একেই বোধ হয় বলে বিনাশ কালে বুদ্ধি ভ্রম! নইলে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের এই সংকটকালে মুকুল চন্দ্র বৈরাগ্যের হাতে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ভালো মন্দ বিচারের ভার! নমশূদ্র বিকাশ পরিষদ কী কী তার। ক্ষমতা, কী তার উদ্দেশ্য, তা খায় না মাথায় মাখে, নমঃশূদ্র সম্প্রদায় তা বুঝে ওঠার আগেই বিকাশ পরিষদের নেতা হিসাবে বৈরাগ্যবাবুকে দেখা গেল ক্ষয়িষ্ণু রাজ্য সরকারের সুরে সুর মেলাতে। যে বেচারা জনপ্রতিনিধি নন তিনি কতজন শূদ্রের অভিমত নিয়ে একাজ করছেন ? নাগরিকত্ব বিল পাশের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কী ক্ষমতা? আদৌ এ বিল পাশের ক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা আছে কি-না এই বিষয়ে সাত পাঁচ না ভেবে কেন্দ্রের বিরাগভাজন হওয়া বোধহয় বৃহত্তর শূদ্র সমাজের মধ্যে সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছে। শুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাঙন তো ছিলই হয়তো সেকারণেই তা এবার ত্বরান্বিত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে আজ তাই কাতারে কাতারে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে মতুয়া ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন। কী শক্তি আছে মুকুল চন্দ্র বৈরাগ্যের যিনি এই বৃহত্তর ভাঙন থেকে শূদ্র সমাজকে রক্ষা করবেন?তাঁর কাছ থেকে আর কিই বা পাওয়ার আছে! তিনিশূদ্রদের আকৃষ্ট করে রাখবেন চির বঞ্চনার চির উপক্ষোর শূদ্ৰত্বে!
বর্তমানে মতুয়া সম্প্রদায়ের যিনি নেতৃত্বে রয়েছেন শূদ্র জাগরণের ক্ষেত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের যে অবদান যে ত্যাগ তা সর্বজনবিদিত। শান্তনু ঠাকুর বর্তমানে তিনি একজন জনপ্রতিনিধি, জননায়ক; ব্যাপক তাঁর সম্মোহনী শক্তি। তিনি চালিত হন জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে। মতুয়াদের এবং বৃহত্তর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তার পূর্বপুরুষশ্রীশ্রী হরি চাদ– গুরুচঁাদ ঠাকুরের রয়েছে সুদূর প্রসারী প্রভাব। যার নাই দল তার নাই বল’ কিংবা ‘হাতে কাম মুখে নাম’এ তো বাণী নয়, ভক্তদের কাছে যেন বৈদিক মন্ত্র। শূদ্র সম্প্রদায় থেকে পরিবর্তিত হওয়া মতুয়া সম্প্রদায় এবং অবশিষ্ট শূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীশ্রী গুরুচঁাদ ঠাকুরের পথনির্দেশ রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরায় শিরায় হয়তো তা মজ্জাগত হয়ে গেছে। তদুপরি সম্মাননীয় সাংসদ মতুয়া মহা সঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরের নির্লোভ নিরহংকারী মানসিকতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোশহীন সংগ্রাম স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে জননায়ক করে তুলেছে। সবচেয়ে বড়ো যে। কথা সর্বহারারা তাঁকে ভরসা করা শুরু করেছেন। এমন নয় যে যারা শুধু বিজেপি করে তাদেরই তিনি আকৃষ্ট করে রেখেছেন। তার জাত পাত হীন এহং বিভেদ হীন মানসিকতায় আজ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের কাছে তিনি নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন। একবার ভাবুনতো গত লোকসভা উপনির্বাচনে তাঁরই সহোদর যেখানে তিন লক্ষাধিক ভোটে পিছিয়ে ছিলেন সেখানে আজ তিনি কোন জাদুবলে বিপুল ভোটে জয়ী হন? এমনকী নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বিজেপির সংগঠনের সঙ্গে মৃদু সংঘাতের কথা কে না জানে। আজ বাপের বয়সিরা পর্যন্ত শান্তনু ঠাকুরের মহিমার কাছে বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত করছেন। প্রশ্ন সে কোন মহিমার গুণে ?
