পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ যুবা জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাযুদ্ধে, জীবন উৎসর্গ করা সেই ‘মহা উৎসবে’। অকুতোভয় এই সকল মহাপ্রাণ যন্ত্রনায় কাতর অথচ উদাসীন ভারতীয় জীবনে ডেকে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন মৃত্যুর গর্জন। ইতিহাস হয়তো কাউকে মনে রেখেছে, কাউকে রাখেনি স্বাভাবিক নিয়মে।জীবনের সবকিছু অবলীলায় বিলিয়ে দেওয়া এই আত্মত্যাগ, শুধু ব্রিটিশ শাসনের অবসান নিশ্চিত করেনি বরং মাতৃভূমির সনাতন কৃষ্টি সংস্কৃতি ও পরম্পরা কে রক্ষা করা,তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার বিশ্বাস যুগিয়েছে। এ কথা সত্য, যুগে যুগে বহু বিদেশী ভারত আক্রমণ করেছে, শাসন করেছে, লুঠ করেছে সম্পদ; কিন্তু ইংরেজ সেই জাতি যারা এ সবের বাইরেও প্রথম আঘাত করার চেষ্টা করেছে ভারতবর্ষের প্রাচীন সনাতন ধারাকে, আঘাত হানার চেষ্টা করেছে তার চিন্তার জগতে, তার শিক্ষা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছে নিরন্তরভাবে। এই সর্বগ্রাসী শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে অসম অথচ সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছিল বাংলার বিপ্লবীরা। বাংলার চরমপন্থী আন্দোলন ধারায় ফাঁসির মঞ্চে যারা জীবনের জয়গান গেয়ে গেল, হাসিমুখে ফাঁসির রজ্জু গলায় জড়িয়ে নিল, মৃত্যুকে পরম মমতায় আলিঙ্গন করার স্পর্ধা দেখালো; স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসে, এত শক্তি-এত সাহস-এমন মনোবল এলো কোথা থেকে! ইংরেজদের দেওয়া বিভিন্ন রিপোর্টে, খুঁজে ফেরা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে, বিভিন্ন চিঠিপত্রে, হাতে আসা পুস্তক সকলে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে হৃদয়-আকাশ প্রজ্বলিত করা সেই পবিত্র গ্রন্থ শ্রীমদভগবদ গীতা ও উপনিষদ এর কথা। এই দুর্দমনীয় কাজে আরও কতগুলো গ্রন্থের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে ছিল ভগবত গীতা। ছিল স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলি, শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কথামৃত’ , বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ ‘বন্দেমাতরম’ , সখারাম গণেশ ডেউষ্কর রচিত দেশের কথা, শিবাজী -গুরু গোবিন্দ সিং- রানা প্রতাপ প্রমূখের জীবনী, ম্যাত্সিনী গ্যারিবল্ডির জীবনী কথা প্রভৃতি। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী যা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ থেকে শুরু করে প্রায় সকল বিপ্লবীর স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূল অনুপ্রেরণা ছিল – সেই তাঁর চিন্তা চেতনা কিংবা সেই শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে উদাত্ত কণ্ঠে ভারত পূণ্যভূমিকে উপস্থাপন করার ভিত্তিমূল ছিল গীতা এবং উপনিষদ। গীতার সেই শাশ্বত বাণী ‘ বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়/ নবানি গৃহ্নানি নরোহপরাণি। তথা শরীরাণি বিহায় জির্ণা/ নন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।’ অর্থাৎ জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে দেহ যেরূপ নতুন বস্ত্র পরিগ্রহণ করে,সেরূপ আত্মা জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ পরিগ্রহণ করে। অধ্যাত্মিক এই উপলব্ধি বিপ্লবীরা হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলেন এবং জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আদর্শের জন্য, প্রিয় মাতৃভূমির জন্য জীবনকে বাজি ধরেছিলেন, জগতের সকল মায়া উপেক্ষা করে।
ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী আন্দোলনের সুবিস্তৃত ইতিহাস খুঁজলে অসংখ্য উদাহরণ,প্রমাণ, রিপোর্ট পাওয়া যায় – বহু আন্দোলন এবং আত্ম বলিদান কেবল ভগবদ্গীতার অনুপ্রেরণায় সফল ও সার্থক হয়ে উঠেছে। তবে আজকে সংক্ষেপে আলোচনা গীতার শাশ্বত বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে চরমপন্থী মুক্তি আন্দোলনে যেসকল বিপ্লবী ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে হাসিমুখে আত্ম বলিদান করেছেন, তাদের সেই মহা ত্যাগের নেপথ্য কাহিনী।
বিপ্লবী ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত যথার্থ লিখেছিলেন, ‘ বর্ণমালা না পড়ে যেমন ভাষা মন্দিরে ঢোকা যায়না, গীতা না পড়েও তেমনি বিপ্লবী রাজ্যে সে যুগে প্রবেশ করা যেত না।’ বালগঙ্গাধর তিলকই প্রথম গীতার শিক্ষাকে রাজনৈতিক গণজাগরণের অস্ত্র করেন; শুধু রাজনৈতিক নয়, জনগণের আত্মাকে জাগরিত করতে, ভবিষ্যতের সঙ্গে অতীতের যোগ সাধনে গীতার আশ্চর্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন তিনিই প্রথম। তাঁর মতে গীতায় বলা হয়েছে – সংগ্রামীদের সঙ্গে আছে ঈশ্বর, মানুষ নিমিত্ত মাত্র।
সেই মামলাটা শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালের ২১শে মে। বিচারের রায় ঘোষণা হয়েছিল ১৯০৮ সালের ১৩ই জুন। ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল সেই বছরেই, ঐতিহাসিক ১১ই আগস্টে। নিস্তরঙ্গ ভারত জীবনে এই মানুষটি প্রথম শুনিয়েছিলেন মৃত্যুর সর্বব্যাপী গর্জন। তিনি শহীদ ক্ষুদিরাম বসু। ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বাঁকিপুর দায়রা আদালতের বিচারক জর্জ কর্ণডফ ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,’ ফাঁসির আদেশের কথা শুনে তোমার ভয় করছেনা? এত সাহস পেলে কোত্থেকে? ‘ অকম্পিত নির্ভীক কন্ঠে ক্ষুদিরাম উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ না আমি মরতে ভয় পাই না। আমি গীতা পড়েছি।’ গীতা থেকেই এই মহাপ্রাণ জীবনকে বুঝেছিলেন অন্য রকমভাবে। একইভাবে পরম আনন্দে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার স্পর্ধা পেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গী প্রফুল্ল চাকীও। দিদি কুসুম কামিনীদেবীর স্বামী হেমচন্দ্র মজুমদারের কলমে – ‘ গীতার অষ্টম অধ্যায়ের শ্লোক গুলোতে প্রফুল্ল চাকীর আত্মবিস্মৃত হয়ে যাওয়ার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।’ সহকর্মী বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকারের স্মৃতিচারনে প্রফুল্ল চাকীর গীতা পাঠের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে।
মেদিনীপুরের অত্যাচারী জেলাশাসক ডগলাস কে হত্যার অপরাধে তখন ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়ে গেছে বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের। ওই সময়কালে আইনজীবী মন্মথ দাস সাক্ষাত করতে যান শীতের এক সকালে। দেখেন কম্বল মুড়ি দিয়ে গীতা পড়ছেন প্রদ্যোৎ। মন্মথবাবু জিজ্ঞেস করলেন ‘গীতা পড়ছো?’ প্রদ্যোৎ এর সপ্রতিভ উত্তর ‘হ্যাঁ ‘। – কেমন লাগছে? – এমন আনন্দ আগে কখনো পাইনি। যেন মনে হচ্ছে ক্রমশ আনন্দ সাগরে ডুবে যাচ্ছি। আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হলো মন্মথ বাবুর। তাঁর কথায়, চোখেমুখে এমন অপূর্ব জ্যোতি, স্বাস্থ্য সৌন্দর্য ও লাবণ্য আগে কখনো দেখেননি। মন যেন ভয়হীন এক অনাবিল আনন্দমুখর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে। ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বৌদিকে এক চিঠিতে লিখছেন -‘ শ্রীকৃষ্ণের ‘নহি কল্যানকৃৎ কশ্চিদ্দুর্গতিং তাতে গচ্ছতি’ বাণীতে আমি উদ্বুদ্ধ। আমার যাওয়ার কল্পনা, যা এতদিন আমি মনে মনে লালন করেছি তা সফল হতে চলেছে জেনে আমি আনন্দে আত্মহারা। এই আনন্দ ভাষা দিয়ে কোনভাবেই প্রকাশ সম্ভব নয়। তারপরও লিখছেন রবি ঠাকুরের গীতাঞ্জলি থেকে – ‘ আকাশ হতে প্রভাত আলো /আমার পানে হাত বাড়ালো /ভাঙ্গা কারার দ্বারে আমার/ জয়ধ্বনি উঠলো রে, এই উঠলো রে।’ ওই একই সময়কালে বড়দা প্রভাতচন্দ্র ভট্টাচার্য কে তিনি লিখেছেন – ‘আমি বেশ আনন্দেই আছি ,মন আদৌ খারাপ হয় না। কারণ সকাল-সন্ধ্যায় কিছু কিছু গীতা পাঠ ও স্তোত্র পাঠ করিতেছি।’
