আজ আমি একটা রূপকথার গল্প শোনাবো। অনেকটা নীতি কথা গল্প বলতে পারেন। সেই হিতপোদেশ, ইশপ কিংবা জাতকের গল্পের মতো….
বানোয়ারিলাল নামে এক সিঙ্গারা বিক্রেতা ছিলেন। মানে অনেকে আজকাল আধুনিক স্টাইলে যাকে সামোসাওয়ালা বা সিঙ্গারাওলা। সেই বনোয়ারিলাল ভারতের এক শহরে সিঙ্গারা বিক্রি করতেন, নিজের গাড়িতে করে ।সাধারণভাবে তিনি বিক্রিবাটা নিজের লোকালয়ের মধ্যেই করতেন।তিনি প্রতিদিন প্রায় ৫০০ এর কাছাকাছি সিঙ্গারা বিক্রি করতেন । গত ৩০ বছর ধরে লোকেরা তাঁর সিঙ্গারা পছন্দ করতেন, বলতে পারেন লোক তাঁর সিঙ্গারার ফ্যান হয়ে গেছিলেন। তার প্রধান কারণ ছিল যে, বানোয়ারি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর ভাবে যত্ন নিয়ে সিঙ্গারা বানাতেন। সৎভাবে ও স্বাস্থ্যকরভাবে সিঙ্গারা বিক্রি করতেন। খুব ভালো মানের তেল ব্যবহার করতেন। ভাল মানের অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করতেন এবং সিঙ্গারার সঙ্গে বিনামূল্যে চাটনি দিতেন। যে সমস্ত সিঙ্গারা বিক্রি হতো না সেই সমস্ত সিঙ্গারা গুলোকে পরেরদিন তিনি গরম করে পুনশ্চ লোককে বিক্রি করার চেষ্টা করতেন না । অবিক্রিত সিঙ্গারা গুলি দরিদ্র মানুষ, অবলা জীব জন্তু ইত্যাদির মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
সৎ ভাবে সিঙ্গারা বিক্রি করার জন্য বানোয়ারিলাল ভীষণ সুনাম হয়েছিল। তাই বৈভব না থাকলেও তিনি সুখী মানুষ ছিলেন। সেই সুনাম থেকে তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন। গত ৩০ বছরে তিনি সিঙ্গারা বিক্রির জন্য কখনো ইঁদুর দৌড়ে সামিল হননি অথবা কোন রকম খারাপ পদ্ধতি অবলম্বন করেননি ,ফলে লোকসানের মুখ দেখেননি । তিনি তাঁর উপার্জনের মাধ্যমে তার একমাত্র ছেলেকে নয়ডায় একটি বিখ্যাত এমবিএ কলেজে ভর্তি করতে সক্ষম হলেন। সম্প্রতি বানওয়ারির পুত্র রোহিত এমবিএ শেষ করেছেন এবং যথাযথ ভাবে নিজ মানসিক চাহিদা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ার জন্য পিতার কাছে ফিরে এসেছেন। এরপর রোহিত তাঁর বাবার সিঙ্গারা ব্যবসায় আগ্রহী হওয়া শুরু করলেন। এর পূর্বে রোহিত তাঁর পিতার সিঙ্গারা ব্যবসাকে নিকৃষ্টমানের কাজ বলে মনে করত ।তাই তিনি বাবার ব্যবসায় জড়িত হতে চাননি বা ছিলেন না।
এমবিএ পড়াশোনা করার সময় রোহিত মন্দা এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। তিনি পড়েছিলেন বিশ্বায়ন অর্থনীতি, সেই বিশ্বায়ন অর্থনীতি কিভাবে চাকরির সম্ভাবনা গুলিকে প্রভাবিত করবে, বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে। সুতরাং রহিত ভাবলেন যে মন্দার কারণে সিঙ্গারা ব্যবসার ঝুঁকির বিষয়ে তাঁর বাবাকে পরামর্শ দেওয়া উচিত।
রোহিত বাবাকে বোঝাতে শুরু করলেন যে, মন্দার কারণে সিঙ্গারা বিক্রির উপর প্রভাব আসতে পারে , বিক্রি হ্রাস পেতে পারে সুতরাং লাভ সম্পূর্ণভাবে বজায় রাখার জন্য সিঙ্গারা তৈরীর জন্য যে সমস্ত ব্যয় করা হয় সেই ব্যয় হ্রাস প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
বেচারা বানওয়ারিলাল বড় খুশি হলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র ব্যবসায়ি হচ্ছেন এবং ব্যবসার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী হয়েছেন। শিক্ষিত এমবিএ পাশ ছেলে ব্যবসায়িক ব্যাপারে নিশ্চয় অনেককিছু জানেন। সুতরাং বনোয়ারিলাল তাঁর পুত্র রোহিতের পরামর্শ অনুসরণ করতে শুরু করলেন।
পরের দিন, রোহিত তাঁর বাবা বানওয়ারিলালকে ২০% আগের দিনের ব্যবহৃত রান্নার তেল এবং ৮০% ভালো তেল ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। গ্রাহকরা স্বাদে পরিবর্তনটি লক্ষ্য করতে পারলেন না এবং রোজের মতই ৫০০ টি সিঙ্গারা বিক্রি হল। রোহিত, সিঙ্গারা তৈরীর মানের সঙ্গে ভেদ ঘটিয়ে যে লাভ হল, তা দ্বারা উত্সাহিত হল। পরের দিন রোহিত ব্যবহৃত তেলের অংশের পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০% করল এবং বিনামূল্যে দেওয়া চাটনিটির পরিমাণ হ্রাস করে দেবার পরামর্শ দিল। সেদিন মাত্র ৪০০ টি সিঙ্গারা বিক্রি করা হয়েছিল এবং অবিক্রিত ১০০ টি সিঙ্গারা দরিদ্র মানুষ ও কুকুরকে বিতরণ করা হল।
