বাংলায় পুষ্পাঞ্জলি কি দেওয়া যায়?

ভারতবর্ষে বামপন্থী দুর্বুদ্ধিজীবীদের সমস্ত আন্দোলন, সমস্ত আক্রমণ, সমস্ত বিপ্লব হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। অর্ধসত্য, অসত্য নানাবিধ তত্ত্বের আবিষ্কারে হিন্দু সমাজের প্রাচীন সমস্ত রীতিনীতির মধ্যে কিছু কল্পিত দোষ আরোপ করার সুন্দর একটি নাজীবাদী, গোয়েবলসীয় তত্ত্ব তারা আবিষ্কার করেছেন। এই সমস্ত দোষের নামগুলিও বেশ গালভরা– পুরুষতান্ত্রিকতা (আগে বলা হত পিতৃতান্ত্রিকতা, পরে এই শব্দের বিপদ বুঝে শব্দটাকে পাল্টানো হয়েছে), ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এই সমস্ত শব্দের কোনটিরই অগ্র পশ্চাৎ ইতিহাস নেই। অথচ সাহিত্য এবং একাডেমিয়াতে এই শব্দগুলির প্রভূত অর্থহীন প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয় থেকে পচা-র চায়ের দোকান পর্যন্ত সর্বত্র শব্দগুলিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে, এই সমস্ত শব্দের প্রয়োগই আপনাকে সভ্য, সামাজিক, বুদ্ধিজীবী বলে স্বীকৃতি দিতে পারে।
বাঙালীর সংস্কৃতি বোধ প্রখর। তা যদি না হত তবে পূর্ববঙ্গ থেকে কোটি কোটি মানুষ আরবের মরুভূমি থেকে আমদানি করা অসভ্যতাকে গ্রহণ করে সুখ-সমৃদ্ধি পূর্ণ জীবনের বদলে নিজ সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার বিকল্প গ্রহণ করতেন না। দীর্ঘ সিকুলার, বামপন্থী সাংস্কৃতিক আক্রমণের পরেও বাঙালির সেই বাঙালিত্ব এখন অনেকাংশেই টিকে আছে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণে’র হাত ধরে। সুতরাং, এই সমস্ত পূজা-পার্বণের পরম্পরাকে ধ্বংস করতে পারলে বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করার বামৈস্লামিক চক্রান্ত বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে।
এই চক্রান্তের অঙ্গ রূপে সর্বপ্রথম আক্রমণ আনা হল দুর্গাপূজার উপর। এই চক্রান্তকে ধীরে ধীরে অনেকগুলি পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করার কাজ চলছে। সবার প্রথমে, বামপন্থী নেতারা সারা বৎসর পূজা-পার্বণ, দেবতা, ধর্মীয় রীতি নীতির বিরুদ্ধে ধর্মকে আফিম বলে গলা ফাটিয়ে চীৎকার করার পরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বারোয়ারি পূজা কমিটিগুলির শীর্ষস্থান অধিকার করা শুরু করল। তাদের প্রভাবে দুর্গাপূজাতে দেবীর পূজার আয়োজন গৌণ হয়ে প্রাধান্য পেতে শুরু করল উপলক্ষ্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হল পুরোহিতদের উপর আক্রমণ। পুরোহিতের বিধানকে তুচ্ছ করে নিজেদের মতো করে পূজার ব্যবস্থা করতে বাধ্য করা শুরু হল পুরোহিতদের। সঙ্গে সঙ্গে পৌরোহিত্য পেশা ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে পূর্বোল্লিখিত ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রভৃতি অলীক দোষের প্রতিনিধি রূপে উপস্থাপিত করে তাদেরকে সমাজে ব্রাত্য প্রতিপাদন করা আরম্ভ হল। বন্ধ করে দেওয়া হল TOL শিক্ষা যেখানে ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতি, পৌরোহিত্য, কর্মকাণ্ডের লেখাপড়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্টোদিকে মাদ্রাসা কিংবা খৃষ্টান মিশনারী পরিচালিত বিদ্যালয়গুলিকে সাহায্য করা শুরু হল সরকারী ভাবে। পৌরোহিত্য শিক্ষার ব্যবস্থাটা সরকারী ও সামাজিক উভয় স্তরেই ধ্বংস করে দেওয়া হল লেনিনীয় পদ্ধতিতে।
