আজ কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন (২৭/১১/১৮৮৮) । রথীন্দ্র রচিত ‘পিতৃস্মৃতি’ বইটি আজ আবার পড়বার দিন। জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই এই ‘নেপথ্যের নায়ক’-কে।

পিতৃস্মৃতি’-তে রথীর বাবার কথাই স্থান পেলো না, যুগের উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে রইলো।

‘On The Edges of Time’ — বিশ্বখ্যাত পিতাকে কীভাবে সৌকর্যের সঙ্গে উপস্থাপন করতে হয়, তার অন্যতর নিদর্শন হয়তো এ মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া যাবে না, রথীন্দ্রনাথের এই বইটি বাদ দিলে। এটিই অনূদিত হয়ে ‘পিতৃস্মৃতি’, এক অসামান্য যুগের জীবন্ত দলিল। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা।

রথীর বইখানি যে এক ঐতিহাসিক দলিল, তার একটি উদাহরণ দেবো। রথী লিখছেন, ১৮৯৬ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে প্রথম গাওয়া হয় ‘বন্দেমাতরম’। আমরা জানি, ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৮৯৪ সালের ৮ ই এপ্রিল। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের অধিবেশন। বিডন স্কোয়ারে কংগ্রেসের প্যান্ডাল খাড়া করা হয়েছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি তার খুব কাছেই। তাই ঠাকুর বাড়িতে কংগ্রেসের আয়োজন নিয়ে আলোড়ন পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের উপর ভার ছিল গানের আয়োজন করার। তাঁর উদ্যোগে চললো গানের রেওয়াজ। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরমে সুর বসিয়েছিলেন তিনি। একক সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথ গাইলেন এই গান, ১৮৯৬ সালের কংগ্রেসেই প্রথম গাওয়া হল বন্দেমাতরম গানটি। এই গানে অর্গান বাজিয়ে সঙ্গত করেছিলেন ঠাকুর বাড়ির সরলাদেবী চৌধুরানী। তখন মাইক্রোফোনের ব্যবহার আসে নি, খালি গলায় গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিপুল জনতার কানে তা পৌঁছেছিল যান্ত্রিক ব্যবহার ছাড়াই। এরকম নানান খুঁটিনাটি তথ্য বইটিকে করে তুলেছে আদ্যন্ত এক ঐতিহাসিক দলিল।

রথীন্দ্রনাথ একজন স্বনামধন্য কৃষিবিজ্ঞানী ছিলেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি ছিল। ছিলেন এক যোগ্য শিক্ষাবিদ এবং সুলেখক। তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই পুত্রকে দিয়েই শান্তিনিকেতনে শুরু করেছিলেন তাঁর স্বপ্নের আশ্রমিক বিদ্যালয়। ধীরে ধীরে বাড়লো ছাত্র ও অধ্যাপকদের সংখ্যা, আয়োজিত হল শিক্ষাদানের এক নতুন ক্ষেত্র। প্রকৃতির সামীপ্যে-সান্নিধ্যে লেখাপড়া। পিতার সমস্ত কাজকর্মের নিখুঁত ডকুমেন্টস সংরক্ষণ করিয়েছেন এই নীরব কর্মী। তাই আজ রবীন্দ্রনাথকে এত ভাবে জানতে সক্ষম হয়েছে সমগ্র বিশ্ব।রবীন্দ্র আধারকে ‘অশেষ করেছেন’ পুত্র রথীন্দ্রনাথ।

রথীন্দ্রনাথ লিখছেন শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের জমিদারি এলাকায় পিতৃবন্ধু ডি. এল. রায়ের আলু চাষের প্রচেষ্টা নিয়ে, “আমাদের দেশে তখনকার দিনে সাধারণের মধ্যে আলু খাওয়ার তেমন প্রচলন হয় নি। আলুর চাষ করতে কৃষকেরা জানত না। দ্বিজেন্দ্রলাল কৃষিবিশেষজ্ঞ ছিলেন, তিনি একবার এসে আলুর চাষ প্রচলিত করবার জন্য বাবাকে উৎসাহিত করেন। বাগানের এক প্রান্তে খেত প্রস্তুত করা হল। আলুর চাষের এটাই হবে পরীক্ষাকেন্দ্র। দ্বিজুবাবু বললেন, তিনিই বীজ পাঠিয়ে দেবেন এবং কী করে জমির পাট করতে হবে, কী সার দিতে হবে সব বিষয়ে মালীকে বুঝিয়ে দেবেন।”

