সনাতন সমাজ যখনই আপন সংস্কার ভুলে বিভিন্ন কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে সেই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধর্ম সংস্কারক আবির্ভূত হয়েছেন এবং স্মরণ করিয়েছেন একাত্মতার, আধ্যাত্মিকতার মূল সূত্রগুলিকে। দক্ষিণ ভারতে ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন আদি শঙ্করাচার্য। সেইসময় থেকেই(সপ্তম শতাব্দী) ঈশ্বরের একটি রূপের প্রতি সমর্পণের মাধ্যমে যে ভক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা অন্তঃসলিলা রূপে কখনো সগুণ , কখনো নির্গুণ ঈশ্বরোপাসনার মাধ্যমে ভারতবর্ষকে আপন সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে শক্তি সরবরাহ করেছে।দক্ষিণ ভারতে ভগবান বিষ্ণু , শিবের প্রতি ভক্তি দিয়ে শুরু হয়ে, উত্তর ভারতে শ্রীরামচন্দ্র , পূর্ব ভারতে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে ভক্তি আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল।মহারাষ্ট্রে নামদেব(১২৭০-১৩৫০) , উত্তর ভারতে রামানন্দ (১৩০০-১৩৮০) , কবির(১৩৯৮-১৫১৮) ভক্তির মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য , কুপ্রথার বিনাশের চেষ্টা করেন।সিন্ধ প্রদেশ আক্রমণকারীদের দখলে চলে যাওয়ার ফলে(৭০৮) ভক্তি আন্দোলনকে আপন সংস্কৃতি থেকে কুপ্রথা দূর করার সাথেই প্রতিকূল পরিবেশে আপন সংস্কৃতি,দর্শন,জীবন পদ্ধতিকে টিকিয়ে রাখার ভার নিতে হলো।কিন্তু বিধর্মীদের নৃশংসতা , ব্যক্তিগত উপাসনার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া বাড়তে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তকে আরব আক্রমণের নৃশংসতার সম্মুখীন হতে হয়।তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও ঈশ্বরোপাসনার অধিকার এই দুই শর্ত পূরণ হল ভক্তি আন্দোলন নির্গুণ ব্রক্ষ্মের পথে চালিত হওয়ায়।পৃথ্বিরাজ চৌহানের পরাজয়ের পর আড়াইশো বছরের বেশি কেটে গেছে, দিল্লিতে সেইসময় লোদি বংশের রাজত্ব।
পাঞ্জাব প্রদেশের তালওয়ান্ডি গ্ৰামে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ১৪৫৯ সালে আবির্ভূত হলেন গুরু নানক।বর্তমানে নানকানা সাহিব নামে পরিচিত গুরু নানকের জন্মস্থানটি বর্তমান পাকিস্তানের অধিকারভুক্ত। নানকের পিতা মেহতা কালু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ছিলেন আর মাতার নাম তৃপ্তা দেবী।ছোটো থেকেই নানক ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন, তাঁর মন সর্বদাই ঈশ্বর অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতো। নানক কিছুদিন সুলতানপুরে তাঁর বোন নানকির কাছে থাকার সময় সরকারি শস্যভান্ডার দেখাশোনার কাজ করেন।২৮ বছর বয়সে নানক বিয়ে করেন। তাঁর দুই পুত্র সন্তানের নাম শ্রী চান্দ ও লক্ষ্মী চান্দ। একদিন পুকুরে স্নান করতে গিয়ে নানক তিনদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং সেইসময় তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন।৩০ বছর বয়সে গুরু নানক আধ্যাত্মিক শিক্ষাদান করতে শুরু করেন। আরবীয় সাম্রাজ্যবাদের আবহে পাঞ্জাব প্রদেশে ভক্তি আন্দোলনের নিরাকার ব্রক্ষ্মোপাসনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও সমাজ সংস্কারের জন্য তিনি শিখ ধর্মের প্রবর্তন করেন এবং শিখ ধর্মের প্রধান তিনটি স্তম্ভ গঠন করেন–নাম যপ অর্থাৎ ঈশ্বরের নাম স্মরণ করা , কিরাত করা অর্থাৎ সৎ জীবন যাপন করা এবং ভান্ড চাকনা অর্থাৎ নিজের অর্থের কিছু অংশ সমাজের উদ্দ্যেশ্যে দান করা এবং যাদের প্রয়োজন তাদের সাহায্য করা। তিনি শিখ সমাজে সামাজিক ভোজনপ্রথা অর্থাৎ ‘লঙ্গর’ ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন যা এখনো সমান উৎসাহে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিদিন সমাজের সর্বস্তরের লক্ষাধিক মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একসাথে ভোজন করেন ও ভোজনের জন্য স্বেচ্ছায় সেবাদান করেন। নানকের মতে ঈশ্বর এক এবং ঈশ্বরের কোনো আকার , বর্ণ , লিঙ্গ নেই অর্থাৎ নির্গুণ ব্রক্ষ্মের উপাসনাই শিখ ধর্মের মূল মন্ত্র।
গুরু নানক বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান যা ছান্দোগ্য উপনিষদের বাণী ”সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” কে স্মরণ করিয়ে দেয়। সনাতনী পরম্পরার মতোই শিখ ধর্ম পুনর্জন্মবাদ , কর্মসংস্কারে বিশ্বাস করে। পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভকেই চরম লক্ষ্য মনে করতেন গুরু নানক এবং মোক্ষলাভের উপায় হল পুণ্যকর্ম ও আধ্যাত্মিক জাগরণ। সনাতন ধর্মে কাম , ক্রোধ ,লোভ , মোহ ও মাৎসর্য্যকে মানুষের ছয়টি শত্রু বা ষড়রিপু বলা হয়েছে। সেইরকমই শিখ উপাসনা পদ্ধতিতে লোভ , লালসা , ক্রোধ , অহং , আসক্তিকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
নানক তাঁর বাণী প্রচারের জন্য ভক্ত মারদানাকে সঙ্গী করে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছিলেন। গুরু নানক ১৫০০ থেকে ১৫২৪ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার আধ্যাত্মিক ভ্রমণে বের হন যা শিখ ধর্মে ‘উদাসি’ নামে বিখ্যাত। তিনি সারা বিশ্বে সত্যানুসন্ধান ও শিখ ধর্মের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে মোট প্রায় ২৮০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের আসাম , সিকিম , কাশ্মীর,বেনারস ,নেপাল , তিব্বত , শ্রীলঙ্কা, সিয়ালকোট সহ বিভিন্ন স্থান এবং ইরাক , তুর্কী , মক্বা , আরবদেশ তিনি ভ্রমণ করেন।
ভক্তি আন্দোলনের ফলে গীতা , উপনিষদের শ্লোকসহ রামায়ণ ও মহাভারতের ঘটনা ও মাহাত্ম্য আঞ্চলিক ভাষাতে বিভিন্ন শ্লোক, বাণী ও গানের মাধ্যমে ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।গুরু নানক সহ পরবর্তী বিভিন্ন শিখগুরুদের বাণী শিখদের পবিত্র ধর্মগ্ৰন্থ ‘গুরু গ্ৰন্থ সাহিব’এ সঙ্কলিত হয়েছে।শিখ গুরু ছাড়াও গুরু গ্ৰন্থসাহিবে নামদেব , জয়দেব ,রবিদাস , সুরদাস , কবির সহ ভক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন সন্তদের বাণিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। বহু ভক্তি সাধকদের বাণীকে পবিত্র ধর্মগ্ৰন্থে স্থান দিয়ে বেদমন্ত্র ‘একম্ সদ , বিপ্রা বহুধা বদন্তি’র বাস্তবিক প্রয়োগ করা হয়েছে। গুরু গ্ৰন্থ সাহিবে বেদ , হরি , রাম , পরব্রক্ষ্ম , যম, ধর্মরাজ , বৈকুণ্ঠ, নির্বাণ , তুরীয় অবস্থা ইত্যাদি শব্দের বহুবার ব্যবহার পাওয়া যায়।শিখ উপাসনা পদ্ধতির দার্শনিক ভিত্তি উপনিষদেই পাওয়া যায়।