তৃতীয় পর্যায়ে আমদানি করা হল ‘থিম’। কুম্ভকারদেরকে বাধ্য করা হল দেবীর মূর্তিকে বিকৃত ভাবে তৈরি করার জন্য। বামপন্থী শিল্পজীবীদের নামিয়ে দেওয়া হল ময়দানে। কুম্ভকারদের জীবিকাকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দেখানো শুরু হল, দুর্গাপূজার মণ্ডপসজ্জাই হল সমাজ থেকে কুপ্রথা দূরীকরণ ও সচেতনতা প্রসারের একমাত্র জায়গা। চতুর্থ স্তরে, এলো মন্ত্র বিকৃতি এবং পূজা পদ্ধতির বিকৃতি।
হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, কালীপূজা ও দুর্গাপূজার মধ্যে মাতৃ-উপাসনার ধারা চালু আছে। সেই সমাজকে হঠাৎ বোঝানো হল যে, তোমরা যেহেতু কোন মহিলাকে বারোয়ারি পূজায় যাজনের সুযোগ দিচ্ছ না সেজন্য তোমরা নারীবিদ্বেষী। একাত্মতার বার্তাবহ পূজার মণ্ডপ ও পরিবেশকে নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের বিষে বিষিয়ে দেওয়া হল। এর বিরোধিতা করা মাত্রই আপনার পিছনে মুদ্রাচিহ্ন দেওয়া হবে ‘আপনি মধ্যযুগীয়, বর্বর, পুরুষতান্ত্রিক, অসভ্য, প্রতিক্রিয়াশীল’… এই বিশেষণের লাইন তিন পাতা ধরে লিখলেও শেষ হবে না।
বিগত কয়েক বছর ধরে নতুন দাওয়াই এল, পূজার মন্ত্রের বিকৃতি। শুরু হল সেই কল্পিত পুরুষতান্ত্রিকতার হাত ধরে। পুত্রান্ দেহি কেন বলবে? বলতে হবে সন্তানান্ দেহি। নিদান যারা দিলেন তারা দুর্গার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, পূজা পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধা নেই, শাস্ত্রকে প্রতিক্রিয়াশীলতার আকর মনে করেন। তাদের অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষা জানেন না, সংস্কৃত শাস্ত্র সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। শাস্ত্রবচনের অর্থ নিরূপণের প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, রীতি, নীতি কিছুই জানেন না। তাদের ভরসা অনুবাদ। এবং হাস্যকর ভাবে বিষয়গত লেখাপড়া কম থাকার কারণে সেই অনুবাদও বোঝার মতো যোগ্যতা তাদের নেই।
এরা কিন্তু শাস্ত্রসিদ্ধ দুর্গাপূজাকে সরাসরি আক্রমণ করে না কখনও। কারণ তাতে বিপদ আছে। কলকাতার বৃত্তের বাইরে ধর্মপ্রাণ বাঙালি এদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু কলকাতার সংবাদ মাধ্যমে যদি কোন বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দেওয়া যায় এবং সেই আলোচনাতে যদি কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীকে অংশগ্রহণ করানো যায় তবে মেকলে-মার্ক্সের শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিকে খুব সহজেই কনফিউজড বা দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলা সম্ভব।


দুঃখের বিষয় শাস্ত্রচর্চার অভাবে হিন্দুত্ববাদীরাও এই সমস্ত অপসিদ্ধান্তের যথার্থ উত্তর উপস্থাপন করে আপামর বাঙালির দ্বিধা দূর করতে সমর্থ হয়নি। যেটুকু বিজ্ঞজনোচিত প্রতিবাদ হয়েছে, তাকে বামপন্থী মাফিয়া পরিচালিত সংবাদমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবিকুল কখনও মানুষের সামনে আসতে দেয়নি।
এই প্রসঙ্গে এই বছরের নতুন বাঁদরামি হল বাংলা ভাষায় পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রের আমদানি। সৌজন্যে দুইজন অবিবেচক, ক্ষমতার জন্য প্রশাসকের পদলেহক, মূঢ়ধী, পণ্ডিতম্মন্য জরদ্গব এবং একজন অজ্ঞাতকুলশীল তথাকথিত পুরোহিত। এদের যুক্তি বেশ সরেস।
১. সংস্কৃত না জেনে ভুল মন্ত্র আওড়ানোর থেকে বাংলায় পুষ্পাঞ্জলির ‘মন্ত্র’ বলা বাঞ্ছনীয়।
২. মা-কে সন্তান নিজের ভাষায় ডাকলে কি মা প্রার্থনা শুনবেন না? তাহলে আমি যে প্রতিদিন গঙ্গাজল, বেলপাতা দিয়ে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি সেটা কি ব্যর্থ?
