একদা, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা নুরুল ইসলাম আমাকে গল্পচ্ছলে বলেছিলেন, ‘মমতা বিপদে পড়লে ওর পরিবারকেও অস্বীকার করতে পারে। এটাই ওর বৈশিষ্ট্য। আসলে কৃতজ্ঞতা নামক শব্দটিই মমতার অভিধানে নেই। নুরুল সাহেব যখন আমাকে একথা বলেছিলেন, তখন মমতা বিরোধী নেত্রী। এমনকী কংগ্রেসও ছাড়েননি। কংগ্রেসের ভিতরে থেকেই প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা কংগ্রেস ছাড়বেন, ছেড়ে স্বতন্ত্র একটি দল করবেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন— এরকম ভাবনা তখনও কেউ ভাবেননি। কিন্তু তখনই নুরুল ইসলাম এমন একটি অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী মমতা সম্পর্কে করেছিলেন। সাংবাদিক জীবনে মমতার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। ফলত, অত্যন্ত নিকট থেকে তার রাজনৈতিক কৌশল এবং রাজনীতির ধরন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে মমতাকে দেখার সুবাদে এটুকু অন্তত বলতে পারি, নুরুল ইসলাম একেবারে ভুল কিছু বলেননি। বরং, মমতা সম্পর্কে নুরুল সাহেবের এই মূল্যায়ন অনেকটাই সঠিক। কৃতজ্ঞতা শব্দটি যে মমতার অভিধানে নেই, তা বুঝতে পেরেছি সাংবাদিক হিসাবেই বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। যেমন প্রয়াত পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার ব্যবহারে। যে সময় কংগ্রেসের কোনো নেতা মমতার পাশে এসে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেননি— সেই সময় হাতে গোনা যে দু-একজন প্রথম সারির নেতা মমতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের ভিতর দুজনের নাম অবশ্যই স্মর্তব্য— পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। পরে বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতাও হয়েছিলেন পঙ্কজবাবু। ভদ্র, সজ্জন এবং সৎ এই মানুষটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত মমতার কাছ থেকে প্রাপ্য শ্রদ্ধা এবং সম্মান পাননি। বরং দুর্দিনের বন্ধু এই মানুষটিকে মমতা শেষ পর্যন্ত অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা এবং অসম্মান করেছেন। ক্ষুব্ধ, অপমানিত পঙ্কজবাবু প্রকাশ্যে একটি কথাও বলেননি, বরংনীরবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে।
মনে আছে, রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার কিছুদিন আগে পঙ্কজবাবুর সঙ্গে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল আমার। একথা সেকথার পর দুঃখ করে বলেছিলেন—‘মমতা আমাকে অপমানটা না করলেই পারত। কাছে থেকে দেখতে দেখতে বুঝেছি, আসলে এটাই মমতার চরিত্র। স্বার্থ সিদ্ধি হয়ে গেলে মমতা উপকারীকে ভুলে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। যেমন, ফেলানি বসাক। হতভাগ্য এই মূক বধির কিশোরীটিকে কিছু দুষ্কৃতী ধর্ষণ করেছিল। মমতা এই কিশোরীটিকে নিয়ে মহাকরণে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরের সামনে ধরনায় বসেন। পুলিশ জোর করে ওখান থেকে মমতাকে উঠিয়ে লালবাজারের লক আপে আটক করে। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে তখন যথেষ্ট শোরগোল পড়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে মমতা অনেকখানি প্রচারও পান। কিন্তু ওই হতভাগিনী ফেলানি বসাকের কী হয়েছিল ? রাজনৈতিক প্রয়োজনটি মিটে যাওয়ার পর মমতা আর ফেলানির দিকে ফিরেও তাকাননি। ফেলানি আর তার হতদরিদ্র বিধবা মা কয়েকদিন সাহায্যের আশায় মমতার কালীঘাটের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন। অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটেনি তাদের কপালে। পরে ফেলানি এবং ফেলানির মা দুজনেই মারা যান। দুঃসময়ের সঙ্গীদের এইভাবে অবজ্ঞা করা এবং অপমান করার এইরকম বহুবিধ ঘটনার এক অন্যতম সাক্ষী মুকুল রায়। বর্তমানে বিজেপি নেতা মুকুলবাবু মুখ। খুললে মমতা চরিত্রের অনেক রহস্যই এভাবে উদঘাটন হতে বাধ্য।
