২৪ ঘণ্টার ফারাকে চির অবসরে ফেডেরার-ঝুলন, শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, আবেগ এক সূত্রে বাঁধল দুই কিংবদন্তিকে

আর দেখা যাবে না ছেলেদের টেনিসে এক সুপুরুষের এক হাতে নিখুঁত ব্যাকহ্যান্ড, দেখা যাবে না মেয়েদের ক্রিকেটে দীর্ঘকায় এক বাঙালি পেসারের বলে উইকেট ছিটকে যাওয়া। শনিবার ভোরে (ভারতীয় সময়ে) অবসর নেন রজার ফেডেরার। রাতে ঝুলন গোস্বামী। দু’টি ঘটনাই ঘটল ইংল্যান্ডের মাটিতে। সাক্ষী থাকল গোটা বিশ্ব।

লেভার কাপে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলেন ফেডেরার। যে রাফায়েল নাদালকে হারানোর জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিতেন তাঁকেই শেষ ম্যাচে সঙ্গী করেছিলেন। ম্যাচ হারলেও তাঁদের জুটি মন জিতে নেয়। আর খেলবেন না, ভাবতেই পারছিলেন না ফেডেরার। কেঁদে ফেলেন। তাঁর কান্না থামছিলই না। হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন নাদাল। জোকোভিচও বার বার চোখ মুছছিলেন। তাঁরাও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ফেডেরারের বিরুদ্ধে আর খেলবেন না। নাদাল বলেন, “ওর জীবন, ওর কেরিয়ারের অংশ হতে পেরে আমি গর্বিত। কোর্টে আমাদের মধ্যে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও ওর জীবনের শেষ পর্বে বন্ধুর মতো থাকতে পেরে খুব খুশি।”

জন ম্যাকেনরো বলেন, ‘‘আমার দেখা সব থেকে সুন্দর টেনিস খেলোয়াড়।’’ বিয়ন বর্গ বলেন, ‘‘ইশ, আমি যদি ওর মতো টেনিস খেলতে পারতাম।’’ স্মৃতিচারণ করতে বসে ফেডেরারের উদ্দেশে ৫১ বছরের সাম্প্রাস বলেন, “আমি প্রথম যখন তোমার বিরুদ্ধে খেলি, তখন তোমার বয়স ১৯ বছর। মানুষ তোমার কথা বলছিল। উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে দারুণ লড়াই হয়েছিল। তুমি আমায় হারিয়ে দিয়েছিলে। কঠিন পাঁচ সেটের খেলা। কোর্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল, নিজের সঙ্গে দেখা হল।”

লন্ডনের ও২ অ্যারিনায় ফেডেরার বিদায় নিলেন কাঁদতে কাঁদতে। সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঝুলন বিদায় নিলেন হাসতে হাসতে। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতে শেষ করল তাঁর দল। ঝুলন নিজে নিলেন দু’টি উইকেট। হাসি মুখে টস করলেন। তাঁর হাতে বিপক্ষ দল সই করা জার্সি তুলে দিল। বোর্ডের তরফে স্মারক দেওয়া হল। ঝুলন বলেন, “আবেগকে সামলে রাখতেই হবে। ক্রিকেট মাঠে আবেগের কোনও জায়গা নেই। আমি এ রকমই নির্মম। ক্রিকেট খেলতেই হবে এবং নিজের সেরাটা দিতে হবে।”

ঝুলন নিজের আবেগকে সামলে রাখলেও হরমনপ্রীত কউররা পারলেন না। তাঁরা চোখের জল ফেললেন। তাঁদের সামলালেন ‘ঝুলুদি’। হরমনপ্রীত বলেন, “ভারতের হয়ে আমার অভিষেকের সময় অধিনায়ক ছিল ঝুলন। ওর শেষ এক দিনের ম্যাচের সময় আমি অধিনায়ক। এটা আমার সৌভাগ্য।” মন্ধানা বলেন, ‘‘ভারতীয় দলের হয়ে ঝুলুদিকে (ঝুলন) আর খেলতে দেখব না, ভেবেই খুব খারাপ লাগছে। মহিলা ক্রিকেটের উত্থানের নেপথ্যে ঝুলুদির অবদান অনস্বীকার্য। ওর অভাব কখনও পূরণ করা সম্ভব নয়।’’

টুইট করে সৌরভ লেখেন, ‘একটা দুর্দান্ত কেরিয়ার। যেটা জয়ের মধ্যে শেষ হল। ব্যক্তিগত ভাবেও ওর জন্য শেষ সিরিজটা ভাল কাটল। আগামী কয়েক দশক মহিলা খেলোয়াড়দের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে ঝুলন।’ সচিন তেন্ডুলকর লেখেন, ‘ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য তুমি যা করেছ, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। দুর্দান্ত কেরিয়ারের জন্য তোমাকে অভিনন্দন।’ ঝুলনের জীবনচিত্র ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-য়ে অনুষ্কা লেখেন, ‘একটা অনুপ্রেরণা। এক জন আদর্শ। এক জন কিংবদন্তি। ইতিহাসে আপনার নাম চির দিন লেখা থাকবে। ধন্যবাদ ঝুলন গোস্বামী। আপনি ভারতের মহিলা ক্রিকেটের রং বদলে দিয়েছেন।’

ফেডেরার এবং ঝুলন সতীর্থদের কাঁধে চড়ে মাঠ ছাড়েন। ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক বলেন, “আমি একা হয়ে যেতে চাইনি। এক মুহূর্তের জন্যও নিজেকে একা মনে হয়নি। কিন্তু বিদায় জানানোর সময় আমি দলকে পাশে পেয়েছি। নিজেকে একটা দলের খেলোয়াড় মনে হচ্ছে। সিঙ্গলস সেটা মনে হতে দেয় না। যারা এত বছর ধরে আমার পাশে ছিল তাদের ধন্যবাদ। এত বছর ধরে তারা আমার সঙ্গে গোটা বিশ্ব ঘুরেছে। সবাইকে ধন্যবাদ। আমার সঙ্গে যারা খেলেছ, আমার বিরুদ্ধে যারা খেলেছ, সকলকে ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে একটা উৎসব চলছে। আমি এটাই চেয়েছিলাম।”

মেয়েদের এক দিনের ক্রিকেটে সব থেকে বেশি উইকেট (২৫৫) নেওয়া ঝুলন বলেন, “ভারতীয় বোর্ড, বাংলার ক্রিকেট সংস্থা, আমার পরিবার, কোচ, অধিনায়কদের ধন্যবাদ। এটা খুব আবেগের মুহূর্ত। প্রতিটা মুহূর্ত খুব আবেগের। ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে কেউ ভাবেনি আমরা পারব। কিন্তু ফাইনালে উঠেছিলাম। যে ভাবে সেই প্রতিযোগিতা আমরা খেলেছিলাম তা আমাদের দেশের মেয়েদের ক্রিকেটটাই পাল্টে দিয়েছে। অনেক তরুণীকে ক্রিকেট খেলতে উৎসাহ দিয়েছে ওই বিশ্বকাপ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.