মান্ডুক্য উপনিষদের দুটি পাখির গল্প পাওয়া যায় যাদের মধ্যে একটি সাংসারিক সুখ ভোগ করে কিন্তু অন্য পাখিটি সাংসারিক সুখ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখে নির্বাণ লাভ করে — সেই একই উদাহরণ গুরু গ্ৰন্থ সাহিবেও পাওয়া যায়। গুরু গ্ৰন্থ সাহিবে মানবদেহেই ব্রক্ষ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের বাসের কথা(পৃষ্ঠা ৭৫৪) বলা হয়েছে অর্থাৎ মান্ডুক্য উপনিষদের ‘তত্ত্বমসি ব্রক্ষ্ম’ মন্ত্রটিই যেনো উচ্চারিত হয়েছে। গুরু নানক সহ দশজন শিখ গুরু নিজেদের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমেই ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির মূল দর্শনটিকে পুনরায় উচ্চারিত করেছিলেন। সেবা ও ব্যক্তিগত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির চিরাচরিত ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে জোরপূর্বক ধর্মান্তরণের মতে বিশ্বাসীদের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী ছিল।১৫২৪ সালে বাবর লাহোর দখল করে, লুঠতরাজ চালায় , সাধারণ মানুষদের বন্দি করে।সেইসময়ের ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন গুরু নানক, তিনিও বন্দি হন বাবরের সেনার হাতে।গুরু গ্ৰন্থ সাহিবের চারটি শ্লোকে গুরু নানক নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।ব্যথিত গুরু নানক সর্বশক্তিমানের উদ্দ্যেশ্যে ‘বাবর বাণী’ নামে খ্যাত সেই শ্লোকে বলেছেন “স্রষ্টা হিন্দুস্তানকে আতঙ্কিত করার জন্য মুঘল বাহিনীকে মৃত্যুর দূত হিসাবে প্রেরণ করতে বেছে নিয়েছেন। হানাদারদের নিপীড়নের শিকার মানুষের আর্তনাদ শুনে কি আপনার সহানুভূতি হয়নি? আর এই অমূল্য দেশ ধ্বংস করা হয়েছে। হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি সকলের প্রভু। ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিবান আক্রমণ করলে তা কারোর জন্য দুঃখের কারণ হতে পারে না কিন্তু যদি একটি হিংস্র বাঘ ভেড়ার পালকে আক্রমণ করে এবং তাদের হত্যা করে, তবে তার প্রভুকে অবশ্যই উত্তর দিতে হবে”।
ঈশ্বরবিশ্বাসী গুরু নানক তাঁর চতুর্থ শ্লোকে বিধাতার বিচারের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে বাবরের পতনের সঠিক সময় উল্লেখ করে ভবিষ্যৎ বাণী করেন। গুরু নানকের তিরোধানের আট মাস পরেই হুমায়ূন, শেরশাহ সুরীর কাছে পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয়।
গুরু নানক যে ভক্তি ,সেবা ও একাত্মতার পথ সমাজকে দেখিয়েছিলেন সেই পথেই সমাজ আপন ধর্ম-সংস্কৃতি রক্ষার্থে শক্তি সঞ্চয় করেছিল।সনাতন সংস্কৃতিকে বাঁচাতে গুরু তেগ বাহাদুর, গুরু গোবিন্দ সিং এবং অন্যান্য শিখ গুরুদের আত্মবলিদান অবিস্মরণীয়।
চতুর্থ শিখ গুরু রামদাস গুরু নানকের ইচ্ছানুযায়ী একটি সরোবরের সংস্কারসাধন করেন, তার নাম হয় অমৃতসর।এই অমৃতসরকে কেন্দ্র করে ১৫৭৪ সালে রামদাস একটি মন্দির স্থাপন করেন যা আফগানরা ধ্বংস করে দেয়।পরে ১৮০২ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিং সেখানে স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।
গুরু নানক কার্তারপুরে ফিরে এসে জীবনের বাকি সময় এখান থেকেই তাঁর ধর্মমত প্রচার করতেন। একেশ্বরবাদী হলেও ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতি থেকে সৃষ্ট অন্যান্য ধর্মমতের মতোই শিখ উপাসনা পদ্ধতি পরমত সহিষ্ণু কিন্তু শিখ উপাসনা পদ্ধতিকে মোঘলদের নৃশংস ধর্মান্তরণের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০ বছর সরাসরি লড়াই করতে হয়েছিল। এই লড়াইয়ে মোঘলদের প্রতিহত করে শিখ সমাজ ভারতীয় সংস্কৃতিকে সফলভাবে রক্ষা করতে পেরেছিল।
বর্তমান ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক অখন্ডতা রক্ষায় গুরু নানকের মত ও তার দার্শনিক ভিত্তির পুনঃস্মরণ একান্ত জরুরী।
পিন্টু সান্যাল