গ্রামের বাঙ্গালি হিন্দু মনে করে বিজয়া মানে মা দুগ্নার বিসর্জন । শহরের বাঙ্গালি মনে করে বিজয়া মানে সামাজিক প্রথা – পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় । ছােটরা মনে করে বিজয়া মানে বড়দেরকে প্রণাম করে নারকেল নাড়ু বা মিষ্টি খাওয়া । সব মিলিয়ে বিজয়া মানে একটা উৎসব , আনন্দ , হৈ হৈ । আর এই সব হবে মা দুর্গাকে জলে ভাসানাের পর । আচ্ছা , দুর্গাকে তাে বাঙালি ঘরের মেয়ে মনে করে । বৎসরান্তে তার বাপের বাড়িতে আসা । আমরা তার বাপের বাড়ির লােকজন । তাই তাঁর আসা উপলক্ষে আমাদের এত আনন্দ । সেই মেয়ে চারদিনের ছুটির শেষে আবার যখন তাঁর পতিগৃহে ফিরে যাচ্ছে , আবার একবছর তাঁর দেখা পাবো না , চোখের জলে আমরা তাঁকে বিদায় দিচ্ছি , ঠিক তারপরেই এত আনন্দ উৎসব , এত মিষ্টি খাওয়া হিসাবে মেলে কি ? ব্যাপারটা উল্টো হয়ে যাচ্ছেনা ?
আর এর নাম বিজয়া-ই বা কেন ?
কোনাে ডিক্সনারিতে কি পাওয়া যাবে বিসর্জন বা বিদায় শব্দের সঙ্গে বিজয় শব্দটির কোন সম্বন্ধ আছে ? তাহলে মা দুর্গাকে যখন চোখের জলে বিদায় দিচ্ছি ঠিক তার পরেই বিজয় শব্দটাই বা এল কি করে , আর আনন্দ উৎসবই বা কেন ?
আহা , বাঙালি যদি এর কারণটা জানত , তাহলে আজ বাংলার চেহারাটাই অন্য রকম হত । শুধু এ বাংলাটাই নয় , ও বাংলাটাও । বাংলার বাইরে অনেকে প্রশ্ন করে , দুর্গাপূজা বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব । এই উৎসবে বাঙালি আনন্দে মাতােয়ারা হয়ে ভেসে যায় । তাহলে বাংলায় নাস্তিক কমুউনিষ্টদের এত প্রভাব কেন ? দুর্গা – কালী ভক্ত এই বাংলায় অধার্মিক কম্যুনিষ্টরা কি করে ৩০ বছর ধরে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ? বিজয়ার প্রশ্ন , আর এই কম্যুনিষ্ট প্রশ্ন – দুটো প্রশ্নেরই উত্তর এই যে বাঙালী পূজো করে আর বিজয়া করে , দুটোই না বুঝে । তাই দুর্গাপূজাকে বছরের বৃহত্তম উৎসব হিসাবে নিয়েও সম্পূর্ণ পূজা বিরােধী কমুনিষ্ট পার্টির ঝান্ডা ধরতে ভােট দিতে বাঙ্গালির কোনাে অসুবিধা হয় না । এটা কি বাঙালির আত্মপ্রবঞ্চনা , দুমুখাে সুবিধাবাদী নীতি ? অনেকটা , সবটা নয় । অজ্ঞতাও বটে । সুবিধাবাদী নীতি ও অজ্ঞতার যােগফল ।
অজ্ঞতাটা কি ?
ধর্ম সম্বন্ধে না জানা । বিজয়া সম্বন্ধে না জানা । না জেনে পালন করা । জানলে হয়ত করত না । কী করত না ? হয় ধর্ম করত না , অথবা কমিনিজম করত । কারণ ধর্ম করে মার্কসবাদ করা যায় না এবং মার্কসবাদ করে ধর্ম করা যায় না । এই অজ্ঞানতা যদি আরও দীর্ঘদিন চলে , তাহলে কোনদিন হয়ত দেখব মা দুর্গার পিছনের চালিতে মাথার উপর যেখানে শিবের ছবি থাকে , সেখানে মার্কসের ছবি ঢুকে গেছে । তখন কে বেশি অসন্তুষ্ট হবে মার্কস না মা দুর্গা -বলা কঠিন ।
এখন আসা যাক বিজয়ার প্রশ্নটাতে । বিদায় , বিসর্জন , গঙ্গার ধারে আঁখি ছলােছলাে , তার সঙ্গে মিষ্টি খাওয়া , শুভেচ্ছার কোলাকুলি , পােস্টকার্ড , গ্রিটিংস কার্ড , SMS- এর মিল কোথায় ? এর উত্তরটা ভালােভাবে দেওয়া যাক । বহুদিক থেকেই এই উত্তরটা গুরুত্বপূর্ণ ।
এই উত্তরটা ভালােভাবে জানতে গেলে এর সঙ্গে জড়িত আর একটা প্রথার ব্যাপারে জানতে হবে । তা হল বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের আগে সধবা মহিলাদের সিঁদুর খেলা । এই সিঁদুর খেলার সঙ্গে বিজয়ার প্রণাম , কোলাকুলি , মিষ্টি খাওয়া অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ।
আসা যাক উত্তরে । মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে মহিষরূপী মহিষাসুর বধ করলেন মা দুর্গা । সেখান থেকে দৈত্য রূপ নিয়ে বেরিয়ে এল ঐ অসুর । নবমী তিথিতে তাকে বধ করলেন মা দুর্গা । বিজয় লাভ সম্পূর্ণ হল । তাই দশমীতে পালন হল বিজয় উৎসব , নাম যার বিজয়া বা বিজয়া দশমী । এই ঘটনা ঘটেছিলাে সত্য যুগে । কোন এক বসন্ত কালে । এল ত্রেতা যুগ । অধার্মিক অত্যাচারী পরনারী হরণকারী রাবণকে ধ্বংস করার জন্য রামচন্দ্র দেবী দুর্গার পূজার আয়ােজন করলেন । সে সময় বসন্ত কাল ছিল । কিন্তু রামের হাতে সময় নেই । যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । তাই শরৎ কালে অকালেই দেবীর পূজা করলেন । যুদ্ধে রাবণ বধ হল । সুতরাং প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে দেবী দুর্গার আরাধনা করলে যুদ্ধে জয় লাভ হয় । তাই বিজয়া দশমী শুধু বিজয় লাভের জন্য উৎসবই নয় , ওই দিনটা বিজয় লাভের জন্য , যুদ্ধ শুরু করার জন্য একটা শুভ দিন পবিত্র দিন হিসাবেও গণ্য হতে লাগল । সুতরাং ক্ষত্রিয় রাজাদের কাছে ওই দিনটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠলাে । বিজিগীষু রাজারা তাদের রাজ্যের সীমা বাড়ানাের জন্য ওই দিন যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলেন । শুরু হয়ে গেল নতুন পরম্পরা । ওই দিনটা পালিত হতে লাগল ‘“সীমােল্লঙঘন দিবস”’ হিসাবে । নিজের সীমা অতিক্রম করে অভিযান করা । উদ্দেশ্য রাজ্য বাড়ানাে ।
এখন রাজা যখন যুদ্ধে যাবেন , একা তাে যাবেন না । তাঁর সঙ্গে সৈন্য দল যাবে । এই সৈন্য তাে প্রজাদের মধ্য থেকেই আসে । তারাও যুদ্ধে যাবে । আর সবাই জানে যুদ্ধে গেলে বাঁচা-মরার নিশ্চয়তা নেই । যুদ্ধে সে আহত বা নিহতও হতে পারে । এক বিপদ সংকুল অনিশ্চিত যাত্রা । উদ্বেগ উৎকণ্ঠা হবে কিনা ? তার নিজের এবং আত্মীয় পরিজনের , বন্ধুবান্ধবের । স্ত্রী-পুত্র কন্যার । তাই সে যুদ্ধে যাবার আগে সকলের কাছে বিদায় নিতে যায় । বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে যায় ।
বড়রা গুরুজনরা আশীর্বাদ করেন এবং মিষ্টি খাওয়ান । ছােটরাও তাকে প্রণাম করে ও আশীর্বাদ নেয় । আর সে তার বন্ধু বান্ধব সমবয়স্কদের আলিঙ্গন কোলাকুলি করে বিদায় গ্রহণ করে । তারাও তাকে বিদায় শুভেচ্ছা জানায় । আর ঐ যে সৈন্যটি , তার স্ত্রী তাে হবে সব থেকে বেশি উৎকণ্ঠিতা । কে জানে তার স্বামী ফিরবে কিনা ? যদি না ফেরে তাহলে সে হবে বিধবা । এরকম অনেক স্ত্রী ।তাই তারা যায় মা দুর্গার কাছে , ওই দিনই । সিঁদুর ঢালে মা দুর্গার পায়ে । তারপর সেই সিঁদুর পরিয়ে দেয় পরস্পরের সিথিতে । আশা– মা দুর্গার চরণছোঁয়া সিদুর , এ তাে পবিত্র , এর তাে অনেক শক্তি । এই সিঁদুর আমার সিঁথিতে পরালে কারাে শক্তি নেই এই সিঁদুর মােছে । এ সিঁদুর হবে অক্ষয় । সুতরাং আমার স্বামী যুদ্ধে নিরাপদ থাকবে । সেই আশায় সিঁদুর পরানাে । তাই এই সিঁদুর খেলা । একটু পরেই স্বামী বেরােবে সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধে । সুতরাং এই সিদুর খেলা । এবং বিজয়ার প্রণাম কোলাকুলি মিষ্টি খাওয়া এ কোনােটাই আনন্দের উৎসব নয় । মা দুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে আনন্দ করা যায় না ।