এই দেখে রোহিত তাঁর বাবাকে বললেন যে, মন্দা সত্যিই যে আসছে, এ তারই পূর্বাভাস …. তাই আরও বেশি ব্যয় হ্রাস করতে হবে। ফলে, ঠিক হল যে, তাঁরা বাসি সিঙ্গারা আর বিতরণ করবে না, পরের দিন আবার ভেজে বিক্রি করবে। আগের দিনের ব্যবহৃত তেলের পরিমাণও ৪০% বৃদ্ধি করা হবে এবং অপচয় রোধে মাত্র ৪০০ টি সিঙ্গারা তৈরি করা হবে।
পরের দিন ৪০০ সিঙ্গারা বিক্রি হল বটে ….তবে গ্রাহকরা পুরানো স্বাদটিকে উপলব্ধি করতে পারলেন না। এদিকে রোহিত তাঁর স্মার্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে বাবকে সঞ্চয় সম্পর্কে ওয়াকিবহল করতে লাগলেন । বাবা রোহিতের উপর ভরসা হারালেন না , কারন রোহিত শিক্ষিত , হয়ত আরও ভাল ব্যবসা জানেন। পরের দিন রোহিত সিদ্ধান্ত নিল যে ৫০% ব্যবহৃত তেল ব্যবহার করা হবে সিঙ্গারা তৈরি করতে। বিনামূল্যে মিষ্টি চাটনি দিয়ে দেওয়া হবে না। কেবল সবুজ চাটনি দেওয়া হবে। ৪০০ টি সিঙ্গারা তৈরি করা হল। এদিকে লোকেরা স্বাদ অপছন্দ করতে শুরু করল। সেদিন কেবল ৩০০ টি সিঙ্গারা বিক্রি হল।
রোহিত বানওয়ারিকে বললেন, “দেখুন, আমি পূর্বাভাস দিয়েছিলাম যে মহা মন্দা আসবে এবং বিক্রি কমে আসবে। এখন এটি হচ্ছে। আমরা এই ১০০টি বাসি সিঙ্গারাকে ফেলে দেব না, কালকে ভেজে করে বিক্রি করব।” বাবা তার এমবিএ ছেলের সাথে রাজি হলেন। পরের দিন, ২০০ টি নতুন সিঙ্গারা ৫০% ব্যবহৃত তেল দিয়ে তৈরি করা হল, ১০০ টি বাসি সিঙ্গারা পুনরায় ভেজে বিক্রয়ের জন্য গাড়িতে রাখা হল। তবে গ্রাহকেরা গুণগতমানের কঠোর পতনকে উপলব্ধি করলেন। ফলত, মাত্র ২০০ টি সিঙ্গারাই বিক্রি হল।
রোহিত বলতে লাগলেন যে, মন্দা সত্যিই শুরু হয়েছে এবং এখন লোকেরা ব্যয় করার মতো কোনও অর্থ অবশিষ্ট নেই ।তাই তাদের কেবল ১০০ টি সিঙ্গারা তৈরি করা উচিত । বাকি ১০০ টি বাসি সিঙ্গারাকে পুনর্ব্যবহার করা উচিত এবং কাগজের ন্যাপকিন দেওয়া বন্ধ করা উচিত। এর পরে কেবল ৫০ টি সিঙ্গারা বিক্রি করা সম্ভব হলে। রোহিত তাঁর বাবাকে বললেন “এখন মন্দা মানুষকে ধরেছে। মানুষ আয় হারিয়েছে। সুতরাং, এই ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং তাদের সিঙ্গারা বিক্রি বন্ধ করা উচিত এবং অন্য কিছু করা উচিত।”
এবার এসব শুনে বাবা বানওয়ারি চিৎকার শুরু করলেন, “আমি জানতাম না যে এমবিএ কলেজ গুলি লেখা পড়ার নামে প্রতারণা করা শেখায়। তোমার এমবিএ শিক্ষার নিমিত্ত আমি আমার অর্থ হারিয়েছি। গত ৩০ বছরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমি সিঙ্গারা বিক্রি করে গেছি প্রতিদিন।আমার কখনই মন্দা হয়নি । তবে তোমার লাভের লোভ মন্দা নিয়ে এল আমার ব্যবসায় এবং এখন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। এখুনি তুমি আমার ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাও। আমি আমার যোগ্যতায় এটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনব। তবে তুমি যদি চাও আমি তোমাকে বাসন ধোয়ার জন্য নিয়োগ করতে পারি । কারণ এমবিএ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তুমি কেবল এটি কাজেরই যোগ্য।” তারপরে, বয়স্ক বানওয়ারি তাঁর দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক জ্ঞান এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ন্যায্য অনুশীলনগুলি অনুসরণ করা শুরু করেছিলেন। এক মাসের মধ্যে তাঁর সিঙ্গারা বিক্রয় বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছেছিল ৬০০ টি তে পৌঁছয়।
“মন্দা হল আরও বেশি কর আদায়ের জন্য সরকারের লোভকে অভিযোজিত করা, বড় ব্যবসায়ের লোভ বৃদ্ধি ও বস্তুগত মান হ্রাস করা এবং অন্যায় অনুশীলনগুলি ব্যবহার করে আরও লাভজনক হওয়ার এবং লাভ হিসাবে যতক্ষণ না আসবে ততক্ষণ অযৌক্তিকভাবে কর্মচারীদের দোষ দেওয়া। মন্দা হ’ল মানুষদের ব্যয় সীমাবদ্ধ করে ব্যবসা এবং সরকারকে দেওয়া শাস্তি …”