হে সেক্যুলার বাঙালী, আপনার নেক্সট স্টপ কোথায়? ভাবলেন কিছু?

প্রথমে আপনার পাড়ায়, বাড়ির সামনের রাস্তায়, চায়ের দোকানের পাশে, ইতিউতি দু’-চারটি স্কাল ক্যাপ বা বোরখা দেখতে শুরু করবেন। আপনি সেকুলার বাঙালী। আপনি অবজ্ঞা করবেন।

এরপরে আপনি বাজার করতে গিয়ে আপনার পাশেই গোঁফ বিহীন ছাগদাড়িওয়ালা কাউকে দোকানদারের সাথে দরদাম করতে দেখবেন। আপনার পাড়ার মিষ্টির দোকান থেকে আপনার পাশে দাঁড়িয়েই মিষ্টি কিনতে দেখবেন গোড়ালির অনেকখানি ওপরে ঝুল বিশিষ্ট পায়জামা পরা কাউকে। অবশ্যই আপনি সেক্যুলার বাঙালী। আপনি ইগনোর করবেন।

আপনি ফ্ল্যাটে থাকেন। হঠাৎ আপনার ওপরের বা নিচের ফ্লোরের চিৎকার চেঁচামেচি বেড়ে যাবে। মধ্যবিত্ত শান্তি বিঘ্নিত হওয়াতে আপনি কিঞ্চিত ক্ষুণ্ণ হবেন। নবাগত প্রতিবেশীটির অমায়িক ব্যবহার আপনাকে মুগ্ধ করবে। তবে অতগুলি বাচ্চাকাচ্চার কিচিরমিচির আপনাকে বেশ বিরক্ত করবে। কিন্তু মুখে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। আপনি “একই বৃন্তে দুটি কুসুম” পড়া সেক্যুলার বাঙালী।

একদিন আপনার কিশোরী কন্যাটি কোথাও যাবে বলে বাস ধরতে পাড়ারই বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে। হঠাৎই আপনার ওপর বা নিচের ফ্লোরের কাচ্চাবাচ্চাগুলির বড়টি আরও দুটি বন্ধু নিয়ে হাজির। সাথে বাইকও রয়েছে। আপনার কন্যার পাশে দাঁড়িয়ে নাগাড়ে আদিরসাত্মক আলোচনা শুরু হবে। ইগনোর করবার পাঠ আপনি আপনার কন্যাকে ভালোই দিয়েছেন। সে তাইই করবে। কিছুক্ষণ বাদে অধৈর্য হয়ে, আপনার কন্যার হাতে টান পড়বে। এবার আপনার কন্যা চেঁচাবে। ভীড় জমবে। ছেলেগুলি পালাবে। কন্যাকে আপনি বাড়ি নিয়ে আসবেন। আপনি মর্মাহত। তবে যেহেতু আপনি সেক্যুলার বাঙালী, ছেলেগুলির কদর্য ব্যবহারে মর্মাহত হয়েও, সমগ্র বিষয়টিকে আপনি ইগনোর করবেন।

তারও পরে, একদিন দেখবেন আপনার ফ্ল্যাটের সামনের খোলা জমিটিতে প্যাণ্ডেল খাটিয়ে ওয়াজ মেহফিল হচ্ছে। সরস্বতী পুজোর প্যাণ্ডেল আপনি দেখেছেন। দেখেছেন দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রী পুজোর প্যাণ্ডেলও। কিন্তু ওয়াজের প্যাণ্ডেল আপনি এই প্রথম দেখলেন। একসাথে অতগুলি স্কাল ক্যাপও আপনি প্রথমই দেখছেন। আপনি অবাক। পাড়ায় কবে এত কুসুম এল! কিন্তু আপনি সেক্যুলার বাঙালী। সব ধর্মের সমান অধিকার এবং সহাবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। অতএব আপনি ইগনোর করবেন।

এক রাত থেকে আপনার মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পড়তে যাওয়ার কথা তার। নটার মধ্যে সচরাচর ফিরে আসার কথা। কিন্তু সেদিন রাত এগারোটা বেজে যাবে, আপনার মেয়ে ফিরবে না। মোবাইলও স্যুইচড অফ। থানায় যাবেন আপনি। অফিসার কিন্তু পাত্তা দেবেন না খুব একটা। আপনি, আপনার অর্ধাঙ্গিনী, সকলেই চরম উদগ্রীব, উৎকণ্ঠিত। স্বাভাবিকও। কদিন বাদে আপনার গিন্নির মোবাইলে ফোন আসবে। আপনার কন্যার বর্তমান নাম – মেহেরুন্নিসা খাতুন। ধর্ম যার যার উৎসব সবার – এই তত্ত্বই জানেন আপনি। কিন্তু কন্যার নাম পরিবর্তনের এই উৎসবটা আপনার ঠিক হজম হবে না। তবুও ব্যাপারটায় আপনি চুপই থাকবেন। আফটার অল আপনি সেক্যুলার বাঙালী।

আজকাল আর পাড়ায় বেরোতে পারেন না আপনি। রঙীন দাড়ি, সুর্মা, স্কাল ক্যাপ, বোরখা এসবের ভীড়ে নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগে। তার ওপর আপনার আবাসনের সামনের ফাঁকা জমিটায় একটা বড় মসজিদ তৈরি হওয়া ইস্তক সমস্ত পাড়ার পরিবেশটাই যেন বদলে গিয়েছে। বাজারে আগে মাছ মাংসের দোকান ছিল। এখন বড় বড় গোরুর থান ঝোলে। অবশ্য আপনি সেক্যুলার বাঙালী, আপনার খুব একটা তফাৎ হয়না। তবে গন্ধটায় আপনি বিলক্ষণ অস্বস্তি বোধ করেন। তবে অস্বস্তি বোধ করেও আপনি চুপই থাকেন। বিলক্ষণ আপনি সেক্যুলার বাঙালী।

একদিন রাতে, আবাসনের সামনেটায় ঘোর কোলাহল। আপনি উঁকি মেরে দেখলেন। রাস্তায় অন্তত হাজার খানেক লোকের ভীড়। হাতে অস্ত্রশস্ত্রও বিদ্যমান। “সর তন সে জুদা” স্লোগানও উঠছে ভীড় থেকে। আপনি বজ্রাহত। আলোটালো নিভিয়ে চুপ করে শোবার ঘরে বসে রইলেন। হঠাৎ মেইন গেটে ধাক্কা। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজাটা খুললেন আপনি। এক রাশ অশ্রাব্য শব্দের পরে, মূল বাণীটি শুনতে পেলেন আপনি। আজকের রাতটা সময় দেওয়া হচ্ছে। বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে ভোরের মধ্যে আপনাকে সপরিবারে সরে পড়তে হবে।
এই নির্দেশনা কিন্তু আপনি ইগনোর করতে পারবেন না। মানতেই হবে।

হে সেক্যুলার বাঙালী, আপনার নেক্সট স্টপ কোথায়? ভাবলেন কিছু?

কৌকিরা