কিন্তু বিপদে পড়লে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজে বাঁচতে অন্যকে বলির পাঁঠা করতে পারেন— সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা হলো এবার। কীভাবে হলো? এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপর্যয় ঘটেছে। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ— গত সাত বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ। তোলাবাজি ও কাটমানিতে অতিষ্ঠ মানুষ প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিষয়টি বোঝেননি নয়। বুঝেছেন বলেই, সভায় সভায় তিনি কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলেছেন। চারশো কোটি টাকার বিনিময়ে নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর তাঁকে এই পরামর্শ দিয়ে গেছেন কিনা জানি না। যদি দিয়ে থাকেন, তাহলে বলতেই হবে, প্রশান্ত কিশোর মমতার প্রকৃত বন্ধু নন। কিন্তু মমতার এই কাটমানি ফেরত দেওয়ার আহ্বানের ফলে কী হলো? দেখা গেল, জেলায় জেলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মেজো, সেজো, ছোটো নেতাদের ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিক্ষোভের মুখে কেউ কেউ টাকা ফেরত দিচ্ছেন, কেউ কেউ টাকা না দিতে পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার মমতা এবংমমতা ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা ক্ষোভ বিক্ষোভ হচ্ছে না। এখানেই মমতার রাজনীতিটা লক্ষ্য করার মতো। মমতা জানেন, একমাত্র এই লাগামছাড়া দুর্নীতির অভিযোগই ক্ষমতা থেকে তার দলকে। অপসারিত করতে পারে। এতদিন ধরে তিনি যে সৎ সাজার মিথ্যা ভানটি করে রয়েছেন তা নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে। কাজেই দুর্নীতির অভিযোগে বিপর্যয়ের আঁচ পেতেই মমতা বন্দুকের নলটি একনিমেষে ঘুরিয়ে দিয়েছেন নীচুতলার কর্মীদের দিকে। কাটমানি ফেরত দাও, কাটমানি ফেরত দাও’ বলে হইচই ফেলে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, এই দলটিতে তিনিই একমাত্র সৎ। তিনি কোনো অন্যায় করেননি। যা অন্যায় করেছেন দলের নীচুতলার নেতারা। অথচ এই মমতাই নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মীসভায় বলেছিলেন, ৭৫ শতাংশ পার্টিকে দিয়ে বাকি ২৫ শতাংশ নিজের কাছে রাখো।অবশ্য নিজে ধোয়া তুলসীপাতা সাজতে গিয়ে বন্দুক অন্যের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার খেলা মমতা আগেও খেলেছেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে কয়েকজন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা-মন্ত্রীর নামে যখন নারদের স্টিং অপারেশনে টাকা নেওয়ার ছবি দেখানো হয়েছে, তখনও মমতা বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় বলে বেড়িয়েছেন— ‘আগে জানলে এদের টিকিট দিতাম না। তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা যায়, সুব্রতবাবু একান্তে কয়েকজনকে বলেছিলেন, ‘মমতা আমাদের বলির পাঁঠা বানিয়ে নিজে ভালো সাজতে চাইছেন।আমি একবারও বলতে চাইছিনা—জেলায় জেলায় যেসব তৃণমূল নেতারা কাটমানি খেয়েছেন বা টিভির ক্যামেরায় নারদ স্টিং অপারেশনে যেসব তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীকে হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছে তারা ধোয়া তুলসীপাতা। আমার বক্তব্য সহজ—বন্দুকটা শুধু এদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মমতা আসলে কী আড়াল করতে চাইছেন?
