গণিতে স্নাতক। তারপর মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক।
অতঃপর বিখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সেস, ব্যাঙ্গালোর থেকে এ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
তারপর ডক্টরেট। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, বোম্বাই থেকে।
এমন তো কতই হয়! তাই না?
হ্যাঁ, এমন শিক্ষাজীবন এদেশে বহু মানুষেরই আছে। ছিল। ভবিষ্যতেও থাকবে।
কিন্তু যে মানুষটির কথা হচ্ছে, তিনি খানিক ব্যতিক্রমী।
তাঁর পরিবারে তিনিই প্রথম স্নাতক। এরপর মাদ্রাজ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তে যাবার সময়ই পায়ে প্রথম জুতো পরতে পান ভদ্রলোক। তার আগে অব্দি খালিপদই ঘুরে বেড়িয়েছেন।
স্কুল শেষ করার পরপরই চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে। এক সপ্তাহ ভুখা অনশনও করেছিলেন এই নিয়ে। বাপের মন টলেনি।
“তুই যদি দূরের কলেজে পড়তে যাস, তবে চাষের মাঠ কি আমি একা সামলাবো? আর তোকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে গেলে আমাকে জমি বিক্কিরি করতে হয়। তুই কি চাস আমরা সবাই না খেতে পেয়ে মরি?” এই ছিল বাপের কথা।
এরপর আর কথা চলে না। ছেলেকে অতঃপর যুক্তি মেনে নিতেই হয়। সত্যিই তো, তাদের তো এই ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। তাও আবার খরার দাপটে কোনও বছর ফসল ভালো না হলে তো আর কথাই নেই! বড় ক্লাসে ওর বয়সী ছেলেরা ফুলপ্যান্ট পরে আসত। ওকে কিনা বাপের পুরোনো ধুতি পরেই কাজ চালাতে হয়!
সেই বাপই অবশ্য মতবদল করলেন একসময়। ততদিনে গণিতে স্নাতক হওয়া গিয়েছে। বাড়ির কাছেই ছিল কলেজ। রোজ কলেজ যাওয়ার আগে আর পরে চাষের মাঠে বাপকে সাহায্য করতে হয়েছে। তাঁদের তো আর আলাদা করে মুনিশ রেখে চাষ করার সামর্থ্য নেই!
তবুও বাপের মন বদলেছে।
“যা হয় হোক। তুই যখন চাইছিস তো ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েই পড়। জমি বিক্রি না হয় করেই দেব। তবে দেখ, তোকে কিন্তু চাকরি একটা জোগাড় করতেই হবে। চাষীর ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিস। আমাদের চোদ্দপুরুষে যা কেউ হতে পারেনি। তোকে আর আটকাবো না।”
সেই প্রথম বড় শহরে গিয়ে পড়ল ছেলে। এবার পায়ে জুতো উঠল। ফুলপ্যান্টও।
কুড়িয়ে বাড়িয়ে গরীবের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়েই গেল! পরিবারে স্নাতকই কেউ ছিল না, তায় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতকোত্তর!
অবশ্য জিদ থাকলে কি না হয়! জীবনে যখন যা চেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে পাননি কোনওটিই। যা পেয়েছেন, যেটুকু পেয়েছেন, তাতেই জান লড়িয়ে দিয়েছেন। সাফল্য এসেছে। গরীব প্রান্তিক চাষীর ছেলের লড়াই কখনও ব্যর্থ হয়না। হয়নিও।
মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে পাস করার পর ভেবেছিলেন হ্যাল বা ন্যালে চাকরি জুটবে। জোটেনি। তার বদলে আইআইএস ব্যাঙ্গালোরে মাস্টার্স করার সুযোগ জোটে।
ইসরোয় চাকরি পেয়ে ভেবেছিলেন কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরির প্রকল্পে তাঁকে সামিল করা হবে। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে জুটল বিক্রম সারাভাই সেন্টার।
তবে ঐ, যখন যে সুযোগ পেয়েছেন সেটিতেই পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন।
নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত ক্ষমতা ছিল। জীবনে কখনও কারো সাহায্যের মুখাপেক্ষী থাকেননি। পড়াশুনোয় কোনও প্রাইভেট ট্যুশনি, কোনও কোচিং নেওয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি চিরকালই বলতে গেলে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। কাজ করতে জানেন। কিভাবে সফল হতে হয়, তা তিনি ঠেকে শিখেছেন। দেরি হলে হবে, তবে তিনি জানেন, ধৈর্য্য ধরে পড়ে রইলে সাফল্য আসবে না এমন হতেই পারে না।
এই মানুষটি কে নিশ্চয় সকলে চিনে ফেলেছেন।
হ্যাঁ, গাঁয়ের চাষীর ছেলে তো! এত চেষ্টার পরেও চন্দ্রযান অভিযানের আশানুরূপ ফল না পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। আবেগ সাচ্চা মানুষেরই থাকে। কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে হয়ত নিজেকে আর সামলাতে পারেননি তিনি। এত পরিশ্রম, এত সময়, এত অর্থ! এত প্রত্যাশা! তিনি এই ভারতের এক প্রান্তিক চাষীর সন্তান। এ সবের মূল্য তিনি বোঝেন।
হ্যাঁ, তিনি পুজো দেন। বিজ্ঞানী হলেই যে নাস্তিক হতে হবে এমন কোনও নিয়ম তো নেই! মানুষের ধর্মবিশ্বাস তাঁর ব্যক্তিগত পরিসর। এই নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করার আগে আয়নায় নিজেদের মুখগুলো একবার দেখে নেওয়া ভালো। কত গাঁট, কত ঝুল! নিজেদের অর্জন নিজেরাই বিচার করলে মন্দ হয় না।
ডঃ কৈলাশাভাদিভু শিবন এই পবিত্র ভূমির এক আদর্শ সন্তান। তিনি আমাদের গর্ব। ব্যস, এইটুকুই বলার।
সুপ্রীতি মাইতি