বিশ্বকাপে কলকাতা, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে কাতারে শহরের ‘আলো’

কাতারের আল বায়েত স্টেডিয়ামে দর্শকের আসনে বসে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার কথা ছিল তাঁর, কিন্তু কালের নিয়তিতে তাঁকে বোকাবাক্সের মধ্যেই খেলা দেখতে হল।সুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। হুগলির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা। ৬৬ বছর বয়সি সুবোধ কলকাতায় ট্রান্সফর্মার তৈরির একটি কারখানা ‘বিএমসি ইলেকট্রোপ্লাস্ট’-এর মালিক। কলকাতার ঠাকুরপুকুরে এই কারখানা রয়েছে তাঁর। কাতার বিশ্বকাপের সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িত। বিশ্বকাপের জন্য যে তিন হাজার ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করা হচ্ছে, তার সব-ই সুবোধের কারখানা থেকে পাঠানো।

কলকাতার রাস্তায় যে ট্রান্সফর্মার দেখা যায়, এগুলি তার থেকে আলাদা। এগুলি সুইচ গিয়ার বোর্ডের সঙ্গে লাগানো থাকে। দ্য টেলিগ্রাফকে সুবোধ বলেছেন, “এগুলির মূলত দুটো কাজ থাকে। কত পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে তা পরিমাপ করা যায় এই যন্ত্রের সাহায্যে। তা ছাড়া শর্ট সার্কিট হলে এই ট্রান্সফর্মার থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।” যন্ত্রগুলি স্টেডিয়ামের নিচে বিশেষ ঘরে রাখা থাকেন।

সুবোধ দুর্গাপুরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (তৎকালীন রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) থেকে ১৯৭৭ সালে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। কলকাতায় স্ত্রী -পুত্রের সঙ্গে থাকেন তিনি। সুবোধের এক মেয়েও রয়েছে। তিনি পুণেতে থাকেন।

সুবোধ বলেছেন, ‘‘২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বার আমি কাতার গিয়েছিলাম। চারিদিকে তখন শুধু ধুলো, মেরামতের জিনিসপত্র ছড়ানো। আর এখন স্টেডিয়াম ঘিরে কত জাঁকজমক, দেখলেই অবাক হয়ে যাই। চেনাই যাচ্ছে না।’’ বিশ্বকাপের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান দেখার পর সুবোধ বলেন, ‘‘দেখার পর এক অধিকারবোধ কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল এই স্টেডিয়াম তো আমারও। জানতাম সব ভাল ভাবেই হবে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত একটা চিন্তা ছিল।’’ ওই ‘অচেনা’ স্টেডিয়ামে বসেই খেলা দেখতে পারতেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখতে হয়। কারণ নিজেই জানিয়েছেন। ২০২১ সালে বাড়িতে পা পিছলে পড়ে যান। বাঁ হাঁটু ভেঙে যায়। তার পর থেকে ওয়াকার-ই তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী।

তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ৩ হাজার ট্রান্সফর্মার মালয়েশিয়ার টামকো সুইচগিয়ার সংস্থার মাধ্যমে কাতারে পাঠিয়েছেন। ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক এই প্রথম, তা একেবারেই নয়। ছোটবেলায় নিয়মিত মোহনবাগান মাঠে যেতেন। ফুটবলের পাশাপাশি হকিও খেলেছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধু শান্তনু মিত্রের সঙ্গে ১৯৮০ সালে এই কারখানা তৈরি করেন। বন্ধু প্রয়াত হয়েছেন। প্রায় ১০০ কর্মী কাজ করেন কারখানায়।বিশ্বকাপে তাঁর বাজি ব্রাজিল। তাঁর মতে, এটা নেমারের বিশ্বকাপ হতে চলেছে। নেমারের জীবনে নতুন মোড় আনবে এ বারের বিশ্বকাপ, অনুমান করেছেন তিনি।

আক্ষেপও আছে। বলেছেন, “আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা। সেই দিন আর নেই। দেখে খারাপ লাগে। আমরাই এর জন্য দায়ী। এটা আমাদের সমবেত ব্যর্থতা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.