বনলতা সেন কে? সে কি প্রেমিকা? সে কি আশ্রয়? সে কি ক্ষণকালের বিশ্রাম? হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে যে প্রেমিক আজ ক্লান্ত, জন্মান্তরের অবকাশে তার চাই মৃত্যুর বিশ্রাম। আকাশে ওড়া পাখির নীড়ের মতো, বিশ্রামের মতো আশ্বস্ত করে বনলতা সেনের চোখ। সহজ স্বাভাবিক পরিচিত ছন্দে জন্মান্তর-অবকাশের সাময়িক বিশ্রামের অভ্যর্থনা করে সে বলে, ‘‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?” বনলতা সেন মৃত্যুর এক নাম।
জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রথম স্তবকে রয়েছে খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এক বিশ্বজনীন প্রেমিক হৃদয়ের বর্ণনা। এক প্রেমিক পথ হেঁটে চলেছে যুগের পর যুগ। প্রথম স্তবকের শেষ পঙ্ক্তিতে আসছে বনলতা সেনের প্রসঙ্গ। দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে সেই বনলতা সেনের বর্ণনা। তৃতীয় স্তবকে চিরপ্রেমিকের সঙ্গে বনলতা সেনের সম্পর্ক। কে এই বনলতা সেন?
হাজার বছরের যে প্রেমিক, সে ‘নির্বিশেষ’, কোনও টাইম-বার নেই তার। কিন্তু বনলতা সেন এক ব্যক্তি বিশেষের নাম। এই কবিতায় রয়েছে নির্বিশেষকে বিশেষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। সমগ্র কালকে এককালে ধরার চেষ্টা। কাল নির্বিশেষে প্রেমকে কোনও বিশেষ দর্পণে প্রতিফলিত করার চেষ্টা।
বনলতা সেন
জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
এক প্রেমিক পথ হেঁটে চলেছেন পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে। যুগের পর যুগ চলে গেছে। তবুও রয়েছে সেই প্রেমিক হৃদয়ের অস্তিত্ব। বিম্বিসার-অশোকের অস্পষ্ট ধূসর জগৎ পেরিয়ে এসেছেন তিনি, পেরিয়েছেন অন্ধকার বিদর্ভ নগর। সেই প্রাণ তাই ক্লান্ত।
এবার নাটোরের বনলতা সেনের বর্ণনা। অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো দূরত্বের অন্ধকার তার চুল; যেন কালের ভুলে যাওয়া, অস্পষ্টতা, রহস্যময়তা, জালের আড়াল। ‘কবেকার’, ‘অন্ধকার’, ‘বিদিশার নিশা’— এক একটি শব্দ যেন চুলের গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে আরও দৃঢ়তর করেছে। ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ অর্থাৎ প্রাচীন মানুষের শিল্প-অভিব্যক্তি তার মুখে। অতিদূর সমুদ্র থেকে দারুচিনি গাছের বনকে ঘন সবুজ দেখায়; যেন একটা দ্বীপের সন্ধান। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে খড়কুটোর মতো পাওয়া সামান্য একটা দিশা পায় হাল ভাঙা নাবিক।
সেই ক্লান্তপ্রাণ এবার নাটোরের বনলতা সেনকে দেখলেন। এক অস্পষ্ট অনুভূতিতেই দেখলেন, স্পষ্ট দেখতেও হয়তো পাননি। কিন্তু কোথায় এক আশ্রয়ের জায়গা ভেসে ওঠে তার। কী বললেন বনলতা সেন? ‘‘এতদিন কোথায় ছিলেন?” মিলনের দিন ছিলই, যেন আসতেই হ’ত তার কাছে। যেন— সেই তো আপনি এলেন! এতদিন কোথায় ছিলেন? কেমন সেই আশ্রয়? পাখির নীড়ের মতো। পাখি ক্ষণিকের আশ্রয়ে নিজের চিহ্ন রেখে যায়। নীড় তাই সদর্থকতার এক নাম। জীবনের নিস্পৃহ এক সদর্থকতা। নীড় কিন্তু গৃহ নয়, বাসা, সাময়িক আবাস। আকাশ পাখিকে আশ্রয় দেয় না। আকাশে বিশ্রামের অবকাশ নেই পাখির। কিন্তু তার আশ্রয় চাই। বিশ্রাম নিতে হবে তাকে। বনলতা সেনের চোখে সাময়িক বিশ্রামের আভাস। এই হল কবির কাছে বনলতা সেন। চিরপ্রেমিকের দৃষ্টিতে বনলতা সেন।
তারপর সন্ধ্যা নামে। ‘‘হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো”। ‘‘কলরব কোলাহল থেমে যায়”। শিশিরের নৈঃশব্দ্যই তখন সবচেয়ে বড় শব্দ। উষ্ণতার গন্ধ সরে যায়। কারণ মুছে যায় চিলের ডানা থেকে ‘রৌদ্রের গন্ধ’। পৃথিবীতে রাত্রি নামে। তখন পৃথিবীটাকে এক অন্ধকার পাণ্ডুলিপি মনে হয়। সেই পাণ্ডুলিপিতে গল্প রচনা করে জোনাকির আলো-রং। সেই গল্পটা তারপর সবার কাছে ছড়িয়ে যায়। সবাই তখন নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সব পাখি ঘরে ফেরে, নদী সাগরে গিয়ে মেশে। চিরপথিক নীড় খোঁজে। তারও সাময়িক বিশ্রাম চাই। একজন্মের শান্তি। আরও হাজার বছর সে হাঁটবে। মাঝে একটা মৃত্যুর বিশ্রাম চাই, pause চাই। ‘বনলতা সেন’ নামক মৃত্যু বিশ্রাম দেওয়ার কাজটিই যেন করে। এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে যাওয়ার বিশ্রাম। মৃত্যু স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী