দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নাম ঘোষণার আগে দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে কোথাও কোনও জল্পনা ছিল কি? না। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর নাম ঘোষণার আগে সিভি আনন্দ বোসকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোনও আলোচনা বা জল্পনা ছিল কি? অথচ তিনিই বাংলার স্থায়ী রাজ্যপাল হয়ে আসছেন।
দ্রৌপদী মুর্মুই হোন বা সিভি আনন্দ বোস— চমকের মতো এসেছে জনতার কাছে। দ্রৌপদীকে কেন রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে, তার কিছু রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ছিল। কিন্তু প্রাক্তন আমলা আনন্দকে কেন বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠানো হল, তা সঠিক ভাবে বলা শক্ত।
কেরলের এই ভূমিপুত্র কর্মসূত্রে প্রথম জীবনে কলকাতায় থেকেছেন। নামের মধ্যে বাংলার ‘নায়ক’ সুভাষচন্দ্র ‘বোস’ সংক্রান্ত মিল আছে। এ ছাড়া সাধারণ ভাবে তিনি একেবারেই অপরিচিত। যে কারণে তাঁর নিয়োগ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। সকলেই জানতে চাইছেন, কেন আনন্দকে বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠানো হল। আবার সকলেই নিজের নিজের মতো করে তার ব্যাখ্যাও হাজির করছেন।
বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী রাজ্যপাল নিয়ে আলোচনা চলছিল। বিজেপি শিবির তো বটেই, শাসকদলের কাছেও চিন্তা ছিল, নতুন রাজ্যপাল কেমন হবেন? তিনিও কি ধনখড়ের মতো ‘অতি সক্রিয়’ হবেন? রাজ্য বিজেপি সেটাই চেয়েছিল। কিন্তু তারাও আনন্দ নিয়ে বিন্দুমাত্র অবহিত ছিল না।
প্রথমত, আনন্দের নিয়োগে রাজ্যের রাজনীতিক থেকে আমলা— সকলেই বিস্মিত। বিশেষ কেউ তাঁর নাম জানতেন না। বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে আনন্দের নাম ঘোষণার পর সর্বত্র খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়। সেই সূত্রে যেটুকু জানা গিয়েছে, তা হল— আনন্দ ‘রুলবুক’ মেনে চলেন। তিনি প্রশাসন যন্ত্রকে মর্যাদা দেন। রাজনীতি নয়, তিনি চালিত হন প্রশাসনের নিরিখে। যা তাঁর পূর্বসূরি জগদীপ ধনখড়ের একেবারে বিপরীত। বস্তুত, বিজেপি নেতাদের একাংশ জানতে পেরেছেন, ধনখড় এবং আনন্দ পরস্পরের একেবারে বিপ্রতীপ অবস্থানের মানুষ। ধনখড়কে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিলে আনন্দের অবস্থান সম্পর্কে খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে।
ঘটনাচক্রে, শুক্রবার আনন্দ একটি বাংলা চ্যানেলকে বলেছেন, তিনি ‘রাজনীতিক’ মমতার সঙ্গে কাজ করতে চান না। অর্থাৎ, তিনি ‘প্রশাসনিক’ মমতার সঙ্গে কাজ করতে চান। স্পষ্টতই এমন কাউকে দিয়ে বাংলায় বিজেপির সে অর্থে কোনও ‘লাভ’ হবে না। তা হলে কেন আনন্দকে বাংলার রাজ্যপাল করে পাঠানো হচ্ছে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে কেউ কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু প্রশাসনিক আর রাজনৈতিক অলিন্দে কান পাতলে কিছু তত্ত্ব এবং ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এর কোনওটিরই আনুষ্ঠানিক স্তরে কোনও সমর্থন মেলেনি।
দ্বিতীয়ত, প্রাক্তন আমলা এবং কেরলের প্রাক্তন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব আনন্দ রাজ্যপাল হিসাবে ‘রাজনীতি’ করবেন না। তাতে ‘স্বস্তি’ পাবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধনখড় রাজ্যপাল থাকাকালীন বার বার নবান্ন এবং রাজভবনের রাজনৈতিক সংঘাত বেধেছে। তাতে অস্বস্তিতে পড়েছে শাসক তৃণমূলও। শাসক শিবিরের নেতারা অহরহ রাজভবনকে ‘রাজনৈতিক আক্রমণ’ করেছেন। বলেছেন, রাজভবন বিজেপির দলীয় দফতরে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে, বিরোধী বিজেপি রাজভবনকে তাদের দাবিদাওয়া জানানোর মঞ্চ হিসাবে বেছে নিয়েছে।
আনন্দ তেমন কিছু করবেন না বলেই মনে করছেন রাজনীতি এবং প্রশাসনের একাংশ। যা থেকে এই তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে যে, আনন্দের নিয়োগ কি তা হলে মোদী-দিদির মধ্যে একটা ‘সমঝোতা’র ইঙ্গিত বা সূচক? নবান্নের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে দাবি-করা কিছু সূত্রের তেমনই দাবি। মমতা যেমন একাধিক বার প্রকাশ্যে বলেছেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে কিছু বলবেন না, তাতে কোথাও না কোথাও একটা বার্তা পৌঁছেছে। ওই সূত্রের বক্তব্য, আনন্দ যে পটভূমিকা থেকে আসছেন, তাতে তিনি একেবারে আস্তিন গুটিয়ে ঝগড়া করতে নামবেন না।
