রানী চন্দ লিখছেন (আমার মা’র বাপের বাড়ি), আশ্বিনের সংক্রান্তি — ধীর শান্ত। শীতল জিনিস খাও, শীতল হয়ে থাকো। হেমন্তের কালটা ভালো নয়। হাওয়া, ‘ওম’ ভারী — এ কথা শুরুতেই মনে রাখতে হয়। মামীরা আশ্বিন সংক্রান্তিতে ভাত রান্না করে জল ঢেলে রাখেন, পরদিন ভিজে ভাত খান। বলেন — ‘আশ্বিনের ভাত কার্তিকে খায়, যেই বর মাগে সেই বড় পায়।’
বাংলার লোকায়ত জীবনে সংক্রান্তিগুলি নানান আচার পালনের মধ্যে দিয়ে, পূজাপার্বণ-ব্রত উৎযাপনের মধ্যে দিয়ে, সংস্কৃতির পরত মাখিয়ে শিকড়ের অনুসন্ধানে অনবধানে আমাদের কখন যেন পৌঁছে দিয়েছে৷। নানান বিধিনিষেধ মানার মধ্যে দিয়ে আমরা মরশুমি তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, সূর্যালোক, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে নিজেদের শরীরকে খাপখাইয়ে নিতে পারি।
সংক্রান্তির দিন বাইরে থাকার নিয়ম নেই। অর্থাৎ গৃহ পরিবেশে পরিবারের সকলকে সঙ্গে নিয়ে ঘরোয়া মেজাজে আনন্দ উৎসবে সামিল হবো সকলে। এই অসামান্য লোকচারণার মধ্যে বাংলার সংক্রান্তি গুলি নিবিষ্ট রয়েছে। বাঙালি জীবনে আশ্বিন সংক্রান্তিটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংক্রান্তি। কারণ এই সময়ের মধ্যেই বাংলায় দুর্গাপূজার আবহ — কোনো বছর দুর্গাপুজো শুরু হবে, কোনো বছর কালীপুজো আসছে। এই সময় আউশধানে কৃষকের গোলাখানি ভরা। আমন ধানে তখন লক্ষ্মী গর্ভে বসেছেন। ধানের শীষ আসার আগে গাছের ডগ ফুলে উঠেছে আনন্দে, যেন পোয়াতি মা। এই দিনটিকে বাংলায় ‘নল সংক্রান্তি’ বলে। নলপুজো হয় ধানের জমিতে।
নলপুজো হল গর্ভিণী ধানের সাধভক্ষণ উৎসব। শালিধান অর্থাৎ আমন ধান মাঠে মাঠে ঢেউ খেলে চলেছে। আসছে ধানের ফুল, পরাগমিলন হবে, তারপর দানা। সমগ্র প্রক্রিয়াটি যেন পোয়াতি মায়ের সন্তান ধারণের মতই ব্যাপার।
ধানের সাধ দেওয়া হয় আশ্বিন সংক্রান্তিতে। যখন ফুল আসার আগে পোয়াতি মায়ের মতই ধানের ডগা ফুলে ওঠে। ধান্যলক্ষ্মীর সাধ কৃষিজীবী মানুষের আবহমানকালের আচার। কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে কেউ জানেন না। এই উৎসব আসলে ‘পৃথিবী পুজো’ (Earth Worship)। আদিম মানুষ বুঝেছিল, সন্তান আর ফসল দুই-ই উৎপাদন। সন্তান ধারণ করেন মা, আর ফসল ধারণ করে মাটি, সুতরাং ফসল নিয়ে আবির্ভূতা পৃথিবী বা মাটি মাতৃদেবী।
ধানকে সাধ দেওয়া একটি অনুকরণাত্মক যাদু বা Imitative Magic. যা করবো বাস্তবে তাই হবে। ধানের শিষ আসার আগে ধানের ডগাটি পোয়াতি মায়ের পেট। ফুলে ওঠা এই পেটকে বলে ধানের ‘থোড় দশা’ বা Booting stage. এটিই হল ধানের গর্ভসঞ্চার। নল-খাগড়ার জঙ্গলে যেমন অসামান্য বংশবিস্তার! নল-খাগড়া যেমন ঝাড়ে জঙ্গলে বেড়ে ওঠে! তাই নলগাছের অবয়বে প্রভূত প্রজনন শক্তি বিরাজ করে, এটাই লোক-সমাজের বিশ্বাস। বিশ্বাস, ধানক্ষেতে নলপুজো করলে নলের প্রবণতা ধান-ফসলেও সঞ্চারিত হবে। তাতে প্রচুর ধান ফলবে। নৃতত্ত্ববিদ্যার ভাষায় একেই বলে Imitative magic বা অনুকরণাত্মক যাদু প্রক্রিয়া। বাংলার নানান অঞ্চলে নল সংক্রান্তি পালিত হয়। রাঢ় ও দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় নল পুজোর আগের দিন সশিষ নল গাছ কেটে আনা হয়। তাতে নানান বনৌষধি ও লৌকিক সামগ্রী বোয়াল পাতায় মুড়ে নলগাছের পাতায় বাঁধা হয়। বুনো ওল, কেশুতের শেকড়, রাই সরষে, হলুদ, নিম, শুকতো পাতা এবং চালের খুঁদ থাকে সামগ্রীর তালিকায়। কৃষক নলের গোড়া ধুয়ে শালুক ফুলে জড়িয়ে ধান-ক্ষেতে নিয়ে যায় নল পুজো করতে।
বাংলার কোনো কোনো জায়গায় আশ্বিন সংক্রান্তিতে ‘ধান-ডাকা’ নামক লোকানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এটি শস্যদেবীকে সন্তুষ্ট করার একটি আচার। প্রভূত ধান উৎপাদনই হবে — এটাই কামনা। কৃষকে কৃষকে উন্নত চাষের রেষারেষি এই উৎসবে ধরা পড়ে। লৌকিক ছড়ায় পাচ্ছি — “লোকের ধান হুলুসথুল/ আমার ধান শুধুই ফুল/ ধান — ফুল ফুল ফুল।” কোথাও ছড়া কাটা হয়, “অন-সরিষা, কাঁকুড় নাড়ি,/যা-রে পোক ধানকে ছাড়ি/এতে আছে শুকতা,/ধান ফলবে গজ মুক্তা।/এতে আছে কেঁউ,/ধান হবে সাত বেঁউ।”
