#পর্ব_৪
আখ, আদা, পুঁই,
এই তিন চৈতে রুই ॥
চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে কর পরিপাটি ॥
দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ
কমে না বাড়ে বারো মাস ॥
বাংলার জলবায়ু বোধয় বর্তমানে আর নাতিশীতোষ্ণ নেই। যদিও ভূগোল বইতে এখনো একে নাতিশীতোষ্ণ বলা হয়। বীরভূম, বর্ধমান ,মেদিনীপুর অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে গ্রীষ্মের তাপকে উপলব্ধি করা যায়। দক্ষিণবঙ্গেও গ্রীষ্ম , বায়ু উষ্ণ ও জলীয়। হিউয়েন সাং বাংলার জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ বললেও এবং তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছিলেন যে বাংলার পূর্ব ও উত্তরভাগ বারিপাত বহুল। এই বারিপাত ভারত মহাসাগর বাহিত মৌসুমী বায়ুসঞ্জত।এই বায়ু হিমালয় ,গারো ,খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ইত্যাদি অঞ্চলে অবিরল বর্ষণ প্রদান করে। কিন্তু এখন সেই জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে।
বসন্তের বায়ু প্রবাহ….দক্ষিণা সমীরণ সেই কবে বাংলাকে শীতল করে দিত। এখন বসন্ত বলে কিছু বোধয় উপলব্ধি হয় না। যা হোক ,তো পূর্বেই বলেছি যে বাংলার কৃষি জলবায়ু নির্ভর ছিল। সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে কবি জয়দেবের শ্যালক কবি যোগেশ্বর বর্ষা ও জলবায়ু নির্ভর বাংলার জীবন ও কৃষির এক সুন্দর বিবরণ দিয়েছিলেন। সেই বিবরণ গ্রাম্য কৃষক যুবকের সুখস্বপ্নেরও বটে…
ব্রীহিঃ স্তম্বকারিঃ প্রভূত পয়সঃ প্রত্যাগতা ধেনবঃপ্রত্যুজ্জীবিতমিক্ষুনা ভূশমিতি ধ্যায়ন্নপেতান্যধীঃ।সান্দ্রোশীর কুটুম্বিনী স্তনভর ব্যালুপ্তঘর্মক্লমো।দেবে নীরমুদারমুজ্ঝতি সুখং শেতে নিশাং গ্রামীনঃ।।
প্রচুর জল পেয়ে ধান চমৎকার বৃদ্ধি পেয়েছে। গরুগুলি ঘরে ফিরে আসছে। ইক্ষুর সমৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।ফলে আর অন্য কোনো ভাবনা নেই। ঘর্ম ক্লান্তিকরমুক্ত স্ত্রীও ঘরে এই অবসরে উশীর প্রসাধন করছেন। বাইরে আকাশ থেকে বারিপাত হচ্ছে প্রচুর । গ্রাম্য যুবক সুখের শুয়ে আছে।।
প্রাচীন বাংলায় ফলফুল বৃক্ষলতা শস্যসম্ভারে পরিপূর্ণ ছিল। ধান, যব, পাট ,ইক্ষু, সরিষা ,আম ,মহুয়া ,কাঁঠাল , পান, গুবাক, নারিকেল , বাঁশ , মাছ, তালিম , ডুমুর ,পিপ্পল , এলাচ ইত্যাদি প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হত।
কিছু কিছু আনাজ বার মাস ধরেই ফলত। সেগুলিও লুপ্ত হতে চলেছে। আবার ঋতু ভিত্তিক যেসব কাঁচা আনাজ চাষীরা উৎপাদন করতেন সেগুলোর অনেকগুলিই আজ কালের গতিতে এবং পরিবেশের ও জল আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
আজ থেকে বছর দশেক আগেও বাংলায় ছয়টি ঋতুকে উপলব্ধি করা যেত। কিন্তু এখন…হেমন্তকাল অর্থাৎ কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের যে চরিত্র তা উবেই গেছে। অপরদিকে বসন্তের মাতাল সমীরণের পাতা ঝরা ঋতুটি অনেকটাই দুর্বল। পাতা ঝরা এবং নব কিশলয় সৃষ্টির এই কাল মূলতঃ নাতিশীতোষ্ণ। কিন্তু এখন কখনো এইসময় শীত পড়ে , কোনো বছর প্রবল বৃষ্টি হয়, কোনো বছর হয় প্রচুর গরম। তবুও কবির নিকট ঋতুর রাজা বসন্ত। আজ যেমন রাজা, নানা ফসল বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঋতুরাজও বিলুপ্তির পথে। এখন মূলতঃ গ্রীষ্ম , বর্ষা , শরৎ এবং শীত।
এই চার ঋতুর উপর ভিত্তি করে এখন আউশ ,আমন, বরো এবং গম , ঋতু ভিত্তিক ডাল শস্য , তেল শস্য ও রবি ফসল বা তরকারী উৎপাদন হয়।
ইক্ষু বা আখ (Sugarcane) ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের গোত্র Gramineae-এর Saccharum গণের প্রধানত গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার বহুবর্ষজীবী এক সরু, লম্বা উদ্ভিদ। বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদনের জন্য সারা বিশ্বে তিনটি প্রজাতির আখ চাষ করা হলেও এ কাজে S. officinarumপ্রজাতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ইক্ষুর চাষ ভারতবর্ষে অতিপ্রাচীন কাল হতে চলে আসছে। যবদ্বীপ, মরীচি দ্বীপ, ফিজি দ্বীপপুঞ্জ, কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, স্ট্রেট সেটেলমেন্ট, বার্বেডো, ট্রিনিডড, ব্রিটিশ গায়েনা ইত্যাদি দেশ হতে দেশান্তরে ইক্ষুর চাষ বিস্তার লাভ ভারতবর্ষই ছিল এই চাষের আদিম বিস্তার কেন্দ্রস্থল। যে সকল শ্রেষ্ঠজাতীয় ইক্ষু এক্ষনে মরিশাস, ওটাহিটি ,বুর্বন, রাপপত্র, কুইন্সল্যান্ড, টোন্না, ক্রিয়ল , জ্যামাইকা, শ্বেতস্বচ্ছ নামে বিখ্যাত তাদের উৎপত্তি ভারতের ইক্ষু থেকেই হয়েছে।
চীন ও নিউগিনি অঞ্চলেও প্রাচীন কাল হতে ইক্ষু উৎপন্ন হত। কিন্তু উদ্ভিদবিদ রক্সবরা চীন ও নিউগিনির ইক্ষু র প্রজাতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মতপ্রদান করেছেন।
ভাগলপুর, মুঙ্গের , সারন অঞ্চলে চিনি বা চিনিয়া বলে যে জাতের ইক্ষু পাওয়া যায় তা চীন দেশীয় ইক্ষু হতে উৎপন্ন নয়। এইটি অত্যন্ত সুমিষ্ট।
ইক্ষু সেই প্রাচীন কাল হতে বাংলা তথা ভারতের নিকট ঔষধি ও অর্থকরি ফসল। ভারতের বাহিরে বিভিন্ন সভ্যতার সঙ্গে বাংলা তথা ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেই বাণিজ্যের অন্যতম পণ্য ছিল ইক্ষু , তার থেকে প্রস্তুত গুড়।সামুদ্রিক বাণিজ্য হতে বাঙালীর নিকট প্রচুর অর্থাগম হত। গঙ্গা বন্দর ও তাম্রলিপ্ত বন্দর হতে জাহাজ বোঝাই হয়ে দ্রব্য বিদেশে রপ্তানির হত।তার বদলে প্রচুর সুবর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা আমদানি হত। এই সুবর্ণ রোমক দিনার, রৌপ্য রোমক দ্রম্ভ হওয়াই সম্ভব। খ্রিস্টপূর্ব শতক হতে এই সমৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল এবং তা সমানে চলেছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বৈদিক ঔষধ তথা প্রাচীন ঔষধ , ভেষজ দ্রব্যের মধ্যে ইক্ষু বা শর্করা ছিল অন্যতম। এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ। বৈদিক যুগ হতে যজ্ঞ কার্যে এবং ঔষধি হিসাবে শর্করার যথেষ্ট ব্যবহার দেখা যায়। ভারতের নিকট হতে শর্করা প্রস্তুতির প্রণালী ও গুণাবলী শিক্ষা করে।তাই শর্করার বা চিনির ইংরাজি নাম sugar। মিসেস মেনিং বলেছিলেন – শর্করা হল ভারত জাত পদার্থ। এই শর্করা থেকে উৎপন্ন হত থেকে প্রাচীন ভারতীয় মিছরি প্রস্তুত করতেন।এর সংস্কৃত নাম শর্করা খন্ড। ইংরেজি নাম sugar candy.
