ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলাম, অনাথ ছাত্রদের প্রতি শ্যামাপ্রসাদের বিশেষ স্নেহমমতা ছিল। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমে থাকতাম। সেখানে একটি অনাথ ছাত্রাবাসের নাম ‘হিন্দু মহাসভা ছাত্রাবাস’। সাধারণভাবে সেখানে ছাত্রাবাসের নাম হয় ‘ব্রহ্মানন্দ ধাম’, ‘শিবানন্দ ধাম’ ‘যোগানন্দ ধাম’ ইত্যাদি। কিন্তু তার মধ্যে ‘অন্য জাতীয় শব্দ’ ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’ কীভাবে হয়ে গেলো, তার যোগ্য জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। মিশনের সবচাইতে প্রাচীন আশ্রমিক শ্রী বিধুভূষণ নন্দ আমার যাবতীয় প্রশ্নের মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। জানলাম রহড়া বালকাশ্রমে হিন্দুমহাসভার দানও আছে। ১৯৪৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ৩৭ জন বালক-নারায়ণকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বালকাশ্রম। প্রথম কর্মসচিব স্বামী পুণ্যানন্দজী মহারাজ। তাঁর সঙ্গে নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভাপতি ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৪৫ সালে পুণ্যানন্দজীর আমন্ত্রণে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী খড়দায় এসেছিলেন কেবল হিন্দু মহাসভার নেতা হিসাবে নয়, একজন শিক্ষাবিদ হিসাবেও। তিনি এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ছকে দিয়েছিলেন বলে বিধুবাবু জানিয়েছিলেন। রহড়ায় পরবর্তীকালে অনাথ ছেলেদের জন্য কর্মসংস্থানমুখী কারিগরি শিক্ষার পরিকল্পনা সম্ভবত শ্যামাপ্রসাদেরই মানস-ভাবনা৷ এখানকার ছেলেরা খেলাধূলা, সঙ্গীত, অভিনয় — সব বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পাবে এমনটাই চেয়েছিলেন, জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী বিধু মাস্টারমশাই।
হিন্দু মহাসভার কর্ণধার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তার আগে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হত। বাংলাদেশে খুলনার সেনহাটি হাইস্কুল ছিল এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান। নানান কারণে শ্যামাপ্রসাদ এই স্কুলটি চালাতে পারছিলেন না। তিনি পুণ্যানন্দজীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এই সমস্ত ছেলেদের পাঠাতে চাইলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামীজি রাজি হলেন। পরবর্তীকালে ওই ছাত্রদের জন্য গৃহ নির্মাণের ব্যাপারে তিনি হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দান করলেন। এই টাকায় তৈরী হয়েছিল ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’। ১৯৪৫ সালে শ্যামাপ্রসাদ রহড়ায় এসেছিলেন ছাত্রদের দেখতে। ছাত্রদলের মধ্যে ছিলেন সেনহাটি হাইস্কুলের ছাত্র কৃষ্ণকমল চক্রবর্তী বা কেষ্ট, যিনি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন স্বামী নিত্যানন্দ বা কেষ্ট মহারাজ, রহড়া বালকাশ্রমের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ তথা বারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা।
কৃষ্ণকমল হিন্দু মহাসভার শাখা কেন্দ্র কলকাতার কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে ৮নং শিবনারায়ণ দাস লেনের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিছুদিন পর চলে গেলেন হিন্দুমহাসভার খুলনার সেনহাটি হাইস্কুলে। সভার স্কুল উঠে গেলে ১৯৪৪ সালের গোড়ায় কলকাতার ১০ নং নলিনী সরকার স্ট্রিটে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় স্বামী পুণ্যানন্দের কাছে উপস্থিত হলেন তিনি। স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজ বারাকপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্র ‘তত্ত্বমসি’ পত্রিকায় লিখেছিলেন রহড়া বালকাশ্রমের ইতিহাস। তিনি জানিয়েছেন, ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের পর তাঁর মেজদি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে ধরে হিন্দুমহাসভা পরিচালিত একটি ছাত্রাবাসে তাঁকে ভর্তি করে দেন। জানা যায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ততার কারণে আসতে না পারলেও অনাথ ছাত্রদের তিনি খোঁজ খবর নিতেন। অনাথ ছাত্রদের জন্য শ্যামাপ্রসাদের বেদনার্ত হৃদয়, তাঁর সেবাকাজ, আর্তত্রাণের ইতিহাসও বোধহয় হারিয়ে যায়নি। শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে গবেষণা করলে একটি সময় ‘সাম্প্রদায়িক পদবাচ্য’ হতে হতো। ভয়ে-ভক্তিতে তাই সে পথে বিশেষ কেউ আর যাননি। শিক্ষাবিদ হিসাবে তাঁর টুকরো টুকরো বহু উদাহরণ জুড়ে আঞ্চলিক ইতিহাস উপাদানের পুঁথি গাঁথা হয়, তবে সামগ্রিক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
১৩৫৪ বঙ্গাব্দে বা ১৯৪৭ সালে হিন্দু মহাসভা ধাম নির্মিত হয়। হিন্দু মহাসভা ধাম-এর ইতিহাস জানতে ও তা দেখতে রহড়া বালকাশ্রম ভ্রমণ।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।