সন্তান প্রসবের ব্যথা কমাতে লাফিং গ্যাস! বড় সাফল্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের

দ্য ওয়াল ব্যুরো: স্কুলের কেমিক্যাল সায়েন্স পড়ার সিলেবাসে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের কথা সকলেই পড়েছিলাম প্রায়। নাইট্রাস অক্সাইড বলে মনে রাখতে না পারলেও, ‘লাফিং গ্যাস’ নামটা অবশ্যই মনে রেখেছেন সকলে। কিন্তু এই গ্যাসকে কাজে লাগিয়ে যে যন্ত্রণাবিহীন ভাবে সন্তান প্রসব হতে পারে, তা কে ভেবেছিল!

এমনটাই কিন্তু ঘটছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। বেশ কয়েক দিন আগে নিঃশব্দেই শুরু হয়েছিল এই পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ। এই ক’দিনের মধ্যে পরপর ২৫ জন মা সন্তানের নর্মাল ডেলিভারি করলেন, প্রসব যন্ত্রা ছাড়াই! মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, এই ঘটনা এ রাজ্যে প্রথম।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক পার্থ মুখোপাধ্যায় জানালেব, নাইট্রাস অক্সাইড (লাফিং গ্যাস) ও অক্সিজেন সমান সমান পরিমাণে মিশিয়ে রাখা হচ্ছে ডেলিভারি রুমে। সন্তান প্রসবের সময়ে মা-কে জোরে জোরে শ্বাস নিতে বলা হচ্ছে, ওই গ্যাস গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের যে অংশটি ব্যথার অনুভূতি উৎপন্ন করে, সেই অংশটি সাময়িক ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আনন্দের অনুভূতি বাড়ে। এর ফলেই প্রসবের যন্ত্রণা অনেকটা কম অনুভব করেন মায়েরা।

বছর খানেক আগেই চিকিৎসক পার্থ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের তরফে স্বাস্থ্য ভবনের অনুমতি চেয়ে আবেদন পাঠানো হয়। এর পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে সেমিনার, আলোচনাচক্র, ওয়ার্কশপও অনুষ্ঠিত হয় মেডিক্যাল কলেজে।

চিকিৎসক পার্থ মুখোপাধ্যায় টেলিফোনে বললেন, “লাফিং গ্যাস এবং অক্সিজেন সমপরিমাণে মিশিয়ে যে গ্যাস তৈরি হয়,তা এনটোনক্স নামে পরিচিত। সন্তানসম্ভবা মায়েদের যখন সন্তান প্রসবের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়, একটি সিলিন্ডার থেকে ওই গ্যাস নাকে দেওয়া হয় মাস্কের মাধ্যমে। তাতেই ফল পাওয়া গেল। আমরা ছাত্র জীবনে বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে পড়তাম। কিন্তু কাজে লাগাতে পারিনি। এখন সেই চেষ্টা সফল হল।”

কলেজের তরফে বিষয়টি স্বাস্থ্য ভবনে জানানোর পরে তাঁরা গ্রিন সিগন্যাল দেন। অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস সরবরাহকারী একটি সংস্থাকে এই গ্যাস মিশ্রণ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব দেয় সরকার।

পার্থ মুখোপাধ্যায় আরও জানালেন, এই গ্যাসের কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। ফলে মা ও সন্তানের কোনও ক্ষতি হয় না। গত এক মাসে ২৫ জন সন্তানসম্ভবাকে এই গ্যাস প্রয়োগ করে, সফল ও যন্ত্রণাহীন নর্মাল ডেলিভারি করানো হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ অন্য সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিতে চালু করার উদ্যোগ নিতে চলেছে সরকার।

১৭৭৫ সালে হামফ্রে ডেভি নামের এক জৈববিজ্ঞানী প্রথম এই লাফিং গ্যাসটি আবিষ্কার করেছিলেন। রাসায়নিক ভাবে লাফিং গ্যাস হলো নাইট্রোজেনের একটি অক্সাইড যার বৈজ্ঞানিক নাম নাইট্রাস অক্সাইড। মৃদু মিষ্টি গন্ধযুক্ত বর্ণহীন এই অক্সাইড মানুষ নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলে নাকি হাসির উদ্রেক ঘটে, ব্যথা বেদনার অনুভূতি কমে যায়। তাই একে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে লাফিং গ্যাস।

বস্তুত, লাফিং গ্যাসের কাজ করার ধারা নিয়ে মানুষের কৌতুহল দীর্ঘদিনের। গবেষণায় যত দূর জানা গেছে, প্রশ্বাসের মাধ্যমে যখন নাইট্রাস অক্সাইড গ্রহণ করা হয়, তা রক্তের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের ভিতর আমাদের মস্তিষ্কে চলে যায়। তবে এটি কিন্তু রক্তের সঙ্গে মেশে না। আর তাই মানবদেহে এর স্থায়িত্ব-ও খুব অল্প সময়ের জন্য হয়। মস্তিষ্কে গিয়ে এই নাইট্রাস অক্সাইড গ্লুটামেট রিসেপটরে একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই রিসেপটর নিষ্ক্রিয় হলে, ব্যথাবোধ থাকে না। এটি একই সঙ্গে প্যারাসিমপ্যাথেটিক গাবা রিসেপটরকে উত্তেজিত করে তোলে, যার ফলে বিশেষ নিউরো-তরল এন্ড্রোফিনের ক্ষরণ হয়। এই ক্ষরণে মানুষের হাসির উদ্রেক হয়, ব্যাথাবোধ হ্রাস পায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.