হে সোম! তোমার যে দুটি পতো বক্রভাবে অবস্থিত ছিল তদ্বারা তোমার সর্বাপেক্ষা চমকার শোভা হয়েছিল। ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/২
হে সোম তোমার চতুর্দিকে লতা অবস্থায় যে সকল পত্র বিদ্যমান ছিল তদ্বারা তুমি সকল ঋতুতে সুশোভিত ছিলে।ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/৩
সোমলতা থেকে সোমরস তৈরি হতো। দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে সোমরস অগ্নিতে আহুতি দেয়া হতো। ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলে সোম দেবতা নামে সোমের স্তুতি করা হয়েছে। বলা হয় বহুকাল আগেই সোমলতা বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু তা কতটা ঠিক?
লতা অর্থে শুধু পেচিয়ে গাছে জড়ানো উদ্ভিদ নয় বরং শীর্ণ কাণ্ড বিশিষ্ট উদ্ভিদও হতে পারে। বৈদিক যুগে হয়তো তেমনটাই বোঝাত। কেননা বেদে সোমলতার যে গাঠনিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সাথে কাণ্ডবিশিষ্ট উদ্ধিদের মিল পাওয়া যায়।
যেমন:
সোমলতার পাতা বিচিত্রকুশযুক্ত।
এ সোম শৃঙ্গ যূথপতি বৃষভের ন্যায় তীক্ষ্ম। ঋগ্বেদ, ৯/১৫/৪
উপরের বর্ণনাতে বর্তমানের ইক্ষু তথা আখ গাছের সাথে হুবহু মিলে যায়। আখের দুটি পাতা বাকা, আখ একবর্ষজীবী মন্ত্রে তা বলা হয়েছে। আবার এর পাতা ষাড়ের শিং এর ন্যায় বলা হয়েছে। শুধু তাই নয় ইক্ষু যেভাবে কান্ডের মাধ্যমে জন্মায় সোমের ক্ষেত্রেও তাই বলা হয়েছে।
হে সোম তোমার প্রধান উৎপত্তিস্থান স্বর্গের মধ্যে বিদ্যমান আছে, সেখান থেকে গ্রহণপূর্বক পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে তোমার অবয়বগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে স্থানে তারা বৃক্ষরূপে জন্ম নিল। ঋগ্বেদ, ৯/৭৯/৪
আবার গুড় তৈরির পদ্ধতিটি বর্তমানে যেমন ঠিক একই পদ্ধতির কথা ঋগ্বেদের উল্লেখ করা হয়েছে সোমরসের ক্ষেত্রে।
শুভ্রবর্ণ সোমরসগুলি ক্ষরিত হতে হতে এবং নানাবিধ স্তুতিবাক্য গ্রহণ করতে করতে উৎপাদিত হলেন। ঋগ্বেদ, ৯/৬৩/২৫
লেহিতবর্ণ সোমরসকে নিষ্পীড়নের দ্বারা প্রস্তুত করা হল। ঋগ্বেদ, ৯/৮২/১
