সপ্তমীর রাতে প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা হয় সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারের পুজোমণ্ডপ। বন্ধ ছিল মণ্ডপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আলো এবং শব্দের খেলা (লাইট অ্যান্ড সাউন্ড)। এতে অবশ্য ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন পুজো কর্তৃপক্ষ। ভিড়ের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, সেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন। একই সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা, অষ্টমীর রাতেও এমন কিছু ঘটতে পারে। কারণ, সপ্তমীর ওই ঘটনার পরেও অষ্টমীর বিকেল পর্যন্ত কোনও বাড়তি ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। পুজো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পুলিশ কোনও আলোচনা করেনি বলেও অভিযোগ। পুলিশ অবশ্য বলছে, পরিকল্পনায় কোনও ত্রুটি নেই। ভিড় নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে এই পুজোয় ফি বছরই মাত্রাছাড়া ভিড় হয়। এ বার সেটাই আরও একটু বেশি। সেই ভিড় নিয়ন্ত্রণে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, মণ্ডপের প্রবেশের মুখেই কেন সমস্যা, দর্শনার্থীদের মণ্ডপের বাইরে যাওয়ার জন্য কী পদক্ষেপ করা হয়েছে — অষ্টমীর বিকেলে এই সব বিষয় নিয়ে খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
উত্তর কলকাতার লেবুতলা পার্কে এ বছরের থিম ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। তৈরি হয়েছে দিল্লির লালাকেল্লার আদলে মণ্ডপ। তাতেই চলছে আলো ও শব্দের খেলা। আর তা দেখতেই উৎসাহী দর্শনার্থীরা। প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই মণ্ডপের উপর অসাধারণ ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। লেজার লাইটের ঝকমকি। অত্যধিক ভিড় হওয়ার অন্যতম কারণ এটিই বলা যায়।
এই মণ্ডপে যেতে মূলত তিনটি রাস্তা ব্যবহার করা হয়। এক, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সরাসরি পার্কের দিকে যাওয়া যায়। দুই, কলেজ স্কোয়ার থেকে গলিপথ ধরে অনেকে সেখানে যান। তিন, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে বৌবাজার হয়ে লেবুতলা পার্ক। পুলিশ জানাচ্ছে, এই তিন রাস্তা ধরে প্রচুর মানুষের ভিড় গিয়ে পড়ে মণ্ডপ সংলগ্ন নটবর দত্ত সরণিতে। এটিই মণ্ডপে ঢোকার মূল পথ। ফলে এখান থেকে জনজোয়ার মণ্ডপমুখী হয়। মণ্ডপ চৌহদ্দির মধ্যে বাঁশের ব্যারিকেড করে প্রবেশের পথ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তা ধরেই ভিড় গিয়ে মণ্ডপে প্রবেশ করে।
অন্য বছরের তুলনায় এই বার সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারে ভিড়ের চাপ তুলনায় বেশি। এর পিছনে প্রধান কারণ অবশ্যই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড। এই পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা বিজেপি নেতা সজল ঘোষ বলেন, ‘‘থিম ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ বোঝাতে ‘লালাকেল্লা’র দেওয়ালের উপর তথ্যচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রয়েছে উচ্চস্বরের মিউজিক এবং লেজার লাইট। সম্পূর্ন বিষয়টি দেখতে ৫ মিনিট সময় লাগবে। তবে এর জন্য দাঁড়ানোর দরকার নেই। মণ্ডপে প্রবেশ করতে করতেই উপভোগ করা যাবে।’’ অর্থাৎ, ৫ মিনিটের শো দেখার পরে দর্শনার্থীরা মণ্ডপে প্রবেশ করবেন প্রতিমা দর্শনের জন্য। পুলিশ মনে করছে, বিশাল ভিড় এই ৫ মিনিটেই অনেকটা চাপ বাড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও থমকে যায় ভিড়ের গতি।
মণ্ডপে ঢোকার পর প্রতিমা দর্শন করার সময় ভিড়ের গতি ফের কমে যায়। ভিড়ের চাপ আরও বাড়ে। আর এক দিক থেকে দর্শনার্থী আসতেই থাকে। ফলে প্রবল ভিড় তৈরি হয়। তবে মণ্ডপ থেকে বেরোনোর সময় ভিড় অনেকটা সহজ হয়। এখানে বাহিরের দু’টি পথ রয়েছে। একটি পার্কের ধার ধরে শিয়ালদহের দিকে। অন্যটি, মণ্ডপের পিছন থেকে বৌবাজারের দিকে। এই বৌবাজারের বেরোনোর ভিড়টা গিয়ে মিশছে আবার সেই নটবর দত্ত সরণিতে। যার ফলে সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারের পুজোমণ্ডপে ঢোকার মুখেই অত্যধিক ভিড় তৈরি হয়।
পুলিশের দাবি, সপ্তমীর রাতে উত্তর কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত এই পুজোতে ভিড় উপচে পড়েছিল। একটা সময় দমবন্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাধ্য হয়ে কিছু ক্ষণের জন্য বন্ধ রাখতে হয় মণ্ডপ। পুজো উদ্যোক্তারা অবশ্য এর জন্য পুলিশের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন। তাঁদের দাবি, প্রতি বছরই এখানে পুজো হয়, প্রতি বছরই ভিড় হয়। এটা নতুন কিছু নয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি বলেই একটা সময় হাতের বাইরে চলে যায়। সজলের দাবি, সপ্তমীর দিন সেখানে ৮-১০ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়েছিল।
আঁধারে আলো রোশনাই এই মণ্ডপের মূল আকর্ষণ হলেও, দিনভর সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারে দর্শনার্থীদের আনাগোনা লেগে রয়েছে। অষ্টমীর বিকেলে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শুরু হওয়ার আগেই এই মণ্ডপে ভিড় জমে ওঠে। বজবজ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন সায়ন মাঝি। এত দূর থেকে এলেন অথচ এখন তো আলোর খেলা দেখতে পাবেন না, প্রশ্ন করতেই তাঁর উত্তর, ‘‘রাতে ভিড়ের কারণে মণ্ডপ বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে? তাই বন্ধুদের নিয়ে এখনই চলে এলাম। লালকেল্লা তো দেখা হল!’’ আবার দমদমের বিকাশ ঘোষের কথায়, ‘‘প্রতি বছর পরিবার নিয়ে এখানে আসি। ভিড় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। রাতে প্রচুর ভিড় হয় শুনে এখনই এলাম। দারুণ লেগেছে! শুধু লাইট অ্যান্ড সাউন্ড মিস করলাম!’’ গত কয়েক দিনের থেকেও অষ্টমীর রাতে ভিড় আরও বেশি হবে বলে আশাবাদী পুজো কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রসেনজিৎ দে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিকেলের এই ভিড় কিছুই না। আসল ভিড় তো শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টা থেকে। শেষ হয় ভোর ৪টে নাগাদ।’’
সপ্তমীর রাতের অভিজ্ঞতা থেকে কি নতুন কোনও পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ? অষ্টমীর বিকেলে সজল বলছেন, ‘‘এখন অবধি আমাদের সঙ্গে তারা কোনও আলোচনাই করেনি। পরে পুলিশের অন্য কোনও পরিকল্পনা থাকলে জানা নেই।’’ তবে রবিবার ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ বন্ধ রাখা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতার পুজোগুলিতে ভিড় নেই। এখানে ভিড় বাড়ছিল। সেই কারণে কৌশলে ভিড়কে অন্য দিকে ঠেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজকেও তেমন কিছু হবে না জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’’