকসভা।
সুকান্তর নেতৃত্বে নতুন রাজ্য কমিটি গঠনের পরেই দলের তিন চেনা মুখ প্রকাশ্যে বিরোধিতা শুরু করেন। দল তাঁদের রেয়াত করেনি। সাসপেন্ড থাকা অবস্থায় তৃণমূলে চলে গিয়েছেন জয়প্রকাশ মজুমদার। এখনও সাসপেন্ড হয়ে রয়েছেন রীতেশ তিওয়ারি। দলে থাকলেও কোনও পদে নেই সায়ন্তন বসু। সুকান্তের ‘যোগ্যতা কম’ বলে সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন দিলীপ ঘোষ। পরে ‘ভুল’ বুঝে অনেক যুক্তিও খাড়া করেছিলেন। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। দল তাঁকে ‘মুখবন্ধ’ করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠায়। দিলীপ চুপ থাকলেও তাঁর ঘনিষ্ঠেরা প্রশ্ন তোলা একেবার বন্ধ করেছেন বলা যাবে না।
শুভেন্দু অধিকারী কখনওই প্রকাশ্যে রাজ্যনেতৃত্বের বিরোধিতা করে কিছু বলেননি। যদিও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পুরভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সুকান্ত বাংলা বন্ধ ডাকার পর সমালোচনা শোনা গিয়েছিল শুভেন্দুর মুখে। সে দিন নন্দীগ্রামের এক সভায় শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘‘হঠাত্ করে ডাকা বন্ধে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। ধর্মঘটিদের অনুরোধ করব, বেলা ১২টায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে। প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দেবেন। আপনারা অবরোধ প্রত্যাহার করে নিন।’’ তবে তিনি যে রাজ্য সভাপতি হতে পারেন, এমনটাও শুভেন্দু কখনও বলেননি। কিন্তু তাঁর অনুগামীরা সম্প্রতি বলতে শুরু করেছেন, ‘‘দাদা রাজ্য সভাপতি হচ্ছেন।’’
বারবার অস্বস্তি বাড়িয়েছেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র। গত অক্টোবরে বলে দেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী ছাড়া রাজ্য বিজেপিতে কাউকে নেতা মনে করি না।’’ একই রকম অস্বস্তি তৈরি করে সম্প্রতি সায়ন্তন বিজেপির সভাপতি জেপি নড্ডাকে লেখা চিঠিতে বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন।
অস্বস্তি বাড়িয়েছেন প্রবীণ স্বপন দাশগুপ্তও। এক সাক্ষাৎকারে কারও নাম না করে তিনি বলে বসেন, ‘‘তিন নেতা (সুকান্ত, শুভেন্দু, দিলীপ) তিন ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছেন।’’ কে রাজ্য বিজেপির ‘মুখ’ হতে পারেন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘‘যিনি জনতার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়, যাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে, তিনিই মুখ।’’ অনেকেই মনে করেন, নাম না করলেও শুভেন্দুর দিকেই ইঙ্গিত ছিল স্বপনের।
বিজেপি নেতৃত্ব বোঝেন, এখনই শৃঙ্খলা ফেরাতে না পারলে নির্বাচনের ফল ২০২১-এর চেয়েও খারাপ হবে। এমনই এক আবহে বাংলার দায়িত্বে আসেন বনশল। দায়িত্ব পেয়ে প্রথম কর্মসূচিতেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাংলায় কর্মী কম, নেতা বেশি।’’ রাজ্য বিজেপির অনেকের মতে, সেই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটছে রাজ্য সভাপতি নিয়ে সম্প্রতি বনশলের রায়গঞ্জের বক্তব্যেও।
নভেম্বরের গোড়ায় তিন দিনের রাজ্য সফরে এসে শিলিগুড়ি, মালদহ এবং রায়গঞ্জে তিনটি সাংগঠনিক বৈঠক করেন বনশল। শেষেরটিতে তিনি বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বেই লড়াই হবে।’’ শুভেন্দুর নাম না নিয়েও তিনি বলেন, ‘‘কোনও এক জনের উপরে নির্ভর করে ভোটের লড়াই হবে না। দলবদ্ধ ভাবে বিজেপি লড়াই করবে। একটা টিম হিসেবে লোকসভা ভোট পর্যন্ত লড়াই চলবে এবং ভাল ফল হবে বর্তমান নেতৃত্বের মাধ্যমেই।’’