অন্যদিকে সোমরসের রঙের বর্ণনা রয়েছে বেদে।
এর ধারা হরিৎবর্ণ। ঋগ্বেদ, ৯/৬৬/২৬
ইক্ষুরস লোহিত, পিঙ্গল কিংবা রস নিষ্কাশনের পর শুভ্র বর্ণ ধারণ করে। একারণে বলা যেতে পারে সোম হয়তো আখেরই অন্য নাম। পরবর্তী সময়ে এর নেশা জাতীয় যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে আখের আড়ালে সোম নামটি চাপা পড়েছে।
সোমকে মদ হিসেবে ব্যাপক প্রচলনের দরুণ হয়তো আখের সমার্থক শব্দ সোম হারিয়ে গেছে। আজকের আখই হয়তো বেদের সোম জাতীয় উদ্ভিদ।
সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে বরেন্দ্র ভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এর অন্যতম উপকরণের কথা বলতে গিয়ে সেখানের ইক্ষু বা আখের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ভূমির প্রাচীনতর ও বৃহত্তর সংজ্ঞা হল পুন্ড্র। পুন্ড্রদের বাসস্থান , পুন্ড্রদেশ …পৌন্ড্রবর্ধন। এই পুন্ড্র পুঁড় কৌম ইক্ষু চাষে খুবই দক্ষ ছিলেন। হয়ত সেই কারনেই আখের অন্যতম নাম হয়েছে পুঁড়। এক জাতীয় দেশি আখ আছে : নাম হল পুঁড়ি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম হল গৌড়। গৌড় যে গুড় তার শব্দতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমান সুবিদিত। এই তথ্যের মধ্যেও আখের চাষের ইঙ্গিত উপলব্ধি করা যায়। বাংলার সোনার বরন গুড় ও সোনার ন্যায় উন্নত গৌড় উভয়ই ভারত বিখ্যাত ছিল।
সুবিখ্যাত সুশ্রুত গ্রন্থে পৌন্ড্রক নামে একপ্রকার ইক্ষুর উল্লেখ আছে। বহু সংস্কৃত নিঘন্টু রচয়িতা ও কোষকারদের মত এই যে, পুন্ড্র দেশে যে ইক্ষু উৎপাদিত হত তাই পৌন্ড্রক ইক্ষু। আজকাল পৌঁড়িয়া, পুঁড়ি, পোঁড়া ইত্যাদি যে সারা ভারত জুড়ে চাষ হয় তা এই পৌন্ড্রক ইক্ষু থেকে উদ্ভূত।
সুপ্রাচীন কালেই প্রাচ্যদেশের ইক্ষু ও ইক্ষুজাত দ্রব্য – চিনি ও গুড়-দেশে বিদেশে পরিচিত ছিল। গ্রিক লেখক ঈলিয়ন ইক্ষুদন্ড পেষন করে এক প্রকার প্রাচ্যেদেশীয় মধুর কথা বলেছেন। ইক্ষু নল পেষন করে একপ্রকার মিষ্টরস আহরণ করত গঙ্গাতীরবাসী লোকেরা, অন্যতম গ্রিক লেখক লুক্যানের বক্তব্য জানতে পারি। এ সব তথ্যই খ্রীস্টপূর্ব শতাব্দীর….
