একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল পরিবেশ৷ তারি পাশাপাশি চলছিল একের পর আন্দোলন৷ সবমিলে মহানগরীর রাজপথ তখন গণআন্দোলনে মুখর৷ তবে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে৷ ইউরোপে ক্রমাগত নাৎসি জার্মানির ভয়ঙ্কর অগ্রগতি আর প্রাচ্যে তাদের দোসর জাপানের হুঙ্কার৷ সেই রেশ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে ভারত শাসক ব্রিটিশদের মনে৷ যুদ্ধ পরিস্থিতি অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়৷ তবুও কালের নিয়মে শরৎ এসেছিল৷ শিউলি ঝরেছিল৷ আর বাংলা মেতেছিল দেবী বন্দনায়৷
১৯৩৯ সালে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালে৷ এই ছ’বছরে গোটা শহর জুড়ে ছিল থমথমে পরিস্থিতি- চলছে ব্ল্যাক আউট৷ যখন তখন জাপানি বোমারু বিমানের হামলার ভয়৷ বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পেতেন মানুষজন৷ আবার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে অনেকে পাড়ি দিয়েছিলেন মফস্বলে৷ তবুও তারই মধ্যে শারদোৎসবের আলো জ্বলেছিল৷ তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বযুদ্ধের মাঝেই মহানগরের বেশকয়েকটি বারোয়ারি দুর্গাপুজোর শুরু হয়৷ এখনও তাদের জৌলুস চোখে পড়ার মতোই৷
বাদামতলা আষাঢ় সংঘ: ১৯৩৯ সালে এই পুজো শুরু হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই পুজো নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে। শুরুতে থিম ছিলনা। তখন অবশ্য থিমের রেওয়াজও ছিলনা। সাদামাটা পুজোই হত। গত ৪০ বছর ধরে বাদামতলার পুজোর আঙ্গিক বদলেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্যান্ডেল, প্রতিমায় নজরকাড়া ছাপ রাখার চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তারা। এখন শহরের অন্যতম সেরা পুজো বাদামতলা আষাঢ় সংঘ৷ জিতে নিয়েছে একাধিক পুরস্কার।
আহিরীটোলা সার্বজনীন দুর্গোৎসব: গঙ্গার ধার ঘেঁষা কলকাতার অন্যতম পুরোনো এলাকা৷ ১৯৪০ সালে আহিরীটোলার কয়েকজন বাসিন্দা এখানে দুর্গাপুজো চালু করেন। পুজো হয় একটি খোলা মাঠে। বলা ভাল অপরিসর ছোট খোলা জায়গায়। এবছর পুজো ৭৯ তম বর্ষে পা দিল।
চালতাবাগান : ১৯৪২ সালে শুরু হয় মানিকতলার অদূরে চালতা বাগানের লোহাপট্টির পুজো ৷ এখনো কলকাতার নামীদামী পুজোর মধ্যে একটা। এখানে নবরাত্রিতে মা অম্বের পুজো হয়। চালতা বাগানের দুর্গা মা অম্বের আদলে তৈরি। সংবাদমাধ্যমের ফোকাস থাকে এখানকার সিঁদুর খেলা।
একডালিয়া এভারগ্রিন: ১৯৪৩ থেকে গড়িয়াহাটে এই ক্লাবের পুজো হয়ে আসছে। প্রতিবছরই দেশের কোনও না কোনও বিখ্যাত মন্দিরের আদলে প্যান্ডেল তৈরি করেন একডালিয়া এভারগ্রিনের উদ্যোক্তারা শুধু প্যান্ডেল নয়, সেইসঙ্গে একডালিয়া এভারগ্রিনের অন্যতম আকর্ষণ ঝাড়বাতি। মণ্ডপ প্রাঙ্গণে বিশালাকারের ঝাড়বাতি লাগানো হয়৷
সিংহী পার্ক: বলা হয় সিংহি পার্ক ও একডালিয়া এভারগ্রিন একে ওপরের প্রতিদ্বন্দ্বী৷ এই দুটো পুজোই দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ার পুরনো পুজো৷ এবছর সিংহি পার্কের পুজোয় বয়স ৭৭ বছর৷
শোভাবাজার বেনিয়াটোলা সর্বজনীন: ১৯৪৪ সাল। তখন যুদ্ধের মতো অনেকটাই ঘুরে যেতে শুরু করেছে৷ মস্কো দখল করতে গিয়ে মার খেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে হিটলারের বাহিনী৷ কিন্তু সংঘর্ষের বিরাম নেই যেন৷ কালোবাজারি তুঙ্গে৷ কলকাতা সহ গোটা ভারতেও বেশ একটা অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে। সেই সময়ে শোভাবাজার বেনিয়াটোলা এলাকায় একটি সর্বজনীন দুর্গাপুজো পথচলা শুরু করে। তখনও ওই এলাকা কলকাতার পিছিয়ে থাকা এলাকার হিসাবেই পরিচিত৷ সেখানকার কিছু বাসিন্দার হাতে শুরু হয় শোভাবাজার বেনিয়াটোলা সর্বজনীনের দুর্গাপুজো। পুজোর উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত এবং অনিল দত্ত। তারপর থেকে প্রজন্ম বদলেছে কিন্তু পুজো কখনও তার পথচলা স্তব্ধ করেনি।
হালসিবাগান: ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তখনও বাতাসে বারুদের গন্ধ মিলিয়ে যায় নি। সেই সময়ে হালসিবাগান এলাকার কিছু মানুষ শুরু করলেন একটি সার্বজনীন দুর্গাপুজো। সাকুল্যে ১০-১২ জন বাসিন্দার উদ্যোগে শুরু হয় হালসিবাগানের পুজো। ওই এলাকায় সেটাই ছিল প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজো। এরপর পুজো কখনও বন্ধ না হলেও তিন বার স্থান পরিবর্তন হয়েছে৷