মুকুল চন্দ্র বৈরাগ্যের ক্ষেত্রে অসুবিধা হলো তাঁর পূর্বপুরুষ সম্পর্কে এমন কিছু জানা যায়না যা অতীতশূদ্র জাগরণের সহায়ক ছিল। তদুপরি তার নিজস্ব কোনো জনভিত্তিও নেই। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার শূদ্র জাগরণের এক হোতাকে আমি বৈরাগ্যবাবুর কথা জিজ্ঞেস করতে উনি বেশ কিছুক্ষণ আমতা আমতা করেন। কে, মুকুল? মানে আসলে আমি বলতে চাইছি সমন্বয়ের অভাবের কথা। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্তমানে যে সমস্ত গুণীজন রয়েছেন, যাদের কল্যাণমূলক কাজের সংগ্রামী ইতিহাস রয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় কোথায়? একা মুকুল চন্দ্র বৈরাগ্য কি শূদ্রদের ভাঙন রোধ করতে পারবেন? সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হলো উদ্বাস্তু হিন্দুদের পুনর্বাসন এবং নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকার ২০১৪, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ-সহ কতিপয় দেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলেছেন। এটা ঠিক নাগরিকত্ব বিল পাশ না। করে অসমের মতো রাজ্যে এনআরসি করা ঠিক হয়নি। ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার তা যে বুঝতে পারেনি এমন নয়। তাই এনআরসি-র উপযোগিতা না বুঝে আগ বাড়িয়ে তার বিরোধিতা করতে যাওয়া শূদ্র সম্প্রদায়ের কাছে যেমন আজব লেগেছে। তেমনি রাজ্য সরকারের তোষামোদ করতে গিয়ে বৈরাগ্যবাবু শূদ্রদের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছেন। পাল্লা কেপিসি উচ্চবিদ্যালয়ে বিকাশ পরিষদের একটি সভায় যে মুহূর্তে তিনি রাজ্য সরকারের সহযোগিতার কথা বলতে যান অমনি সমাগত লোক সভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। আশাহত লোকেদের মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কিনমশূদ্র বিকাশ পরিষদের টাকা রাজ্য সরকারের গুণগান প্রচারের জন্য বৈরাগ্যবাবু এই ভাবে খরচ করে চলেছেন? সেটা তো মারাত্মক রকমের অপরাধ। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি যখন দিয়েছে নাগরিক বিল পাশ হয়ে গেলে অসাম্যের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা একজন উদ্বাস্তু অসমের শিকার হবে না তখন সেই সরকারের বিরাগভাজন না হয়ে বরঞ্চ তার উপর ভরসা রাখাই শ্রেয়। এমনকী বর্তমানে উদ্বাস্তু আন্দোলনের যিনি প্রাণপুরুষ সেই সুবোধ বিশ্বাস পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এই সদর্থক মানসিকতার জন্য তার সারা ভারত বাঙ্গালি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির হয়ে আশা পোষণ করেছেন। নাগরিক বিল যাতে সত্বর পাশ হয় তার জন্যে ডক্টর বিশ্বাসের মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াসেরও অন্ত নেই। তার সাফ কথা নিঃশর্ত নাগরিকতা দানে কেন্দ্রীয় সরকার বিন্দুমাত্র টালবাহনা করলে কোনো ক্ষমা নেই, গড়ে তোলা হবে জোরদার আন্দোলন।
কেন্দ্রের আনা নাগরিকত্ব বিলের কতগুলো বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিলে পরিষ্কার বলা আছে ১৯৭১ সালের পরে ওপার বাংলা থেকে আসা একজন মুসলমানকে এদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। এটা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও বটে। রাজ্য সরকার সুদ্ধ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করতে গিয়ে তাদের দুধ দেওয়া গোরু’র সঙ্গে তুলনা করে এনআরসি-র মতো সময়োপযোগী মহতী প্রয়াসকে বানচালের চেষ্টা করে চলেছে। ওপার বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু হিন্দুরা কিন্তু ঢাকার দাঙ্গা, কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে নোয়াখালির দাঙ্গার কথা ভোলেননি। আগে বুঝতে হবে বৃহত্তর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের নাড়ির স্পন্দন। বৈরাগ্যবাবু ভুলে গেলেও উদ্বাস্তু হিন্দুরা ভোলেনি প্রিয় মাতৃভূমিকে কেন তাদের ছেড়ে আসতে হয়েছে। আজনাগরিকত্ব বিল পাশের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের বাধা কোথায় ? এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক বিল পাশের পর এন আর সি হলে ১৯৭১ সালের পর ওপার বাংলা থেকে আগত মুসলমানদের একটা বিরাট অংশকে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে নতুবা দেশ ছাড়া হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত রাজ্য সরকারের দরদ তাদের প্রতিই সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা রাজ্য সরকারের কাছে ‘দুধ দেওয়া। গোর’। মুকুলবাবুর দূরদর্শিতার অভাব এখানেই। ক্ষয়িষ্ণু রাজ্য সরকারের তোষামোদ করতে গিয়ে বিলের তিনি বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলেছেন যা বোধ করি কোনো নমঃশূদ্রের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। আর জেনে বুঝে তিনি যদি ভাবের ঘরে চুরি করতে যান ভবিষ্যৎ অনেক পরিণাম নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবে। কাল যে তাকে ক্ষমা করবে না সে কথাও আমি হলফ করে বলতে পারি।