পূর্বেই বলেছি ইক্ষু কবির রোম্যান্টিসিজমেও ধরা দিয়েছে :
শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোৎপল-
স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ-সীমোদেরাঃ।
মোদন্তে পরিবৃত্ত-ধেম্বনডুহচ্ছাগাঃ পলালৈনবৈঃ
সংসক্ত-ধ্বনদিক্ষুযন্ত্রমুখরা গ্রাম্য গুড়ামোদিন ॥ [সদুক্তিকর্ণামৃত, ২/১৩৬/৫]
কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে [আঁটি আঁটি কাটা ধান আঙিনায় স্তুপীকৃত হইয়াছে-পৌষ মাসে এখও যেমন হয়] ; গ্রাম সীমন্তের ক্ষেতে যে প্রচুর যব হইয়াছে তাহার শীষ নীলোৎপলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম ; গোরু, বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নুতন খড় পাইয়া আনন্দিত ; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনিমুখর [ আখ মাড়াই কলের শব্দে মুখরিত] গ্রামগুলি [নুতন ইক্ষু] গুড়ের গন্ধে আমোদিত।”
আখের গুড় ও রস বাঙালির নিকট বড় প্রিয় ছিল। তাই ক্ষেমানন্দের মনসা মঙ্গলে দেখতে পাই বাসর রাতে লখিন্দর বেহুলার পরীক্ষার নিমিত্ত পায়েস রান্না করতে বলছেন ।
বেহুলা লখাই ওখ মন্দিরে গমন ।
তা দেখিয়ে চান্দ বেণ্যা ভাবে মনে মন ॥
এইমতে রহে দুহে লোহার বাসরে ।
লখিন্দর বেহুল গুইল পালঙ্ক উপরে ॥
লখিন্দর বলে বেহুল কর অবধান ।
ক্ষুধাতে আমার এবে না রহে পরাণ ॥
অন্ন রান্ধিয়ে বেহুল দেহ শীঘ্ৰগতি ।
তবে মোর প্রাণ বাচে বেহুল ” যুবতী ॥
বেহুল বলিল বেণ্য করি নিবেদন ।
আমি এত রাত্রে কোথা পাব অন্ন-ব্যঞ্জন ॥
বেণ্য বলে অন্ন দেহ করিয়ে রন্ধন ।
তাহা শুনি বেহুল কন্যা ভাবে মনে মন ॥
অবোধ বেণ্যার পুত্র রাত্রে মাগে ভাত ।
কোথা পাব হাড়ি চাউল কোথা পাব কাঠ ॥
লখিন্দর বলে বেহুল শুনহ বচন ।
তুমি #আখ-হাড়ির চাউল করহ রন্ধন।
ছামনির হাড়ি চাপায় কহিএ যুগতি ।
ঘিএ ভিজাইয়ে পাগ জ্বাল শীঘ্ৰগতি ॥
প্রদীপে আগুন জ্বাল শুনলে বেহুলা ।
এত বলি ঘুমাইল লখিন্দর বালা ॥
বেহুল বেণ্যানী তবে ভাবএ সৰ্ব্বথা ।
আজি মোর বিভ হৈল তাহে কহে কথা ॥
কি করিব কি হুইব চিন্তএ উপায় ।
অবোধ বেণ্যার পুত্র অন্ন খাতে চায় ॥
একটা সময় পর্যন্ত বাংলা চিনি শিল্পে শ্রেষ্ঠ ছিল। ইক্ষু , খেজুর রস হতে প্রস্তুত চিনি প্রচুর অর্থসমাগমের কারন ছিল। মার্কপলো ত্রয়দশ শতকে বাংলা হত্ৰ প্রধান রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে চিনির নাম উল্লেখ করেছেন। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে , সিংহল, আরব,পারস্য দেশে রপ্তানি নিয়ে দক্ষিণ দেশিয় রাজ্য গুলির সঙ্গে বঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্ব করছে ,সে সাক্ষ্য দিয়েছেন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীগন।
এ প্রসঙ্গে “চিনির বলদ” প্রবাদ বাক্যটি লক্ষ্যনীয়। এ প্রবাদ বাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে আমাদের দেশে চিনির প্রচলন বহুকাল আগেই ছিল।