আমরা শাস্ত্রসিদ্ধান্তের আলোকে সাধারণ যুক্তিগ্রাহ্য ভাবে এই প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করি। প্রথমেই আমরা দ্বিতীয় প্রশ্নের সমাধানে আসি।
ঈশ্বর বা দেবদেবীরা কি বাংলা বোঝেন না? আজ্ঞে, পরমেশ্বর বা দেবগণ বামপন্থী দড়কচা বুদ্ধিজীবী মার্কা আঁতেল নন। সেজন্য তাঁরাও “বাংলা বুঝব না” বলে গোঁ ধরেন না। বিষয়টা দেবতাদের বোঝা না বোঝার নয়। বিষয়টা হল শাস্ত্র ও নিয়মের। শাস্ত্র বলছেন, অর্থের বোধ সাধু ও অসাধু উভয় প্রকার শব্দ থেকেই হয়। কিন্তু সাধু শব্দ ধর্মজনক অর্থাৎ শুভ ফল বা পুণ্যদায়ক। বিপরীতে অসাধু শব্দ ধর্মজনক নয়। সেজন্য যজ্ঞাদি কর্মে সাধু শব্দই প্রযোজ্য। অসাধু শব্দ নয় (দ্র. পাতঞ্জল মহাভাষ্য, পস্পশাহ্নিক)। আপনার ক্ষুধা পেলে আপনি পুষ্টিকর ও অস্বাস্থ্যকর দুই প্রকার খাদ্যেই ক্ষুধা শান্ত করতে পারেন। কিন্তু পুষ্টিকর খাদ্যই আমরা খাই, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য পরিহার করি।
মহামুনি পতঞ্জলি একটি প্রাচীন কাহিনীর অবতারণা করেছেন। তিনি ‘যর্বাণতর্বাণ’ ঋষিদের কথা বলেছেন। তাঁরা ‘যদ্ বা নঃ, তদ্ বা নঃ’ বলার সময়ে ‘যর্বাণঃ তর্বাণঃ’ এরকম উচ্চারণ করতেন। সেজন্য লোকে তাঁদের নামই দিয়ে দিল যর্বাণতর্বাণ। কিন্তু তাঁরা শাস্ত্রমর্মজ্ঞ, সাধক, ধর্মনিষ্ঠ ঋষি ছিলেন। তাঁরা যজ্ঞ কর্মে কিন্তু কখনওই কোনপ্রকার ভুল উচ্চারণ করতেন না।
দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা প্রভৃতি যে সমস্ত পূজাতে পুষ্পাঞ্জলির কথা হচ্ছে সেগুলি সমস্তই কাম্য পূজা। সেখানে কাম্যপূজার উপযুক্ত সংকল্প হয়। নিষ্কাম ভক্তি প্রযুক্ত উপাসনা বা আরাধনা এগুলি নয়। কাম্য পূজা যজ্ঞাদির সমতুল। সেটি যজ্ঞাদি ধর্মজনক কার্যের অন্তর্গত। সুতরাং, সেখানে সাধু (সংস্কৃত ব্যাকরণসিদ্ধ) শব্দই প্রযোজ্য। তদ্ব্যতীত অন্য শব্দ প্রয়োগ করলে ‘সারস্বতী ইষ্টি’ নামক প্রায়শ্চিত্তমূলক যজ্ঞ করার বৈদিক বিধান রয়েছে। অন্যথা এই পূজা পুণ্যের বদলে পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে কি দেবতা বা পরমেশ্বরকে নিজের ভাষায় প্রার্থনা করলে তাঁরা শোনেন না? অবশ্যই শোনেন। সকাম বা নিষ্কাম যে ভাবেই করা হোক না কেন, সংস্কৃত বা অসংস্কৃত যে কোন ভাষাতেই প্রার্থনা করা হোক না কেন তাঁরা প্রার্থনা শোনেন। কিন্তু, কামনা পূরণ করেন কেবল সাধু শব্দে উচ্চারিত শাস্ত্রোক্ত বিধিপুরঃসর প্রার্থনার ক্ষেত্রে।
অনন্য ভক্তি সহকারে শুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি যে ভাবে, যে ভাষাতেই প্রার্থনা করুক আরাধ্য তা গ্রহণ করেন। কাম্য পূজার ক্ষেত্রে সেটা হয় না। সেখানে নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক। আপনি কোনো বিষয় শেখার জন্য বাজার থেকে বই কিনে পড়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পারেন। কিন্তু সেই পাণ্ডিত্যের সাহায্যে আপনি ডিগ্রি বা প্রমাণপত্র পাবেন না। তার জন্য আপনাকে বিধিবৎ নিয়ম মতোই পাঠক্রমে প্রবেশ করে পরীক্ষা উত্তীর্ণ করতে হবে। দুঃখের বিষয় দেবগণ বা পরমেশ্বর ঘুষের বদলে সাদা খাতা জমা দিলে কিংবা ডাণ্ডার মাথায় ঝাণ্ডা নিয়ে পার্টির মিছিলে ঘুরলে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। সুতরাং, নিয়ম পালনীয়।
কাম্য পূজার সংকল্প করে অসাধু শব্দের উচ্চারণ নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ নয়। যদি তাই হত তবে পূর্বজরা, ঋষিরা এগুলিকে মন্ত্র বলতেন না। পূজার মধ্যেই মন্ত্র ছাড়াও বহু সাধারণ বাক্যের প্রয়োগ হয়। যেমন– সংকল্প বাক্য, স্বস্তিবাচন, বৈগুণ্যবাক্য, দক্ষিণাবাক্য প্রভৃতি। এগুলিকে মন্ত্র বলা হয় না। এগুলি পূজক নিজের প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করে বলে (অবশ্যই সংস্কৃত ভাষাতেই)। কিন্তু এগুলি পরিবর্তনযোগ্য। সেজন্য মন্ত্র নয়– সাধারণ বাক্য। মন্ত্রগুলিও যদি পরিবর্তন যোগ্য হত তবে তাদেরকেও মন্ত্র না বলে বাক্য বলা হত।
সুতরাং, কেউ যদি গঙ্গাজল, বেলপাতা নিয়ে কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে থাকে তবে ঈশ্বর শুনবেন। গীতাতে ভগবান্ বলেছেন, ভক্তিতে সমর্পিত পত্র, পুষ্প, ফল, জল সবই তিনি গ্রহণ করেন। এই প্রার্থনাকে কেউ বৃথা বলে না। কিন্তু আপামর মানুষ কায়মনোবাক্যে গঙ্গাজল বেলপাতা নিয়ে নিষ্কাম ভাবে, অনন্য ভক্তিতে প্রেরিত হয়ে প্রার্থনা করতে পূজামণ্ডপে যায় না। সেটা সে নিজের বাড়িতে, নিজের ছোট্ট খাটটিতে বসেই করতে পারে। পূজামণ্ডপে যায় বিশেষ কামনা নিয়েই। সেখানে বাংলায় পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র বলতে হলে সেটার জন্য পূজামণ্ডপের প্রয়োজন নেই। সে নিজের ঘরে বসেই সংবাদপত্রে পাতার দুর্গার ছবির সামনে পুষ্পাঞ্জলি দিতে পারে।
বহু যুগ ধরে সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে পরমেশ্বর ও দেবতাদের স্তব স্তুতি রূপ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। বহু দেবতার বহুবিধ স্তোত্রের রচয়িতা ভগবান্ আদি শঙ্করাচার্য, পুষ্পদন্ত (শিবমহিম্নঃ স্তোত্রের রচয়িতা), রামকৃষ্ণ কবি (মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রের রচয়িতা), রাবণ কবি (শিবতাণ্ডব স্তোত্রের রচয়িতা), কবি ময়ূর (সূর্যশতকের রচয়িতা), পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ (লহরীপঞ্চকের রচয়িতা) থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ আধুনিকদের অসংখ্য স্তোত্র ছাড়াও পুরাণ সাহিত্যের