রাজ্য সভাপতির নেতৃত্বে যে লড়াই হবে, তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা আলাদা করে বলার প্রয়োজন হল কেন? রাজ্য বিজেপি নেতারা বুঝেছেন কেন। কারণ, কয়েকজনকে ‘সচেতন’ করার দরকার ছিল। বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তোলা নেতাদের সতর্ক করতেই বনশল তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই জল্পনা নিয়ে এর চেয়ে বেশি না এগনোই ভাল। এটাই বিজেপির পদ্ধতি। কারও বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করার আগে সতর্ক করা। ব্যক্তিগত ভাবে সতর্ক করায় কাজ না হলে সেটা প্রকাশ্যে আনা। এমন নজির সাম্প্রতিক কালেও দেখা গিয়েছে।
বিভিন্ন সাংগঠনিক পদাধিকারী তো বটেই, বিশেষত রাজ্য সভাপতিদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা কখনও সাদা চোখে দেখেন না পদ্মের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কারণ, কোনও রাজ্যে বিজেপি সভাপতি কে হবেন, তা ঠিক করেন দলের চার শীর্ষ পদাধিকারী। সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা প্রাক্তন সভাপতি অমিত শাহ এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষ নাম ঠিক করেন। সিলমোহর দেন নরেন্দ্র মোদী। সাধারণ ভাবে সাংগঠনিক বিষয়ে মোদী সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না। সেই সময়ও তাঁর নেই। কিন্তু রাজ্য সভাপতি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সিলমোহর দেন মোদীই। সেই সঙ্গে দরকার হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় আরএসএস নেতৃত্বের অনুমোদন। এক বছর আগে দিলীপের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্তের মনোনয়ন এ ভাবেই হয়েছিল। তাই সুকান্তকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তকেই অসম্মান করা। যা প্রথম থেকেই খোলা মনে নেননি মোদী-শাহ-নড্ডারা। সেটাই কড়া হাতে রুখতে চাইছেন বনশল।
সংগঠন একমাত্র সমস্যা নয়। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে অনেকেই বলেছেন, বিজেপির সঙ্গে বাংলার কোনও ‘আত্মিক যোগাযোগ’ তৈরি হয়নি। শুধু মোদীর নাম নিয়ে প্রচার করলে হিন্দিভাষীদের বাইরে ভোট পাওয়া শক্ত। একাধিক ঘটনাতেও দেখা গিয়েছে যে, বিজেপি বাংলার সংস্কৃতি এখনও সে ভাবে বোঝেনি।
এখন রাজ্য বিজেপির সর্বাধিনায়ক বনশল যে দলকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকেও বুঝতে চাইছেন। সেটা বোঝা গেল মালদহের বিজেপি অফিসে তাঁকে দেখে। দলীয় দফতরেই ছিল মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। ডাল, ভাত, সব্জির শেষে দেওয়া হয়েছিল মালদহের বিখ্যাত মিষ্টি রসকদম্ব। এই মিষ্টি নিয়ে মালদহবাসীর গর্বের অন্ত নেই। অতিথিরা এলে খাওয়াবেনই। বনশল হাতে নিয়ে দেখছিলেন মিষ্টিটি। জানতে চাইলেন এর নাম কী? নাম শুনে প্রশ্ন, কেন এমন নাম? এর সঙ্গে কদমফুলের দৃশ্যগত মিলের কথা জানানোর পরে ফের প্রশ্ন, এই মিষ্টি কি বাংলার সব জায়গায় পাওয়া যায়? বলা হল, না। এ রাজ্যের সব জেলায় আলাদা আলাদা মিষ্টি। নদিয়ায় সরপুরিয়া, সরভাজা বর্ধমানে সীতাভোগ-মিহিদানা, হুগলিতে জলভরা, মনোহরা এমন অনেক। বনশল বললেন, ‘‘তাই নাকি! তবে তো বাংলাকে জানতে অনেক সময় লাগবে।’’ তার পরেই সংযোজন, ‘‘আপাতত রাজনীতি নিয়ে মাস ছয়েক কোনও কথা নয়।’’ তা-ও তো বনশল সাধারণ রসকদম্ব খেয়েছেন। পোস্ত দেওয়াটা নয়!