কেশবচন্দ্রকে সাকার-নিরাকারের পূর্ণত্বে পৌঁছে দিয়েছিলেন যিনি।

[যে প্রতিবাদের ধরন নিয়ে যুগের প্রয়োজনে ব্রাহ্মরা হিন্দুসমাজের বৌদ্ধিক জগতে বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল রচনা করার প্রয়াস নিয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের নাব্য-স্রোত তার সমস্তটাই মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আবারও মূল সনাতনীর প্রবাহের গাঙ্গে মিশিয়ে দিল। সম্ভব হল কেশবচন্দ্রকে সম্পৃক্ত করে, জারিত করে।]

আজ শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য কেশবচন্দ্রের জন্মদিন। কারো জন্মদিন এলে তাঁকে স্মরণ-মনন করে আমরা বিশেষ ভাবনায় জারিত হই। কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম ছিলেন, আমরা জানি; ঊনিশ শতকের একজন উল্লেখযোগ্য সমাজ-সংস্কারক। আলাদা ধর্ম না হলেও হিন্দু ধর্মের মধ্যেই একটি পৃথক উপাসনা পদ্ধতিতে নিরাকারের উপাসক তিনি। তবে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে কেশবচন্দ্রের মধ্যেকার ঈশ্বর আরাধনার সাকার-নিরাকার ভেদভাব দূর হয়ে গেল। কালী-উপাসক শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বোঝালেন, যিনি ব্রহ্ম তিনিই কালী। যখন তিনি নিষ্ক্রিয়, তখন ব্রহ্ম; যখন সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন, তখন তিনি কালী। এক ব্রহ্ম উপাসকের কালী সাধকের সঙ্গে যোগাযোগ করা, মেলামেশা করা ভালোভাবে নেন নি তদানীন্তন ব্রাহ্মসমাজের মাতব্বর ব্যক্তিরা৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দর্শনে বিরোধ ছিল তাঁর। তাই কেশবকে দেখা যায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করতে এবং পরে নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সূচনা করতে। এটা ঘটনা, কেশবের সঙ্গে রামকৃষ্ণ-সামীপ্য ব্রাহ্মদের মধ্যে পরবর্তীকালে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। যে প্রতিবাদের ধরন নিয়ে যুগের প্রয়োজনে ব্রাহ্মরা হিন্দুসমাজের বৌদ্ধিক জগতে বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল রচনা করার প্রয়াস নিয়েছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণের নাব্যস্রোত তার সমস্তটাই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে আবারও মূল সনাতনীর প্রবাহের সঙ্গে মিশিয়ে দিল। কেশবচন্দ্রের থেকেই সেই পরম-সংযোগের সূত্রপাত এবং পরিপুষ্টি। রামকৃষ্ণ-কেশব সংযোগ এক অখণ্ড সাধনার সনাতনী ধারাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। অনেকেই বলে থাকেন কেশবচন্দ্রের অকাল প্রয়াণ যদি না হত, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দেবও যদি এত কম বয়সে চলে না যেতেন, তবে সেই সময় বাংলা তথা ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক চিন্তাচেতনার হরকা বানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জগতই যেত বদলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবকে বোঝালেন, ঈশ্বররূপ সমুদ্রে স্থানে স্থানে হিমশৈলরূপ বরফের জমে ওঠাই হল ঈশ্বরের সাকার রূপ। প্রখর সূর্য উঠলে যেমন বরফ গলতে শুরু করে, তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান হলে সাকারের বরফখণ্ডগুলো গলে জল হয়ে ঐশীসমুদ্রে মিশে যায়। তখন জল আর জল; সমস্তটাই জল, সমস্তটাই ঈশ্বর। ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ এই বোধ যখন আসে, এই বিচারে যখন আমরা সম্পৃক্ত হবো, তখন সমস্ত রূপ যাবে উড়ে। সেই পরম ব্রহ্মকে তখন কী দিয়েই বা ধরবো! মন-বুদ্ধি-অহং কোনোটা দিয়েই যে তাঁকে ধরা যাবে না! মুখেও বলতে পারবো না ব্রহ্মের সংজ্ঞা স্বরূপ বৈশিষ্ট্য! ব্রহ্ম তাই কখনও উচ্ছিষ্ট হন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবকে বললেন, “যে লোক একটা ঠিক জানে, সে আর একটাও জানতে পারে। যে নিরাকার জানতে পারে, সে সাকারও জানতে পারে।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, শ্যামপুকুর, তেলিপাড়া আগে না গেলে তা চিনবো কেমন করে। সাকারে প্রকৃষ্ট রূপে পৌঁছাতে পারলে নিরাকারের দর্শনও যে তিনি বুঝতে পারবেন। কিন্তু আগে সেই শ্যামপুকুরের পাড়ায় পৌঁছে যাওয়া চাই। সাকারের আরাধনা এ কারণেই, সকলে নিরাকারের অধিকারী হন না। মা যেমন পাঁচ ছেলের জন্য মাছের নানান ব্যঞ্জন রেঁধে দেন, যার পেটে যা,সয়! যার পেটের রোগ তারজন্য ঝোল, যার সব সয় তারজন্য মাছের পোলাও। ঠিক তেমনি তাঁর পথে পৌঁছাতে নানান উপাসনা পদ্ধতি।

১৮৩৮ সালে ১৯ শে নভেম্বর এই ধর্ম সংস্কারকের জন্ম কলকাতার বুকে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর চাইতে বয়সে কিছুটা বড়। ১৮৩৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৮৮৪ সালের ৮ ই জানুয়ারি তিনি প্রয়াত হন, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণ (১৮৮৬)-এর বছর আড়াই আগে।

কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.