কৃষিবিজ্ঞান গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি অনবদ্য ভূমিকা ছিল। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে ‘ভারতী’ পত্রিকার ৪৮ বর্ষের চৈত্র সংখ্যায় ‘বৈজ্ঞানিক কৃষিকার্য’ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সরলাদেবী। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে কৃষিচিন্তা নানানভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের উদ্যানভাবনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথও খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে জটিল কৃষি বিষয় সরল বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। ভালো বিজ্ঞান জানা না থাকলে একাজ সুসম্পন্ন করা যায় না।

রথীন্দ্রনাথ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যা পড়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও পুত্রবন্ধু সন্তোষ মজুমদারকেও বিদেশে কৃষিবিদ্যা ও গোপালন বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের নানান কর্মে তাঁর কৃষিভাবনা, পল্লীভাবনা এবং বাংলার কৃষিজীবী মানুষের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও অর্থে শিলাইদহে নতুন জাতের ধান চাষ শুরু হয়েছিল; হয়েছিল আমেরিকান ভুট্টা, নৈনিতাল আলুর চাষ; পাটনাই মটর, আখ, কপি ও রেশম চাষের প্রচেষ্টাও। কুঠিবাড়ীর চারপাশের জমিকে কেন্দ্র করে প্রজাদের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন তিনি। পতিসরে কৃষকদের ঋণ পাওয়ার সুযোগ করে দিতে কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপন করলেন। গঠিত হল তাঁত শিক্ষার কেন্দ্র। গ্রামীণ মানুষকে নিয়ে তাদের নিজেদের দ্বারা পল্লী উন্নয়নের চেষ্টা শুরু হল, হল গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ। শক্ত এঁটেল মাটি ট্রাক্টর দিয়ে চাষের বন্দোবস্ত করা হল, কৃষি ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হল, ধর্মগোলা তৈরি হল। অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিজনিত ক্ষয়ক্ষতি হলে খাজনা মুকুবের ব্যবস্থা হল। নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা পতিসরের ব্যাঙ্কে রেখে মূলধনের সমস্যা খানিকটা মেটানোর ব্যবস্থা করলেন। শাহাজাদপুরের গোপালকদের তিনি উন্নত জাতের গাভী ও চারণভূমি দান করেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন প্রকল্পেও গ্রামীণ কৃষি উন্নয়ন একটি সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, ‘আজ শুধু একলা চাষীর চাষ করিবার দিন নাই, আজ তাহার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে’ (রবীন্দ্রনাথ, ‘ভূমিলক্ষ্মী’)। এই রবীন্দ্রনাথই কৃষি ও গ্রামবিকাশের কাজে ছেলের অর্জিত বিদ্যার সহায়তা নিয়েছিলেন।

রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণের বাগান সাজিয়েছেন অসংখ্য শ্রীময়ী গাছ, ফুল, লতাপাতা দিয়ে। উদ্যানরচনা যে বিজ্ঞানচর্চার অন্তর্গত একটি শিল্প সাধনা, তা পরবর্তী ভারতীয় কৃষিবিদেরা উপলব্ধি করতে পারলেন রথীন্দ্রের দেখানো পথে। রথী ফুল আঁকতেন ভাল। ফুল বাগান রচনার ইচ্ছে যে ছোটোবেলায় ফুলের ছবি আঁকার মধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল, তা পিতাই আমাদের জানিয়েছেন, ফুল আঁকায় ছেলের কাছে হার মানতে হল।

আজ যারা বাংলাভাষা নিয়ে অনেক লম্বা চওড়া কথা বলেন, তারা ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় সমাবর্তন ভাষণের পক্ষে সওয়াল করেছেন? রথীন্দ্রনাথ কিন্তু বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্যরূপে প্রথম সমাবর্তন ভাষণটি বাংলাভাষায় দিয়েছিলেন, এটা যেন মনে রাখি। রথী এই ধারাটি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ সমাবর্তন ভাষণ দেবার আমন্ত্রণ পেলেন। রবীন্দ্র-শ্যামাপ্রসাদ দ্বৈরথে সেদিন বাংলার জয় জয়াকার হল। শ্যামাপ্রসাদ রবীন্দ্র সান্নিধ্যে এসে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাবাণী চাইলে শ্যামাপ্রসাদ বাংলাভাষায় অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন। আমরা এটাও দেখলাম, আর কখনও কলকাতাতে বাংলা ভাষায় সমাবর্তন ভাষণ দেবার বা দেওয়ানোর বুকের পাটা অর্জন করতে পারেন নি কোনো উপাচার্য। পারে নি বিশ্বভারতীও। সম্ভবত বাংলার শিক্ষারত্নরা বাংলাভাষাকে ভদ্রজনোচিত ভাষা বলে আজও মনে করেন না। তাদের “বাংলা ঠিক আসে না!” বাংলার মর্যাদা কি ব্রিটিশরা বলে দেবেন, তারপর যুবপক্ষে তা অনুসৃত হবে?

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং পিন্টু সান্যাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.