শীতের দিনে পীঠে পায়েস হোক বা সন্দেশ বা বারোমাস দেবতাকে ভোগ দেবার জন্য একটা সময় অবধি বাঙালী গুড়ের ব্যবহার করতেন। কারন চিনি দুবার পাক করা। তাই তা দেব ভোগ্য নহে। তবুও আমরা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস খুঁজলে চিনি দ্বারা প্রস্তুত মিষ্টান্ন ঈশ্বরকে নিবেদন করতে দেখি।
রসিক মঙ্গলে শ্রীকৃষ্ণ মহোৎসবে আমরা পাই:
” নানাবিধ পাকান্ন সে শত শত ভার।
দধি দুগ্ধে চিনি অনেক প্রকার।।
শত শত পত্রাবলী কৃষ্ণের সম্মুখে।
শালি অন্ন ষড়রস ব্যঞ্জন শতেক।।
ক্ষীর পীঠা পাকান্ন সে নানা উপহার।
কৃষ্ণে নিবেদন করি সবাকার।।”
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে নানান বাঙালী ব্যঞ্জনের উল্লেখ পাই। তাতে চিনি দ্বারা প্রস্তুত ব্যঞ্জনের কথাও আছে।
আম্র দিয়া শৌল মাছে ঝোল চড়চড়ি।
আড়ি দিয়া রান্ধে আদা রসে দিয়া ফুলবড়ি।।
মৎস মাংস সাংগ করি আম্বল রান্ধিল।
মৎস মূলা বড়াবড়ি চিনি আদি দিল।।
শ্রী চৈতন্যের ভোজনের কথা বলতে গিয়ে সেখানে জগন্নাথ দেবের ভোগের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রসাল মথিত দধি সন্দেশ অপার।
ঘৃত, ছানা ,ঘোল ,মিষ্টান্ন, পায়েস ইত্যাদি নিত্য রসুন তৃপ্তির বস্তু ছিল বাঙালীর খাদ্য তালিকায়। মঙ্গলকাব্যে তার উদাহরণ পাওয়া যায়। নরসিংহ বসু লিখছেন :
তাহে উপকরণ #শর্করা মধু ঘৃত।
পানিফল কলা আতা শসা যথোচিত।।
দুগ্ধ ননী ছানা পানা চাঁচি #ইক্ষু দন্ড।
উপহার মিষ্টান্ন নবাত লুচিখন্ড।।
আখ থেকে সেই সময় লাল চিনি উৎপাদন হত।আমাদের ধারণা সভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ঐতিহাসিক চিনি এখনও তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কালের বিবর্তনে লাল চিনি নাম ধারণ করে সভ্যতার সাক্ষী হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালীর জীবন হতে।
লাল চিনি তৈরী প্রক্রিয়া এরকম-প্রথমে আখ থেকে রস বের করা হয়। রস বের করারপর মাটিতে গর্ত করে তৈরি চুলায় কড়াই বসিয়ে রস জ্বাল দেওয়া হয়। রস পূর্ণ জ্বাল হওয়ার পর কড়াইসহ চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের ডাং বা কাঠি আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় ‘ডোভ’ দিয়ে বিরামহীন ঘুটতে থাকে যতক্ষন না শুকনো ধূলার মত আকার ধারন করে।
দুধ চিনি , গুড় নারকেল, বাতাসা, নানান পীঠে বাঙালীর খাদ্য তালিকা অলংকৃত করত।
মালাই সন্দেশ মন্ডা মুন্ডি শর ভাজা।।
মালপুয়া ভুজা লাডু পেরা।
পালো খাজা চিঁড়া মুড়ি মুড়কি।
বাতাসা বুদে খই।।
মুড়কি বাংলার একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি জাতীয় খাবার। এটি ধানের খইয়ের সাথে চিনি বা গুড় দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। প্রাচীন কাল থেকেই মুড়কি দূর পথগামী যাত্রীদের পাথেয় হিসাবে ব্যবহারের চল আছে। এছাড়া প্রাতরাশ হিসাবেও ব্যবহার হয়। ছোট বাচ্চাদের নিকট বেশ জনপ্রিয়। প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দুরা গুড়ের মুড়কিকে ঠাকুরের ভোগ হিসাবে ব্যবহার করেন।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়হারা কবিতায় মুড়কির উল্লেখ করেছেন।[৩]
