সপ্তমী সিডনিতে, তো বিসর্জনে শ্রীভূমি, পুজোর ক’দিন এমনই ব্যস্ত গোবরডাঙার গোবিন্দ ঢাকি

কাঁধে ঢোল নিয়ে কত দেশেই না গিয়েছে বাঘা! এ বার ঢাক নিয়ে সোজা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দিলেন গোবিন্দ দাস। তাঁর অবশ্য জাদু-পাদুকা নেই। হাততালি দিলে চলে না। তবে স্মার্টফোনে খুটখুট করে কাজ হয়েছে। ভূতের রাজা বর না দিলেও, নেটমাধ্যম দিয়েছে।

বয়স ৩৮। মাধ্যমিক পাশ। তার পর থেকে ঢাক বাজানোর কাজেই মন দিয়েছেন। পরিবারের সকলে তা-ই করেন। ঠাকুরদাদা ছোটবেলা থেকে ঢাক বাজানো শিখিয়েছিলেন। তবে তখন ভাবেননি, ঢাকের জোরে বিদেশ পাড়ি দেবেন।

এ বছর পুজোর ক’টা দিন তাঁকে দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ নিউ সাউথ ওয়েলস’-এর পুজোয়। রাত-দিন প্রতিমার পাশে গোবিন্দ। আর তাঁর ঢাকের বাদ্যিই প্রবাসীদের দেশের স্বাদ দিয়েছে। সেখানে দু’বছর অতিমারির জন্য পুজো বন্ধ ছিল। তাই প্রতি বারের তুলনায় কিছুটা বেশি ধুমধাম করে হয়েছে এ বছরের পুজো। পরপর ছুটি পড়ে যাওয়ায় একটু বেশি দিন ধরেও হয়েছে পুজো। সপ্তাহান্তে তিন দিন সেই পুজো প্রাঙ্গণেই দেখা যায় গোবিন্দকে।

অস্ট্রেলিয়ায় বসেই গোবিন্দ কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে। এ বছর তাঁর প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের পুজোর সময়ে প্রথম বিদেশযাত্রার সুযোগ আসে। বহু বছর সুরুচি সংঘ, শ্রীভূমির মতো পুজোয় ঢাক বাজিয়েছেন। সে বার অন্য দেশ থেকে ডাক আসায় ঢাক কাঁধে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। গোবিন্দ বলেন, ‘‘তার পর থেকেই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এ বার আবার ওঁরাই ডেকে নিয়ে আসেন।’’

কিন্তু পুজোর সময়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে কি ভাল লাগল গোবিন্দর? কলকাতায় তো কত জমজমাট পুজো, সব ছেড়ে মন ভাল আছে তাঁর? গোবিন্দ বলেন, ‘‘সিডনিতে সকলে খুব আন্তরিক। এখানে যিনি আসছেন, তিনিই একটু কথা বলছেন, গল্প করছেন। কলকাতার পুজোয় এ সব হয় না। কারও সঙ্গে আলাপ করার সময় নেই।’’

পরপর ছুটি পড়ে যাওয়ায় সিডনিতে একটু বেশি দিন ধরেও হয়েছে পুজো।

সিডনিতে এক পুজোকর্তার বাড়িতেই দিন পাঁচেক ছিলেন গোবিন্দ। সেখানেই খাওয়াদাওয়া। আর সঙ্গে যাতায়াতের বিমানের ভাড়াও দিয়েছেন পুজোকর্তারা। এ ছাড়া, দিন তিনেক দু’বেলা পুজো প্রাঙ্গণে ঢাক বাজানোর জন্য পেয়েছেন হাজার ষাটেক টাকা। ফলে বিদেশ দেখা, ঢাক বাজানোর এই প্রকল্প মন্দ লাগেনি গোবিন্দর।

কোনও সমস্যা হয়নি ঢাক নিয়ে এত দূর যেতে?

প্রথম বার একেবারেই অসুবিধা হয়নি। তবে এ বার বিমানবন্দরে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাঁকে। গোবিন্দ বলেন, ‘‘যখন আমাকে আটকানো হয়, তত ক্ষণে ঢাক চলে গিয়েছে লাগেজের সঙ্গে। তা-ও অনেক প্রশ্ন করছিলেন এক অফিসার। জানতে চাইছিলেন আমি কোথায়, কী কাজে যাচ্ছি। তবে পরে ছেড়ে দিলেন।’’ অতটুকু বাধা পুজোর আনন্দের কাছে তেমন কিছু নয় বলেই মনে করেন গোবিন্দ। সিডনিতে এত মানুষের যত্ন ও প্রশংসা পেয়ে মন ভাল হয়ে গিয়েছে তাঁর। আর সিডনিও বেশ খুশি গোবিন্দকে পেয়ে। সে পুজোয় গিয়েছিলেন কলকাতার ছেলে হিন্দোল। জানালেন, গোবিন্দর ঢাকের তালে বেশ নাচও হয়েছে পুজো প্রাঙ্গণে। বাংলার ঢাক দেখে পুজোর আনন্দ বেড়ে গিয়েছে প্রবাসীদের।

এ বার কি তবে কলকাতাকে ভুলেই গেলেন গোবিন্দ?

তা একেবারেই নয়। অষ্টমীর রাতেই রওনা হচ্ছেন সিডনি থেকে। সে দেশে যে পুজো হয় শুধু সপ্তাহান্তে। ফলে অষ্টমীর আগেই এসে গিয়েছে বিজয়া। কিন্তু কলকাতায় এখনও ভরপুর উৎসবের মেজাজ। কলকাতায় ফিরেই দশমীতে আবার বেরিয়ে পড়বেন কাজে। বিসর্জনের সময়ে আবার শ্রীভূমির মণ্ডপে দেখা যাবে গোবিন্দকে। সঙ্গীরা যে সকলে অপেক্ষা করে বসে আছেন বিদেশ ভ্রমণের গল্প শুনবেন বলে।

তবে গোবরডাঙা থেকে শ্রীভূমি আসার আগে কিনতে হবে আর একটি ঢাক। যে ঢাকের জোরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন গোবিন্দ, তা রেখে আসছেন সেই স্বপ্নের সিডনিতেই। সে দেশের এক বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী কিনে নিয়েছেন তাঁর বাজনা। গোবিন্দ বলেন, ‘‘কলকাতায় যা দাম পাব, তার চেয়ে হাজার পাঁচেক টাকা বেশি পাচ্ছি। বাড়ি ফিরে গিয়ে নতুন ঢাক কিনব।’’ উৎসবের মরসুমে ঘরের ছেলে বিদেশ ঘুরে ফিরছেন, নতুন ঢাক না হলে চলে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.