কোথাও আশ্বিন সংক্রান্তিতে বানানো হয় ‘ভালাভুলা’। সেটি কেমন? রানী চন্দের বর্ণনা আছে, “বাঁশের মাথায় খড় দড়ি দিয়ে মানুষের মতো একটা গোল মাথা — দু দিকে দুটো হাত বানিয়ে ভালাভুলা বাঁধো। ভিতরে দেয় মশা মাছি আর ইচা-খৈল্সা মাছ।” এদিন সব বাড়ির গৃহস্থ ভালাভুলা জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘোরেন আর বলেন, “মশা মাছি দূর হ — সাপ ব্যাঙ দূর হ — ভুল-ভাল দূর হ।…..ইচার কাড়া বৈচার মুড়া, ভুল গেল রে উত্তর মুড়া।” এইসব ছড়া বলে গৃহস্থ উত্তর দিকে ছুঁড়ে দেয় ‘ভালাভুলা’। গৃহ পরিবেশ থেকে যাবতীয় মশা মাছি সাপ ব্যাঙ এবং সেই সঙ্গে সাংসারিক ভুলভ্রান্তি গৃহস্থের আঙিনা থেকে দূর করে দেবার একটি ম্যাজিক যেন! এই পোড়ানো জিনিস থেকে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, তাতে মশা-মাছি পালায়। বাস্তবে এইসময় ডেঙ্গুর মশা ও ডেঙ্গুজ্বরের আক্রমণ প্রবল হয়। হয়তো লোকায়তিক সংস্কৃতিতে ডেঙ্গুর মশা এইভাবেই দূর করা হত।
আশ্বিন সংক্রান্তির দিনে পালিত হয় ‘গারসিব্রত’। এটি লক্ষ্মীব্রতের অন্যতর রূপ। অনেক জায়গায় ‘গারু সংক্রান্তি’ বা ‘গাস্বীব্রত’-ও বলে থাকেন লোকসমাজ। এই কৃষি আচারে লক্ষ্মীদেবীকে তাল মিছরি এবং ভেজানো খেসারির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। ব্রতিনীরা উপবাস ভঙ্গ করেন ভেজানো বা রান্না করা খেসারির ডাল খেয়ে। হাল অথবা জাল ব্যবহার করে পাওয়া কোনো খাবার এদিন খেতে নেই। বছরের এই একটি দিন। ধান থেকে শুরু করে প্রায় সকল ফসল পেতে হয় জমিতে হাল দিয়ে বা লাঙ্গল দিয়ে। মাছ, কাঁকড়া প্রভৃতিও জাল দিয়ে ধরতে হয়। যেহেতু খেসারি চাষ করতে আলাদা করে কোনো হালের ব্যবহার হয় না, ‘পয়রা ক্রপ’ হিসাবে ধানের জমিতে ধান কাটার একমাস আগে ভেজা মাটিতে খেসারির বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মূল ধান কাটার প্রায় দুমাস পর একরকম বিনা কর্ষণে ফসল কেটে নেওয়া হয়। একেই কৃষির পরিভাষায় ‘পয়রা ফসল’ বলে। বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্যায় খেসারির ডালের পর্যাপ্ত ব্যবহার রয়েছে। অথচ এই ডাল কাঁচা বা রান্না করে খেলে স্নায়বিক পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই কৃষিবিজ্ঞানীরা এই ডালের নার্ভ-টক্সিন দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন; বাংলার গবেষকদের দ্বারা উদ্ভাবিত ‘নির্মল’ জাতটি এই দোষ থেকে মুক্ত।
খুব ভোরে উঠে এদিন রান্না করতে হয় খেসারির ডাল; তারসঙ্গে হাল ব্যবহার না করে জন্মানো শাক সবজি সেদ্ধ দেওয়া হয়, যেমন মানকচু, দুধকচু, কৃষ্ণকচু, ওল। এই বিশেষ ডাল রান্নাকে বলে ‘আসমবারি’। এই ডালে হলুদ এবং তেল-মসলার ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
দেবী লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট করতে ঘর ও উঠোন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ব্রতিনীরা গারসির ব্রতকথা শোনেন পুজোর পর। বাড়ির মেয়ে-বউরা এই ব্রত করে থাকেন। কৃষি-কামনাই এই ব্রতের মূল উদ্দেশ্য। এই দিনে তাড়ানো হয় অলক্ষ্মীকে, বোধন করা হয় দেবী লক্ষমীকে।
গারসি ব্রতকথায় আছে, লক্ষ্মীরূপা সওদাগরের স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংসারের সর্বত্র অলক্ষ্মীর আচরণ করতে থাকেন পুত্রবধূরা। আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় সওদাগর-পরিবার। সেই সুযোগে সংসারে পাকাপাকি আসন পাতার উপক্রম করেন অলক্ষ্মী। কিভাবে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ তার নিজের লক্ষ্মী-সম আচরণের দ্বারা সেই অমঙ্গলকর প্রয়াস ভেস্তে দিলেন — সেই সদাচরণই ব্রতকথার মূলসুর।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং অরিত্র ঘোষ দস্তিদার।