অধিকাংশই সুমধুর, সুললিত স্তোত্রে পরিপূর্ণ। তাঁদের এই স্তোত্রগুলি কোটি কোটি মানুষ নিত্য পারায়ণও করে। কিন্তু এগুলির কোনটাই দেবপূজার মন্ত্র নয়। কিন্তু এগুলি দেবতাদের স্তুতির জন্য গাওয়া হয়। এগুলি না’হয় সংস্কৃত ভাষায়। বাংলা ভাষাতেও আমাদের প্রাণপ্রিয় মঙ্গলকাব্য সমূহের রচয়িতা কবিরা, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ পদাবলীকারগণ, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, দাশরথি রায়, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ কিংবা অতি সাম্প্রতিক কালে ভবা পাগলা পর্যন্ত নিজেদের প্রাণের ভাষাতে সুললিত ছন্দে গানে নিজের আরাধ্যকে আবাহন করেছেন, স্তুতি করেছেন। আমরা তাঁদের এই সমস্ত সাহিত্যকে মাথায় তুলে রাখি, বিরোধিতা করি না। বরং, তাঁরা আমাদের পূজ্য হয়েছেন। এবং প্রণিধানযোগ্য যে, এঁরা কেউই কিন্তু শাস্ত্রবিধি উল্লঙ্ঘন করে পূজার আসনে বসে পূজার মন্ত্র বাদ দিয়ে নিজেদের স্তব স্তুতি বা গান দিয়ে পূজার পদ্ধতি প্রচলন করেননি।
সুতরাং, এই দুই দড়কচা বুদ্ধিজীবী এবং এক অর্বাচীন পুরোহিত যদি মনে করে যে তারা নোবেল বা ভারতরত্ন পাওয়ার মতো একটি বিনূতন, অশ্রুতপূর্ব তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছে, তবে তারা হাস্যাস্পদ। প্রথমেই মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে দ্বিধা নেই, এই বামপন্থী আঁতেলরা শুধুমাত্র পূর্বোল্লিখিত চক্রান্তের অঙ্গ রূপে সংস্কৃত ও সংস্কৃতির বিরোধিতা করার জন্য বাংলায় মন্ত্র চালু করতে চাইছেন। নাহলে তারা এরকম একটা অদ্ভুত ছন্দগন্ধহীন মেঠো ভাষায় দুই পাতার একটা বটতলার চটি বই বের করত না। কমপক্ষে চণ্ডীমঙ্গলের মতো ভক্তিকাব্য বা রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তদের উপযুক্ত গানের কলি খুঁজে আনার চেষ্টা করত।
সবশেষে যেটা বলা, জনগণের সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের অসুবিধার কথা মাথায় নিয়ে জনতার প্রতি অতি দরদের দ্বারা প্রেরিত হয়েই যদি তাদের এই প্রয়াস হত তবে তারা এই বটতলা মার্কা রংচঙে প্যামপ্লেটের বদলে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রগুলিকে সহজপাঠ্য ভাবে মুদ্রিত করে, তার অর্থ সহ একটি অতিক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করত এবং যথাযোগ্য ব্যক্তিদেরকে দিয়ে সঠিক উচ্চারণ সহ একটি ভিডিও ও অডিও প্রকাশ করত। কিন্তু, দিনের শেষে একটি কথাই সত্য। এদের উদ্দেশ্য হিন্দু সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার বামৈস্লামিক চক্রান্তকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

রাকেশ দাশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.