লকেট চট্টোপাধ্যায়কে অনেকে বলে থাকেন ‘বঙ্গ বিজেপির লক্ষ্মী’। টলিউড অভিনেত্রী লকেট রাজনীতিতে এসেছিলেন অধুনা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মারফত তৃণমূলে যোগ দিয়ে। খুব বেশি দিন অবশ্য তিনি ঘাসফুলে থাকেননি। যান পদ্মফুলে। সংগঠন সামলাতে সামলাতে সাংসদ। ঘটনাচক্রে, ‘লক্ষ্মী’ লকেট বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর পদ্মের ভাঁড়ারে লোকসভার আসনসংখ্যা অপ্রত্যাশিত ভাবে বেড়েছিল।
কিন্তু লক্ষ্মীকে একই সঙ্গে ‘চঞ্চলা’ও বলা হয়। বলা হয়, তিনি এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। লক্ষ্মীকে ধরে রাখতে অনেক মেহনত এবং কসরত করতে হয়। লকেটকে ধরে রাখতেও কি বিজেপিকে সেই মেহনত, কসরত এভং কৌশল করতে হচ্ছে? বার বার তৃণমূলে চলে যাওয়ার জল্পনায় থাকা লকেটকে দলে ধরে রাখতেই এমন পরিকল্পনা গেরুয়া শিবিরের। কাজের মধ্যে রেখে লকেটকে বেঁধে রাখাই আসল লক্ষ্য। তেমনই মনে করছে বিজেপির একাংশ। তবে অন্য একাংশের মতে, যা হচ্ছে, সবই লকেটের কাজের প্রেক্ষিতে। দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে তিনি কাজ করছেন। সে কারণেই তাঁর উপর আস্থাও বাড়ছে। এর মধ্যে অন্য কোনও অর্থ খোঁজা অর্থহীন।
তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় সংসদের খাদ্য এবং গণবণ্টন সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন বিজেপির লকেট। সেই দায়িত্ব নিয়েও নিয়েছেন হুগলির সাংসদ। মঙ্গলবার কমিটির প্রথম বৈঠক করেছেন লকেট। আর গত সোমবার রাজ্য বিজেপির কোর কমিটি ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তাতেও রয়েছেন লকেট। রাজ্যের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ওই কমিটিতে তাঁর থাকারই কথা। কিন্তু সেই রাতেই রাজ্য মহিলা মোর্চার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বও পেয়েছেন তিনি। তার রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের ঘোষণা— লকেট এখন বিজেপির রাঢ়বঙ্গ জ়োনের ‘পর্যবেক্ষক’।
কেন পর পর এত দায়িত্ব? আনন্দবাজার অনলাইনকে লকেট বলেছেন, ‘‘দায়িত্ব যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন কেন দিচ্ছেন। আমার মনে হয়, আমি নির্দেশ মতো কাজ করতে পারছি। এ ছাড়া তো আর কোনও কারণ হতে পারে না।’’
লকেট পদ্ম ছেড়ে আবার ঘাসফুলে ফিরতে পারেন, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই বার বার এ নিয়ে সরগরম হয়েছে বাংলার রাজনীতি। প্রতি বারই বিষয়টিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়েছেন লকেট। কিন্তু কখনও কখনও লকেটের দলবদলের সম্ভাবনার কথা উস্কে দেওয়া হয়েছে শাসক শিবির থেকেও।
এক বছর আগের সেপ্টেম্বরে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ টুইট করে ভবানীপুর উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচারে না নামার জন্য লকেটকে ধন্যবাদ জানান। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ভবানীপুরে প্রচারে না আসায় তারকা প্রচারক লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। বিজেপির অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আপনি প্রচার করেননি। আপনি যেখানেই থাকুন, বন্ধু হিসাবে আপনার সাফল্য কামনা করি।’’ পাশাপাশিই জল্পনা বাড়িয়ে কুণাল লিখেছিলেন, ‘‘পৃথিবী খুব ছোট। আশা করছি আপনার রাজনীতি শুরু করার দিনগুলি আবার ফিরে আসুক।’’ কুণালের কথায় ইঙ্গিত ছিল লকেটের তৃণমূলে থেকে রাজনীতি শুরুর দিনের প্রতি। তবে কুণালের উদ্দেশে লকেট পাল্টা লেখেন, ‘‘আপনি বরং ভবানীপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে না হারেন সে দিকে নজর দিন।’’ পরমুহূর্তেই কুণাল জবাব দেন, ‘‘ভাবতে হবে না। মমতাদি বড় ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। কিন্তু তবুও আপনাকে ধন্যবাদ যে, আপনি জবাবেও (বিজেপি) প্রার্থীর নাম উল্লেখ করেননি।’’ কুণাল লকেটকে ‘সাধুবাদ’ জানিয়ে হিন্দিতে লেখেন, ‘‘কঁহি পে নিগাহে, কঁহি পে নিশানা।’
অর্থাৎ, দৃষ্টি যেখানে, নজর সেদিকে নেই। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, ভবানীপুর উপনির্বাচনের সময়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে লকেট উত্তরাখণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবে সে পর্ব মিটে গেলেও রাজ্য রাজনীতিতে তখন লকেটকে বেশি দেখা যায়নিও বটে। পুরভোটের প্রচারেও নয়। বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যাওয়ার পরেও লকেটকে নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছিল। সে বারও বিষয়টিকে ‘গুজব’ বলেই উড়িয়েছিলেন তিনি। যেমন বলছেন এ বারেও। তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে কি? প্রশ্নের উত্তরে লকেট বলেন, ‘‘গুজব তো দলের আরও অনেককে নিয়েই ওঠে। কিন্তু তাদের তো আর ধরে রাখার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় না! বিজেপিতে দায়িত্ব দেওয়া হয় কাজ দেখে। জল্পনা শুনে নয়।’’ তবে দলবদলের জল্পনায় থাকা সময়ের সঙ্গে এখনকার লকেটের ফারাক রয়েছে বলেই দাবি গেরুয়া শিবিরে। নিজের লোকসভা আসন হুগলিতে নিয়মিত খোলা হচ্ছে তাঁর দফতর। কলকাতায় এলেই সময় দিচ্ছেন হুগলিতে। সেই সঙ্গে রাজ্যনেত্রী হিসাবে নিয়মিত অন্য জেলাতেও কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। রাজ্য বিজেপির নবান্ন অভিযান কর্মসূচিতেও তাঁকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে গ্রেফতার হতে দেখা গিয়েছিল। সে সবের পরেই অবশ্য সংসদীয় কমিটি থেকে মহিলা মোর্চার পর্যবেক্ষক— একের পর এক দায়িত্ব পেয়ে চলেছেন লকেট। ‘চঞ্চলা’র মন আর ‘আনমনা’ নেই। অন্তত তেমনই দাবি পদ্ম শিবিরের একাংশের।