এর আগে ১৯০২ সালে অরবিন্দ ঘোষ বাংলায় এলেন। মেদিনীপুরের বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো যিনি ভগিনী নিবেদিতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বোমা তৈরীর কৌশল বিদেশ থেকে শিখে এসেছিলেন, তাঁর একহাতে গীতা আর এক হাতে তলোয়ার দিয়ে গুপ্ত সমিতির দীক্ষা দিয়েছিলেন। অরবিন্দ ঘোষ অনুশীলন সমিতিতে গীতার নিষ্কাম কর্ম, ধ্যান ও ধারণাকে সুচারুভাবে চারিত করতে পেরেছিলেন বিপ্লবীদের অন্তরে। হয়তো সেই কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুরের অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের জীবন দানের সানন্দ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করেছে সারা দেশ।
আর এক ফাঁসির সাজা প্রাপ্ত বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত। ক্ষুদিরাম বসুর পর প্রথম ফাঁসির মঞ্চে আত্ম বলিদান করা বিপ্লবী, ১০ ই নভেম্বর ১৯০৮। রাজ সাক্ষী হওয়া নরেন গোঁসাই কে হত্যা করার অপরাধে একই সঙ্গে সত্যেন বসুরও ফাঁসী হয়েছিল।… মাত্র কিছুদিন আগে কানাইলালের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। সেই সময়ে তার স্বাস্থ্য, দীপ্তি ও ঔজ্জ্বল্য দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন দর্শনার্থীরা। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ তার স্মৃতিচারণায় লিখছেন, ‘ মরণের আশাপথ যাওয়া দিনগুলি সে ঘুমাইয়া ও গীতা পড়িয়া কাটাইতো। অনাবিল আনন্দে আলোক পথযাত্রীর মত তার মুখশ্রী হইয়াছিল দীপ্ত ও ঢলঢল। আগের চেয়ে ওজন অনেকখানি বাড়িয়া গিয়াছিল।’ ওই ১৯০৮ সালের ৪মে ১৮ বছরের ইন্দুভূষণ রায় আলিপুর আদালতে দাঁড়িয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তার জবানবন্দি দিয়েছিলেন, ” আমি দেড় মাস যাবৎ ৩২ মুরারিপুকুর রোডে বাস করে গীতা অধ্যয়ন ও বোমার খোল বানিয়েছি।”
বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় নাম জড়িয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র সুশীল চন্দ্র লাহিড়ী। ১৯১৮ এর ২১ ফেব্রুয়ারি লখনৌ তে ধরা পড়লেন। ৫ বছরের জেল হল। এরপরে বিশ্বাসঘাতক বিনায়ক রাও কাপলে হত্যার মিথ্যা মামলায় ফাঁসির হুকুম হলো। আবারো সেই ১১ ই আগস্ট। আবারো গীতার শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন এক অকুতোভয় যুবা। মুখে উজ্জ্বল হাসি আর আগামী ভারতবর্ষকে উজ্জীবিত করার আহ্বান। এবারের যুবক সুশীল চন্দ্র লাহিড়ী।
মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জ ও ডগলাস হত্যা মামলায় বিপ্লবী ব্রজকিশোর চক্রবর্তীর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ২৫ অক্টোবর। ৪ দিন আগে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বাবাকে লেখা চিঠির কয়েকটা লাইন – “জেল গেটে এসে বই, সকল জামা কাপড়, টাকা পয়সা নিয়ে যাবেন। ‘গীতা’ পুস্তকটি আপনার করকমলে দিয়ে গেলাম।”
রাজ দ্রোহের অভিযোগে এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রকৃত খবর নেওয়ার জন্য ১৯৪৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর জ্যোতিষ চন্দ্র বসু কে গ্রেপ্তার করলো ইংরেজ সরকার,বন্দী ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। এরপরই ফাঁসির আদেশ হয় জ্যোতিষ চন্দ্র বসুর। তাঁর আত্মজীবনী ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে ‘ তে তিনি লিখছেন – “আমি স্নান সেরে বন্দীদের ডোরাকাটা পাতলুন জামা ছেড়ে নতুন ধুতি পাঞ্জাবি পরে মাথার চুল আঁচড়ে হাতে ‘গীতা’ নিয়ে একেবারে প্রস্তুত।”- যদিও শেষ পর্যন্ত জ্যোতিষ চন্দ্রের ফাঁসির আদেশ রদ হয় গান্ধীজীর একান্ত অনুরোধ করে লেখা চিঠিতে। সেইসঙ্গে আজাদ হিন্দ বাহিনীর কাজকর্ম গোপনে কলকাতার এলগিন রোডে চালিয়ে যাওয়া নেতাজির অনুগামী মোট চার বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ একসঙ্গে রদ করেছিলেন গান্ধীজী – লর্ড ওয়াভেল কে চিঠি লিখে। জ্যোতিষ চন্দ্র বসু বাদে বাকিরা হলেন পবিত্র মোহন রায়, অমর সিং গিল এবং হরিদাস মিত্র। শেষের জন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের পিতা। ইতিহাস বলে হরিদাস মিত্রের স্ত্রী বেলা মিত্র ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইজি। বেলা মিত্রের অনুরোধে গান্ধীজীর এই চিঠি এবং ফাঁসি সাজা প্রাপ্ত চার বিপ্লবীর জীবন ফিরে পাওয়া, গান্ধীজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর কাজ-কর্মের প্রতি শ্রদ্ধার আর এক নিদর্শন নিশ্চিতরূপে।
ডগলাস হত্যা মামলায় আরেকজন বিপ্লবীর ফাঁসি হয়েছিল সেই ১৯৪৩ এর ২৫ শে অক্টোবর তারিখে। তিনি রামকৃষ্ণ রায়। মাকে এক মর্মস্পর্শী চিঠিতে লিখছেন –
“মাগো, আমার শুধু মনে হয় যে, আপনি আমার জন্য চিন্তা করে পাছে শরীর নষ্ট করেন, তা যেন না হয়। তাহলে আমি শান্তি পাবো না। গনা, ভুজঙ্গ, খোকন, ডলি ও মেজদার খোকা – এদের দেখে আমাকে ভুলতে চেষ্টা করবেন এই আমার অনুরোধ। আমি তবে এবারের মত আসি মা। আপনার কোল হতে চিরবিদায় নিয়ে চললাম। ‘গীতা’টি দিয়ে গেলাম।”
বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায় – “গীতা কেবল পড়বার কিংবা বুঝবার বিষয় নয়, জীবনে সকল সমস্যা ও অন্ধকারে পথ খুঁজে নিতে প্রধানতম আশ্রয় গীতা। গীতা শুধু জীবন সমস্যা থেকে মুক্তি খুঁজে দেয়না বরং শেখায় নির্ভীক হতে। সাফল্যের কথা না ভেবে কর্ম করার মহৎ অনুপ্রেরণা গীতা দেয় মানুষকে।দেয় ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণের শিক্ষা। তাই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপ্লবী জীবনের অত্যাবশ্যকীয় পাঠ্য ছিল গীতা। মহাত্মা গান্ধীর গোটা জীবন, রাজনৈতিক মতাদর্শ, জীবনবোধ এমনকি তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘হিন্দ্- স্বরাজ ‘ ফলত গীতার স্বকৃতি ব্যাখ্যা ও তার অনুভব কার্যকর করার উদ্যোগ। গীতা পাঠ ও তার অন্তর্নিহিত অনুভব রাজবিহারী বসুকে গভীরভাবে আপ্লুত করেছিল। তিনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন গীতা। ঋষি অরবিন্দের সমগ্র জীবন জুড়ে ছিল আধ্যাত্মবাদ এবং তাঁর ঈশ্বর চেতনার মূলভিত্তি ভূমি গীতা ও উপনিষদ। কিংবা বাঙালি বিপ্লবী আন্দোলনে ভগিনী নিবেদিতা। চট্টগ্রামের মাস্টারদা সূর্যসেনের জীবনচরিত ভেতর থেকে অনুভব করলে বোঝা যায় গীতার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন সমর্পন করেছেন তিনি, দেশমাতৃকার বেদীমূলে। কেবল স্বাভাবিক জীবন সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে নয়,নতুন উদ্যোগ, অপ্রত্যাশিত ব্যার্থতা কিংবা বেঁচে থাকা সকল অস্তিত্বে গীতা পরিপূর্ণ ও নিশ্চিত আশ্রয় আমাদের যাপন ও পরম্পরায়।
২৮ সেপ্টম্বর,২০২১
ঋণ:
১. সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র – শঙ্করীপ্রসাদ বসু
২. বাংলায় বিপ্লববাদ – নলিনী কিশোর গুহ
৩. হেম কানুনগো রচনাবলী – সম্পাদনা স্বদেশ রঞ্জন মন্ডল
৪. ভগিনী নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ – গিরিজা শংকর রায়চৌধুরী
৫ . বিপ্লব আন্দোলনের নেপথ্যে নানা কাহিনী – শিশির কর
৬. বিবেকানন্দগতপ্রাণ নেতাজি সুভাষ – স্বামী বিদেহাত্মানন্দ
৭. কোরক সাহিত্য পত্রিকা ভারতের ধর্ম পরিচয় সংখ্যা
৮. Google
চন্দ্রশেখর মন্ডল