সাত বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এই সাত বছর ধরে এই রাজ্যে অজস্র তোলাবাজি আর কাটমানি খাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তা নিয়ে যথেষ্ট শোরগোলও হয়েছে। বেশ কিছু শিল্পসংস্থা তোলাবাজির জেরে এই রাজ্য থেকে পাট গুটিয়েছে। আজ যদি মমতা হঠাৎ ভিনগ্রহ থেকে এসে অবাক হওয়ার ভান করেন—তাহলে মানুষের ভুরু কেঁচকাবেই। নীচু তলার যে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা কাটমাটি খেয়েছেন, তাদের কাটমানি ফেরত দিতে হবে অবশ্যই। কিন্তু মমতার অতি ঘনিষ্ঠ যে ব্যক্তিটি প্রতি মাসে তেরোটি গাড়ির কনভয় নিয়ে পুরুলিয়া থেকে তোলার টাকা আদায় করে কলকাতায় ফেরেন— তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা এবার নেবেন মমতা? ওই তোলার টাকা তাঁকে ফেরত দেওয়ার কথা বলতে পারবেন তো? বন্দর অঞ্চলে মমতার অতি ঘনিষ্ঠ যে নেতাটিকে সেলামি না দিলে মাল খালাসের বরাত পাওয়া যায় না— তাকে কাটমানি ফেরত দিতে বলতে পারবেন তো মমতা? কালীঘাটের যে পরিবার মাত্র সাত বছরেই এক হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তির মালিক হয়েছে, সেই পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধেই তোলাবাজি এবং কাটমানির অভিযোগ রয়েছে। ব্যবস্থা নিতে পারবেন তো মমতা তাদের বিরুদ্ধে ? ডেলোর বাংলোয় সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তার কী আলোচনা হয়েছিল— প্রকাশ্যে তা জানানোর সৎসাহস আছে তো মমতার? একটি চিট ফান্ড মালিকের মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলকে বাঁচাতে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা ঢেলেছেন কেন মমতা— কী তার স্বার্থ ? বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ও মমতা ছবি আঁকতেন। সে ছবি কখনো পাঁচ টাকাতেও বিকাতো না। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই সে সব ছবি কোটি কোটি টাকায় বিকোতে শুরু করল ? কাদের প্ররোচনায় বা আদেশে কারা ছবি কেনার নাম করে টাকা ঢালতে শুরু করল তৃণমূলের শিকড়ে— সে নিয়েই বা তদন্ত হবে না কেন?
আসলে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করাটা মমতার উদ্দেশ্য নয়। মমতার উদ্দেশ্য, নিজেকে এবং নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের যাবতীয় অভিযোগ থেকে আড়াল করা। যে কারণেই কাটমানি ফেরত দেওয়ার গিমিকটা তাঁর কাছে এখন সবিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
আমার মনে আছে, মমতা যখন বিরোধী নেত্রী, তখন একবার কলকাতার ধর্মতলায় আয়কর ভবনে মমতার সঙ্গীসাথীরা হামলা চালায়। মমতার নির্দেশেই ওই হামলাটি চলেছিল সেটা আমি জানি। হামলার কারণ ছিল, সেই সময় আয়করের এক পদস্থ কর্তা সি কে ইজং মমতার কোনো একটা অন্যায় আবদার মেটাতে চাননি। সেই ক্ষোভেই এই হামলা। ওই ঘটনার পর সি কে ইজংয়ের একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম আমি। ইজং সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। কিন্তু একান্ত আলোচনায় দুঃখ করে বলেছিলেন, যিনি নিজের স্বার্থে এরকম একটা কাজ করতে পারেন, তিনি যে কোনো সময় যা খুশি তাই করতে পারেন।
নিজেকে আড়াল করতে বন্দুকের নলটা আজকে দলীয় সহকর্মীদের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন মমতা। তারা অন্তত বুঝতে পারছেন, তাদের। নেত্রী আর যাই হোন, ভরসাযোগ্য নন।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-09-06