“ | উড়কি ধানের মুড়কি দেব , বিন্নে ধানের খই , সরু ধানের চিঁড়ে দেব , কাগমারে দই । | ” |
কবিতায় উড়কি ধানের মুড়কির কথা বলা হয়েছে।
- সুকুমার রায় তার আবোল তাবোল বইতে পালোয়ান কবিতায় পালোয়ানের প্রাতরাশে মুড়কির উল্লেখ করেছেন।[৪]
“ | সকাল বেলার জলপানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া, সঙ্গে তারি চৌদ্দ হাঁড়ি দই কি মালাই মুড়কি দেওয়া। | ” |
সেই কোন প্রাচীন কাল থেকেই গুড়ের বাতাসা , কদমা ঠাকুরের ভোগের জন্য উৎস্বর্গ হয়। যেকোনো পূজা ও বাতাসা এখন সমার্থক। সে সব কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
নারিকেল কুরা থোড়ে দুগ্ধ চিনি।
মরিচ ঝালের রসুনে
খাইতে সাধ বড়ি নারিকেলে কুমুড়ি
কুট না কুটিয় কুচি।।
সেই সময় বঙ্গ সমাজে বিনোদনের নিমিত্ত পানীয়ের প্রচলন ছিল। গুড় ফার্মেন্ট করে তৈরি হত উৎকৃষ্ট আসব। এটিই সেই বিখ্যাত গৌড়ীয় মদ বা মাধ্বী নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও মধু, আখ ও তালের রস হতে মদ্য প্রস্তুত হত। পানশালার এককোণে বিভিন্ন চিহ্নিত জালায় বারুনী, মাধ্বী , ধান্যেশ্বরী, সুরা প্রভৃতি রাখা থাকত…..অভিজাত বা বিনোদনে মাতোয়ারা ব্যক্তি ভর্জিত মৎস্যান্ড দিয়ে সেই পানীয় আকন্ঠ পান করে সুখ স্বপ্ন দেখত।ভাতের থেকে ও মহুয়া থেকে উৎপন্ন মদ জনজাতির মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিল।
এক সে সুণ্ডিনী দুই ঘরে সান্ধই
চীঅণ বাকলত বারুণী বান্ধই ।।”
“এক সে শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধায় / চিকন বাকলেতে মদ বাঁধে।”
ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার উন্নতমানের চিনি সুপরিচিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ চিনি রপ্তানি করত। ১৭৯৫ সালে এ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮,২০,১৮৬ মণ ও ১৮০৫ সালে ৩৩,২৪,১৬৮ মণ। ১৮৪০ সালের দিকে বীট থেকে চিনি প্রস্ত্তত শুরু হলে আখ থেকে চিনি তৈরিতে কিছুটা ভাটা পড়ে। পরবর্তীকালে চাষিরা পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়লে চিনি শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত চিনি উৎপাদন করতে না পারলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চিনি রপ্তানি অব্যাহত ছিল। প্রধানত জাভা থেকে আমদানির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা হতো।
যা হোক, এক সময় পশ্চিমবঙ্গে আখ চাষকে কেন্দ্র করে প্রচুর চিনির কল গড়ে উঠেছিল। দুঃখের বিষয় সেই ঐতিহ্য মন্ডিত চিনির কলগুলি আজ নানান রাজনৈতিক ও আর্থিক গোলযোগের নিমিত্ত বন্ধ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ফলত, উপযুক্ত দামের অভাবে অর্থকরী প্রাচীন ভারতীয় ফসল ইক্ষুর চাষ ও কদর বিলুপ্তির পথে….
#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব
বাংলার সংস্কৃতি : লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়