বাংলাদেশি ক্রিমিনালদের দিয়ে কোচবিহারে তৃণমূল হার্মাদরাজ

লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস উত্তরবঙ্গে একটিও আসন পায়নি। পাহাড় ও সমতল চষে বেড়িয়ে দেদার প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে, উন্নয়ন বোর্ড গড়ে ছোট ছোট জনগোষ্ঠীগুলিকে বিভাজিত করে, চরম সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেও মমতা ব্যানার্জিকে উত্তরবঙ্গ থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছে। নির্বাচনের পরে উত্তরবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা জনরোষের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। স্থানীয় নেতারা তো দূরের কথা সুব্রত বক্সির মতো রাজ্য নেতারাও বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়েও অনেক এলাকায় প্রবেশ করতে পারেননি। প্রহসনের ভোটে নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের সদস্যরা জনরোষের ভয়ে আশ্রয় নিতে থাকেন পদ্ম শিবিরে। পদ্ম শিবির জন পরিষেবা চালু রাখার জন্য হোক কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসকে দুর্বল করার জন্য হোক অনেক জায়গাতেই এই জনপ্রতিনিধিদের হাতে পতাকা তুলে দিয়ে পার্টিতে বরণ করে নেয়। ফলে লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বিজেপিতে বাড়তে থাকে রং পরিবর্তন করা নবাগত মানুষের সংখ্যাও।
পার্টিতে নবাগতদের ভিড় সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছিল বিজেপি নেতাদের। আমজনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠে, দল যেভাবে বাড়ছে তাতে বিজেপির একটি ছাঁকনির প্রয়োজন। এই জোয়ারের মধ্যে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের মার্কামারা জেহাদি হার্মাদরাবিজেপির ছাকনিতে আটকা পড়েছিল। উত্তরবঙ্গে এই জেহাদিদের দিয়েই এখন তৃণমূল কংগ্রেস ঘুরে দাড়ানোর চেষ্ঠা করছে। ফলস্বরুপ এখন কোচবিহার হয়ে উঠেছে রণক্ষেত্র। গত একমাস ধরে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা থেকে সংঘর্ষের খবর আসছে। তৃণমূলের পতাকা দিয়ে মুখবাঁধাহার্মাদরা মোটর সাইকেল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কোচবিহার জেলার সর্বত্র। সন্ধ্যের পর অনেক জায়গাতে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিপদের আশঙ্কায় মানুষ নিজেদের ঘরবন্দি করে রাখছেন। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয় প্রকাশ্য দিবালোকে মাথাভাঙ্গা, তুফানগঞ্জ, দিনহাটার মতো শহরেও এদের দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায়। বিজেপির কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী দেখলেই ওরা ঝাপিয়ে পড়ছে। প্রকাশ্যে বোমাবাজি করছে, গুলি ছুড়ছে। পুলিশ নির্বিকার। অনেক জায়গাতে পুলিশ প্রকাশ্যে হার্মাদদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছে। এদের নিশানা থেকে বাদ যাচ্ছে না রক্তদান শিবিরও।
গত ১৬ আগস্ট কোচবিহারের মাথাভাঙ্গায় পূর্বর্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রয়াণ দিবসে বিজেপির শ্রমিক শাখা স্থানীয় ঝংকার ক্লাবে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল। তখন বেলা আড়াইটে। রক্তদাতারা রক্তদানে ব্যস্ত। কেউ রক্তদিয়ে বসে বিশ্রাম করছেন, আবার কেউ রক্ত দিচ্ছেন। ক্লাব থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে চারটি স্কুল। সবকটিতে পঠনপাঠন চলছিল পুরোদমে। প্রতিদিনের মতোই মাথাভাঙ্গা শহরে জনতার ভিড়ে জমজমাট পরিবেশ। এমন সময় হঠাই করে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা দিয়ে মুখ বাঁধা এক দল সশস্ত্র হার্মাদ ঝাঁপিয়ে পড়েরক্তদান শিবিরের উপরে। ক্লাবের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা রক্তদাতাদের মোটর সাইকেলগুলি লোহার রডদিয়ে পিটিয়ে ভাঙতে শুরু করে। একই সঙ্গে চলতে থাকে রক্তদান শিবির তছনছ করার প্রক্রিয়া। আক্রান্ত হন রক্ত নিতে আসা ডাক্তার-নার্সরা, বাদ যাননি বিছানায় ওয়ে থাকা রক্তদাতারাও। যে যেদিকে পারেন ছুটে পালাতে শুরু করেন। সংগৃহীত রক্ত পড়ে থাকে ক্লাব ঘরের মেঝেতে। ছুটে আসে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে দেখলো আক্রমণ কারীদের কিছুই হলো না। আক্রান্তরা অনেকেই পুলিশের লাঠি খেয়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলেন। এই ভরদুপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে হার্মাদরা সর্বসমক্ষে শূন্যে গুলি ছোঁড়ে, বোমা নিক্ষেপ করে। অবশেষে শহরের বুকে সশস্ত্র মিছিল করে। আতঙ্কিত মানুষ ছুটতে শুরু করে, স্কুলগুলি গেট বন্ধ করে বাচ্চাদের আটকে রাখে। মাথাভাঙ্গাবাসীহতভম্ব হয়ে পড়েন। কারণ এর আগে মাথাভাঙ্গার ইতিহাসে এমন ঘটনার কথা কেউ মনে করতে পারেননি। মানুষ বলাবলি করছিল বাংলাদেশের অপরাধীদের নাকি নিয়ে আসা হয়েছে রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধার করার জন্য।
কোচবিহার জেলার সিতাই শীতলখুচি, দিনহাটা, দেওয়ানহাট, ভেটাগুড়ি সর্বত্রই অচেনা সশস্ত্র যুবকরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রয়োজনমতো ঝাপিয়ে পড়ছে বিজেপির কর্মসূচির উপর। প্রশাসন নির্বিকার। জেলা জুড়ে গুঞ্জন বিভিন্ন এলাকায় গুঞ্জন, বাংলাদেশি গুন্ডাদের নাকি তৃণমূল এলাকা দখলের কাজে লাগাচ্ছে। জনগণ নয় হার্মাদ বাহিনীই এখন তৃণমূলের রাজনৈতিক শক্তির উৎস। জনভিত্তি থাকলেও হার্মাদ বাহিনী ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আবার শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
যে সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি বিজেপিতে যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে কিছু কিছু আবার তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে যাচ্ছে। এই লোকসভা নির্বাচনের পর পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের এই দল বদল আর প্রতিদিনের জামা কাপড় বদল সমার্থক হয়ে দাড়িয়েছে। এ যেন এক চরম রাজনৈতিক মূল্যবোধহীনতা। বিজেপিকেও এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। মানুষ চাইছে দলবদলুদের দিয়ে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখলের পথ থেকে বিজেপি সরে আসুক। মূল্যবোধের উপর নির্ভর করে, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধদের দিয়ে দল চালাক না হলে বাম ও তৃণমূল কংগ্রেসের গড়ে তোলা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে বিজেপির নীচুস্তরের কর্মীদের হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
সাধনকুমার পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.