তৃতীয়ত, সূত্রের দাবি, আনন্দকে বেছেছেন মোদী নিজে। অসমর্থিত সূত্রের আরও দাবি, আনন্দ বাংলার রাজ্যপাল হিসাবে অমিত শাহের পছন্দ ছিলেন না। ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অপর এক প্রাক্তন সচিব। কিন্তু মোদী নাকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা না-শুনে আনন্দকে বাংলার জন্য বেছে নিয়েছেন। কারণ, মোদী চান বাংলার প্রশাসনে পরিচ্ছন্নতা আনতে। প্রধানমন্ত্রী বাংলার রাজনীতির চেয়ে বাংলার প্রশাসন নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
নাম ঘোষণার পরে আনন্দ জানিয়েছেন, তিনি‘ সক্রিয় রাজ্যপাল’ হবেন। কিন্তু সেই সক্রিয়তা ‘রাজনৈতিক’ হবে না বলে মনে করা হচ্ছে না। বরং তা হবে ‘প্রশাসনিক’। নতুন রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। তিনি ধনখড়ের মতো কোনও হইহল্লা করবেন না। কিন্তু নিজের মতো করে ভিতরে ভিতরে ‘সক্রিয়’ থাকবেন।
সেই ‘সক্রিয়তা’র ব্যাখ্যাও অনেকে দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মোদী বাংলায় ‘সুশাসন’ নিয়ে চিন্তিত। এই অংশের মতে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ বা বিহার এক সময়ে কুশাসনের দোষে দুষ্ট ছিল। এখন সেখানকার আবহ বদলেছে। বিজেপি মনে করে, এখন সেই রাজ্যগুলিতে ‘সুশাসন’ চলছে। কিন্তু বাংলায় ‘অপশাসন’ চলছে। মোদী তার ‘সংশোধন’ চান। রাজ্যের প্রশাসনকে ‘স্বচ্ছ’ বানাতে চান।
বস্তুত, সামগ্রিক ভাবে বিজেপি মনে করে, পূর্ব ভারতের সামূহিক উন্নতির জন্যেই বাংলার উন্নতি প্রয়োজন। সে জন্য বাংলার প্রশাসনের উন্নতি দরকার। পূর্ব ভারতের উন্নতি না হলে তার ছাপ দেশের অন্যত্রও পড়বে। মোদীর বাছাই আনন্দ সেই বিষয়েই নজর দেবেন বলে একাংশের ব্যাখ্যা।
তবে এর বিরোধী তত্ত্বও রয়েছে। তাঁরা অবশ্য মোদীর সমালোচক। তাঁরা বলছেন, মোদীর ‘পছন্দ’ যে সব সময় ভাল এবং উপযুক্ত হয়, তা-ও নয়। উদাহরণ স্বরূপ তাঁরা বলছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে উর্জিত পটেলকে নিয়োগের ঘটনা। অথচ, তখন প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সহকর্মীরা সকলেই উর্জিতকে ওই পদে বসানোর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু মোদী অনড় ছিলেন। তার ফল কী হয়েছে, গোটা দেশ দেখেছে। শেষ পর্যন্ত অধুনাপ্রয়াত অরুণ জেটলিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামতে হয়েছিল। তিন বছরের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই পদত্যাগ করেন উর্জিত। আর প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়, ‘‘উনি নিজেই ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করতে চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমাকে চিঠিও লিখেছিলেন।’’ কিন্তু মোদীর সমর্থকেরা জানাচ্ছেন, প্রাক্তন আইএএস আনন্দকে বাংলার রাজ্যপাল পদে নিয়োগের দেশের বাকি অংশের সঙ্গে বাংলাকেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ‘স্বচ্ছ’ করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। ধনখড়ের মতো সরকারকে বিড়ম্বনায় না ফেলে সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে অভিজ্ঞ আনন্দকে বেছেছেন তিনি। যিনি সুকৌশলে বাংলার আমলাদের মধ্যেও ‘প্রশাসনিক দক্ষতা’ আনার কাজ করবেন। ১৯৭৭ সালের আইএএস আনন্দ সরকারি আমলা হিসাবে বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ সামলেছেন। কেন্দ্রীয় বহু প্রকল্পও তাঁরই ভাবনার ফসল।
এখনও পর্যন্ত আনন্দের যে পরিচিতি মিলেছে, তাতে তিনি কাজের ব্যাপারে পাকা। প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করতে পছন্দ করেন। নিয়মনীতির এক চুল এ দিক-ও দিক করেন না। তিনি কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ‘উদ্ধার’ করতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন না। বা নির্বাচনে সন্ত্রাসের অভিযোগ পেয়ে জেলা সফর করবেন না। কিন্তু তিনি দেখবেন, রাজ্য সরকার যাতে আইনের পরিধির মধ্যে থেকে প্রশাসন চালনা করে। রাজ্য বিজেপি একটি বিষয়ে অবশ্য ‘আশ্বস্ত’ হতে পারে। কারণ, আনন্দ বলেছেন, বাংলার একটি ‘অস্থির’ রাজ্য। তবে সেই মূল্যায়ন নিয়ে ফলিত স্তরে কী করবেন নতুন রাজ্যপাল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সেই ‘অস্থিরতা’ রাজনৈতিক না প্রশাসনিক— তা এখনও কেউ বলতে পারছে না।
আনন্দের সঙ্গে প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক আধিকারিকের জানাচ্ছেন, প্রবীণ এই প্রাক্তন আধিকারিক রাজনীতি করেন না। কিন্তু আইন এবং রীতিনীতি মেনে চলেন। উনি সে দিক দিয়েই ‘সক্রিয়’ থাকবেন। বস্তুত, আনন্দের কলকাতার রাজভবনে আগমন এবং রাজ্য প্রশাসনের সম্পর্ককে বাংলার নতুন রাজ্যপালের ওই প্রাক্তন সহকর্মী ব্যাখ্যা করেছেন একটি বাক্যে— ‘‘রাজনীতিক মমতা হাঁফ ছাড়বেন। কিন্তু প্রশাসনিক মমতার মাথাব্যথার কারণ থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।’’