‘৭১ সালের পরে আসা যে লোকগুলোর জন্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আজ নাকের জল চোখের জল এক করছেন অন্তত উদ্বাস্তু নমঃশূদ্ররা কোনোদিনই ভুলবেন না ওই লোকগুলোই তাদের মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়েছে। জানি না কীসের স্বার্থে কোন লোভে আজ বৈরাগ্যবাবুর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে রাজ্য সরকারের কণ্ঠস্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, উলুবনে মুক্ত ছড়িয়ে আপনার ব্যক্তিগত লাভ হলেও শূদ্র সম্প্রদায়ের তা কোনো উপকারে আসবে না। শূদ্রদেরকে যদি সঙ্ঘবদ্ধ করতে হয়, ভাঙন যদি রদ করতে হয় উদার মনে আলোচনায় বসতে হবে ড. সুবোধ বিশ্বাসের সঙ্গে। জগন্নাথ সরকার, শান্তনু ঠাকুর-সহ আরও যাঁরা সংগ্রামী মানুষ আছেন তাঁদেরকে এক ছাতার তলে আনতে হবে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে হবে শূদ্রদের কাছের মানুষ। এগিয়ে। যেতে হবে তাদের রায় নিয়ে। আপনার রায় শূদ্রদের উপর চাপিয়ে দিলেতো হবে না, যেখানে আপনি জনপ্রতিনিধি নন।
শূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এই যে ভাঙন তা দ্রুত রুখতে হলে বৈরাগ্যবাবুকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অর্জন করতে হবে তাদের বিশ্বাস। মনে রাখতে হবে, শূদ্র সম্প্রদায়ই যদি না থাকে তবে তার বিকাশ পরিষদে লাভ কোথায় ? নমঃশূদ্র বিকাশ পরিষদের দায়িত্ব পাওয়ার পর এযাবৎ শূদ্র উন্নয়নের জন্য আপনি কী করতে পেরেছেন আশু তার একটা খতিয়ান তুলে ধরা দরকার। যদি রাজ্য সরকার আপনার চাহিদা পূর্ণ করার গরজ না দেখায় চাহিদা পূরণের ক্ষমতা না থাকে তবে তার চাটুকারিতা করে কী লাভ? তদুপরি বর্তমান রাজ্য সরকার অদি দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু একটি দল, এমনকী আগামী নির্বাচনে তারা হয়তো ক্ষমতাও হারাবে। সুতরাং যে দল শূদ্রদের মূল যে দাবি নাগরিকত্বের তা পূরণ করতে পারবে না বা পূরণের ক্ষমতা রাখে না শুধু লোক দেখানো পরিষদ তৈরি করে আপনাকে বিড়ম্বনায় ফেলবে, আমার কথা সে দলের তল্পিবাহক হওয়াতো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরঞ্চ নাগরিকত্ব বিল কীভাবে পাশ করানো যেতে পারে সে বিষয়ে কৌশলী হতে হবে। বৃহত্তর স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে কারো অভিমানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে আম ছালা দুটোই হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। আমার মনে হয়, শুদ্র সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার্থে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে নামতে গিয়ে ব্রঞ্চ যদি সমঝোতা করে লাভ হয় তবে তাই করা উচিত। শ্রীমান শান্তনু ঠাকুর যদি কেন্দ্রীয় সহায়তায় মতুয়াদের দাবি প্রতিষ্ঠায় সফল হয়, অবহেলিতশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষরাই বা তখন কেন শূদ্ৰত্বে পতিত হয়ে থাকবে? গুজব কিনা জানি না, তবে এটা জনরব বৈধ মতুয়া কার্ড থাকলে ভারতবর্ষের বুকে কেউ আপনার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। অথচ ক’দিন আগে মাত্র বিকাশ পরিষদের কর্ণধারকে জনৈক গায়ককে অবৈধ অভিবাসনের দায়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে ফেসবুকে করুণ ভাবে তার জন্য আইনি সহায়তা প্রার্থনা করতে দেখা যাচ্ছে। এ কত বড়ো অসহায়তা! আজ নাগরিকত্ব বিল পাশ করে শান্তনু ঠাকুর যদি উদ্বাস্তু নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অভিশাপ মোচন করতে পারে তবেশূদ্র জাগরণের প্রভাতী তারা গুরুচঁাদ ঠাকুরের মতো শান্তনু ঠাকুর হবেন শূদ্র সম্প্রদায়ের নয়নের মণি আর কাতারে কাতারে নমঃশূদ্ররা সেদিন অভিশাপ মুক্তির লক্ষ্যে দীক্ষিত হবে মতুয়া ধর্মে। বৈরাগ্যবাবু। কী পারবেন সেই ভাঙন রক্ষা করতে, হয়তো ভবিষ্যই তার জবাব দেবে।
কৃষ্ণ প্রসাদ বিশ্বাস
(লেখক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক)
2019-09-06