ইন্দ্রের শুনিয়া বাণী কন কমন্ডুলপাণি / উপায় কেবল দেবী পূজা । তুমি পূজি যে চরণ জিনিলে অসুরগণ/ বোধিয়া শরতে দশভূজা। / পূজা রাম কৈলে তার হবে রাবণসংহার /
শুন সার সহস্রলোচন।
লংকা কান্ড : শ্রীরাম পাঁচালী: কৃত্তিবাস ওঝা ।
বাংলা ভাষায় রামায়ণকে যিনি জনপ্রিয় করেছেন, সেই কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর শ্রীরাম পাঁচালীতে শ্রীরামের হাত দিয়ে দেবী দুর্গার পূজা করান । মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী দুর্গা পূজার সূচনা করেন রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি। তাঁদের দেবী বোধনের সময় ছিল চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষ, যে সময়ে চৈত্র নবরাত্রি, বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কবি কৃত্তিবাসের বর্ণনা অনুযায়ী,
শ্রীরাম রাবণ বধের নিমিত্তে ব্রহ্মার বিধান অনুযায়ী দেবরাজ ইন্দ্রের পরামর্শে আশ্বিনের শুক্লপক্ষে দেবীর বোধন ও পূজন করেন। যেহেতু দেবীর এই বোধন পরম্পরা মেনে যথোপযুক্ত সময়ে হয়নি, তাই শারদীয়া দুর্গাপূজা অকালবোধন নামে পরিচিত । তারপর শ্রীরামের অকালবোধনকে স্মরণ করে সারা বাংলাদেশ জুড়ে শারদীয়া দুর্গোৎসবের সূচনা হয় যা আজ সমগ্র ভারত তথা বহির বিশ্বেও স্বীকৃত ও বন্দিত।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার এক প্রাচীন জনপদ হল শ্রীরামপুর। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে শেওড়াফুলি রাজা রাজচন্দ্র রায় এই স্থানে রাম – সীতা মন্দির নির্মাণ করান যা আজও বর্তমান। সেই রাম সীতা মন্দির থেকেই এই জনপদের নাম হয় শ্রীরামপুর । শ্রীরামের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে নগরের নাম, সেখানে শ্রীরামের অকালবোধনকে স্মরণ করে যে দুর্গোৎসব হবে সেটাই স্বাভাবিক। শ্রীরামপুর নগরের পাঁচু বাবুর বাজার এলাকাতে (রেল স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দূরত্ব) বিগত প্রায় দুইশত বছর ধরে শ্রীরাম প্রবর্তিত শারদীয়া অকালবোধন আয়োজিত হয়ে চলেছে। শ্রীরামপুরের বুকে এই অকালবোধনের শুভ সূচনা করেন স্বর্গীয় পঞ্চানন গুঁই। তিনি এই এলাকায় একটি শ্রী শ্রী শিব কালী মন্দির নির্মাণ করান। সেই মন্দিরের চত্বরেই শরৎকালে পূজিত হন দেবী দুর্গা ।
অন্যান্য শারদীয়া দুর্গোৎসবে আমরা দেবী দুর্গার যেরূপ প্রতিমা দেখতে অভ্যস্ত ,এখানকার প্রতিমা সেরূপ নয়। এখানকার প্রতিমার বিশেষত্ব হচ্ছে যে সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গা এখানে একাকী বর্তমান । তাঁর সঙ্গে না আছেন মহিষাসুর, না আছেন দেবী লক্ষী ও সরস্বতী কিম্বা শ্রী শ্রী কার্তিক ও গণেশ। এখানে সিংহ বাহিনী দেবী দুর্গার পদতলে দেখা যায় শ্রীরাম, লক্ষণ ও হনুমানকে। কৃত্তিবাসের বর্ণনা অনুযায়ী শ্রীরাম রাবণসংহারের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য আশ্বিন শুক্ল পক্ষের নবমীর দিন দেবীকে একশো আট নীলোৎপল উৎসর্গ করার বাসনা করেন। অভিষ্ট ফল লাভের জন্য দেবীর কৃপা পেতে বিভীষণ শ্রীরামকে নীল পদ্ম উৎসর্গের পরামর্শ দেন।
শ্রীরামের নির্দেশে হনুমান দেবীদহ থেকে একশো আটটি নীলোৎপল সংগ্রহ করে আনেন। কিন্তু দেবী মায়া বলে একটি নীলোৎপল লুকিয়ে রাখেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শ্রীরামের ভক্তি পরীক্ষা। অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য পদ্মলোচন শ্রীরাম তখন তাঁর একটি চোখ তীরধনুকের সাহায্যে নিবেদন করতে উদ্যত হন। শেষে দেবী তাঁকে নিরস্ত করেন এবং তাঁর সংকল্পে খুশি হয়ে রাবণ বধের বরদান করেন। এখানে প্রতিমা নির্মাণের সময় শ্রীরামের এই চক্ষু উৎসর্গ করতে যাবার ঘটনাটির রূপ দান করা হয়। তাই দেবী প্রতিমার পদতলে স্থিত শ্রীরামকে আমরা দেখি তীর ধনুক দ্বারা নিজের আঁখি উপড়ে ফেলতে যাচ্ছেন।
শ্রীরাম দেবীর অকালবোধন করেন আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে আর দেবীর পূজা করেন সপ্তমী থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত । দশমী তিথিতে তিনি দেবী প্রতিমার বিসর্জন করেন। সেই অনুযায়ী সর্বত্র আশ্বিন শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার বোধন সপ্তমী তিথি থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত দেবীর পূজা এবং দশমীর দিন দেবীপ্রতিমার বিসর্জন হয়ে থাকে। বর্তমানে এই মন্দিরে পূজার দায়িত্বে আছেন পঞ্চানন বাবুর বংশধর শ্রী পিন্টু গুঁই। তাঁর সঙ্গে পূজার দেখাশোনা করেন তাঁর এক পিতৃস্বসা শ্রীমতি অনুরাধা সেন। বর্তমানে যে পুরোহিত দেবীর অকালবোধনের পূজা করে থাকেন তাঁর নাম শ্রী ঘনশ্যাম মুখোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব নিঃসন্দেহে দুর্গাপূজা। বর্তমানে সেই দুর্গাপূজা শ্রীমতি তপতী গুহ ঠাকুরতার গবেষণা ও কলমের জোরে ইউনেস্কো থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই কথাও অনস্বীকার্য যে বাংলার শারদীয়া দুর্গাপূজা শ্রী রামের অকালবোধনকে স্মরণ করেই অনুষ্ঠিত হয় । কৃত্তিবাসের বর্ণনা অনুযায়ী শ্রীরামই সর্বপ্রথম শরৎকালে দেবীর আরাধনা করেন। শ্রীরামপুরের ঐতিহ্যমন্ডিতে এই পূজা, সেই পরম্পরাকেই সরাসরি তুলে ধরেছে। এই পূজা বুঝিয়ে দেয় বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সঙ্গে শ্রীরামের যোগাযোগ কতটা আত্মিক এবং অবিচ্ছেদ্য।
সূর্য শেখর হালদার