এসব হচ্ছে যুদ্ধ যাত্রার ঠিক পূর্বের কার্যকলাপ , নিরাপত্তা কামনায় এবং বিজয় কামনায় । অর্থাৎ সিঁদুর খেলা ও বিজয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আমাদের পূর্বপুরুষদের যুদ্ধ যাত্রার ইতিহাস । আজ বাঙ্গালি ওই কার্যকলাপ গুলােকে অনুষ্ঠানরূপে ধরে রেখেছে । ভুলে গিয়েছে এর ইতিহাস ও তাৎপর্যকে এবং হয়ে গিয়েছে এক যুদ্ধ বিমুখ জাত । আর পুরুষানুক্রমে এই যুদ্ধ বিমুখতা বাঙ্গালিকে পরিণত করেছে এক ভীরু কাপুরুষ পলায়নপর জাতে , যে জাত লড়তে জানে না , পালাতে জানে । তাই বাংলা ভাগ হয় , বাঙ্গালি রিফিউজি হয় ।
এখন বিজয়াদশমী হয়ে গেছে ‘ শুভদিন ‘ । কিসের ? গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি কাজের জন্য । বাঙালি যদি বিজয়ার কোলাকুলির আসল ইতিহাসটা জানতাে , তাহলে হয়ত এমন যুদ্ধ ভীরু জাতে পরিণত হত না । কিংবা হয়ত আসল ইতিহাসটা । জানলে ওরে বাবা দরকার নেই ‘ বলে প্রথাটাই বাদ দিয়ে দিত ।
এখন এই ইতিহাসের অন্য একটা দিকে তাকানাে যাক । এই বাংলায় তাে ক্ষত্রিয় ছিলাে না। ইতিহাসে যতদূর চোখ যায় , দেখা যায় এই বাংলায় জাত ছিল , বর্ণ বা বর্ণপ্রথা ছিলনা । খুব সম্ভব বর্ণাশ্রমও ছিল না । সেইজন্যই নাকি । পান্ডবরা সারা ভারত চষে বেড়ালেও বাংলায় । ঢােকেনি । তাই এই বাংলাকে বলা হত পান্ডববর্জিত রাজ্য । তাহলে ক্ষত্রিয় না থাকলেও ওই প্রথা ও পরম্পরা গুলি তাে এই বাংলাতেই আমরা প্রবল ভাবে দেখতে পাই । অর্থাৎ উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয়দের মত বাঙালি যুদ্ধে যেত । এর থেকে দুটো সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসছে ।
এক , বাঙালি বা এই বাংলার অধিবাসীরা যুদ্ধ করত ।
দুই , বাংলা ও বাকী ভারতের ইতিহাস ও পরম্পরা একই । অতি প্রগতিশীল বামপন্থী । ইতিহাসকার ও বুদ্ধিজীবিরা বাংলা ও বাঙালির উৎসবকে বাকী ভারতের থেকে আলাদা করে দেখাতে চান । তা ভুল । দেখা যাচ্ছে যে বাংলা । ও বাঙালির ইতিহাস , প্রথা ও পরম্পরা বাকী । ভারতের মতই ধর্ম নির্ভর , পুরাণ ও রামায়ণ যার উৎস । সুতারং বাঙালি জনগােষ্ঠী প্রাচীন ভারতীয় জনগােষ্ঠীর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ , কোনভাবে পৃথক নয় ।
এই ভাবে ভারতের যে কোন জনগােষ্ঠীর ইতিহাস ঠিকভাবে দেখলে একই জিনিস আমরা দেখতে পাবাে যে বিশাল ভারতের সকল জনগােষ্ঠী একই সূত্রে আবদ্ধ । এটাই আমাদের জাতীয় সংহতি । আর এর ভিত্তি ধর্ম , আমাদের হিন্দু ধর্ম । এই সত্যকে যারা অস্বীকার করতে চায় , তাদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত অথবা তারা কোন বিদেশী শক্তির এজেন্টের কাজ করছে । তারা এই ঐক্যকে ভাঙ্গতে চায় , সুতরাং তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী । কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানাে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে এরা কোনাে অংশে কম ক্ষতিকর নয় । এরা জাতীয় ঐক্য ভাঙ্গতে চায় , এরা দেশ ভাঙ্গতে চায় । এদের থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে । এদের জন্যই ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়েছে , এদের জন্যই কাশ্মীর , নাগা , মিজো ও খালিস্থানী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রশ্রয় পেয়েছে । এরা জাতীয় সংহতি ভঙ্গকারী , এরা দেশদ্রোহী ।
তপন ঘোষ (TAPAN GHOSH)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: স্বদেশ সংহতি সংবাদ – ১৪ই অক্টোবর ২০০৮