পরিচ্ছন্নতার মধ্যেই যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান, ঈশ্বরকে নৈবেদ্য প্রদানের মধ্যেও যে মিছরির মতো স্বচ্ছ সামগ্রী এবং স্পষ্ট হৃদয় দিতে হয়, তা শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৭-২০২২) তাঁর জীবনচর্যা ও মানসচর্চার মাধ্যমে আমাদের শিখিয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে বলতাম ‘স্বচ্ছ সঙ্ঘী’। আবর্জনা দূরে সরিয়ে মানুষকে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার শিক্ষক। সঙ্ঘকে ভালোবেসে যিনি বলতে পারেন “স্বচ্ছং স্মরণং গচ্ছামি….।” মোদীজির স্বচ্ছ-ভারত যোজনার একান্ত সমর্থক ছিলেন তিনি। জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, চিন্তা চেতনায় স্বচ্ছতা। সৌম্যকান্তি স্বচ্ছবর্ণ; নির্মল পোশাক, ক্লেদ মুক্ত জীবন; কালি না মাখা এক প্রচণ্ড আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব; ঈশ্বরের নিত্যপূজারী এবং আদ্যন্ত সেবাব্রতী এক মানুষ।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের বঙ্গপর্বের স্তম্ভ, এইরকম কয়েকজন বরিষ্ঠ প্রচারক সম্প্রতি প্রয়াত হয়ে হৃদয় বিদারক এক শূন্যতা ও গভীর বেদনা বয়ে এনেছেন। মনমোহন বাবু, বিদ্যুৎ দত্ত (১৯৩৪-২০২২), কেশবরাও দীক্ষিত (১৯২৫-২০২২)-এর পর ২৩ শে সেপ্টেম্বর চলে গেলেন শ্রী শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৮৭ বছর বয়সে কলকাতার নর্থ সিটি নার্সিং হোমে পরলোকগমন করেছেন দেশভক্ত, সেবা পরায়ণ ও পরিচ্ছন্নতার প্রতীক এই মানুষটি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল সাতাশি। প্রায়-শতবর্ষী প্রয়াত কেশবজী ছিলেন তাঁর অন্যতম নির্মাতা এবং প্রেরণাদাতা। উত্তর কলকাতার ১৬ নম্বর কালিকুমার ব্যানার্জী রোডের বাসাবাড়িতে শ্যামলাল যখন থাকতেন, তখন কেশবজী নিয়মিত তাদের বাড়ি আসতেন। আর তখনই দেশভক্তির দীক্ষা হয়ে যায়। সেটা আনুমানিক পাঁচের দশকের শুরু। শ্যামলালের বাসাবাড়ির পাশেই ২৩ নম্বরে ছিল স্থানীয় সঙ্ঘ নিবাস। টালাপার্কের ফাঁকা জমিতে নিয়মিত শাখা বসতো। শ্যামলাল তাঁর খুড়তুতো ভাই তরুণ এবং কিরণ, সেজদা রামলাল, মেজদা কৃষ্ণলাল এবং পাড়ার বন্ধু দিবাকর প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত শাখায় যেতেন, খেলাধুলা করতেন, দেশসেবার পাঠ নিতেন। এই বাল্য-বন্ধু দিবাকরই শ্যামলালের সঙ্গে সঙ্ঘের যোগসূত্র রচনা করিয়ে দেন।
১৯৩৭ সালের ২৫ শে আগষ্ট পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের পালং গ্রামে শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। পিতা বীরেন্দ্রলাল ছিলেন পেশায় আইনজীবী; মা সুদক্ষিণা দেবী। চার ভাইয়ের মধ্যে শ্যামলাল ছিলেন কনিষ্ঠ। ১৯৩৯ সালে শ্যামলালের যখন মাত্র দুই বছর বয়স, তখন পূর্ববঙ্গেই তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। ১৯৪৩ সালে প্রতিবেশী বিধর্মীদের অত্যাচারে পিতা বীরেন্দ্রলাল সপরিবারে এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা দক্ষিণারঞ্জন কেবল রয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গে, তার মাতুলালয়ে; যদিও পরে তিনিও স্বাধীন ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিলেন। কলকাতার নিমতলায় এলাকায় বাসা ভাড়া নেন শ্যামলালের পিতা। শ্যামলাল ভর্তি হলেন নিমতলার স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে, তখন তাঁর বয়স ছয় অথবা সাত। পরে এই পরিবার টালা এলাকায় বাসাবাড়ি পরিবর্তন করে এলেন। টালা এলাকা থেকেই শ্যামলাল শাখায় যেতে শুরু করেন এবং স্বয়ং সেবক হন।
১৯৫৪ সালে শ্যামলাল স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, ১৯৫৮ সালে বি.কম এবং ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম পরীক্ষায় পেলেন প্রথম বিভাগ। মেধাবী এই ছাত্র; চাইলে সেই সময় তাঁর দাদাদের মতোই সরকারি উচ্চপদে আসীন হতে পারতেন, সেই ক্ষমতা ও প্রবণতাও ছিল। তাঁর দাদা পরে হয়ে উঠলেন বার্নপুরে স্টীল অথরিটি অফ ইণ্ডিয়ার উচ্চ আধিকারিক, মেজদা হয়েছিলেন প্রভিডেন্ট ফান্ডের চিফ কমিশনার, সেজদা কেন্দ্রীয় সরকারের এডমিনিস্ট্রেটিভ সেক্রেটারিয়েটের বরিষ্ঠ আধিকারিক। অথচ তাদেরই মেধাবী ছোটভাই হয়ে গেলেন আরএসএস-এর সন্ন্যাসীসম প্রচারক! দেশকে ভালোবেসে ভারতমাতার গৌরব বৃদ্ধি করতে এবং সমৃদ্ধশালী ভারত গড়তে সংসার ছাড়লেন। নানান জায়গায় বিস্তারকের দায়িত্ব নিয়ে সলতে পাকানোর কাজ আগেই শুরু করে দিয়েছিলেন (১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি সিউড়ি-দুবরাজপুরের বিস্তারক; ১৯৫৯ সালে কলকাতার শ্যামবাজার এলাকার বিস্তারক; ১৯৬০-৬১ সালে ভবানীপুর-বজবজ-বাটানগর-বিড়লাপুর এলাকার বিস্তারক)।এম.কম পরীক্ষার পর তিনি নিজের জীবন সঁপে দিলেন, যাকে বলা যায় ভারতমাতার কাজে সম্পূর্ণ সমর্পণ। কলকাতার ২৬ নম্বর কার্যালয়ে এসে জীবন তরণীর নোঙর ফেললেন এবং অরবিন্দ ভাগ ও শ্যাম বিভাগের বিস্তারণ কাজে পৌরোহিত্য করলেন। ১৯৬১ থেকে ৬৪ পর্যন্ত তিনি ২৬ নম্বরে অবস্থান করেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হল প্রচারকের জীবন। কৃষ্ণনগরকে হেড কোয়ার্টার করে নদীয়ার জেলা প্রচারক হলেন, বিশেষ নজর রইলো নবদ্বীপ এলাকায়; সেখানকার সাধারণ মানুষ, সাধুসন্ত এবং যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সঙ্ঘের ভাব-প্রচার করলেন। নদীয়া জেলায় সঙ্ঘের ভিত তৈরি করতে থাকলেন। তখন ওপার বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে ছিন্নমূল মানুষের ঢল আসছে, মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েও তাদেরই দোসর এ রাজ্যের একটি পার্টিতে এসে ভিড়ছেন অবুঝ হিন্দু। শ্যামলাল তাদের চোখ খুলে দিতে শুরু করলেন। ১৯৬৪ থেকে একাদিক্রমে ১২ বছর তিনি নদীয়ার সমাজ জীবনে সনাতনী সংস্কৃতির পরত পুনরায় মাখাতে শুরু করলেন, সঙ্গে রইলো সেবাকাজ, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, দেশসেবা, ভারতবোধ।
এরপর তাঁর সাময়িক রাজনৈতিক জীবন। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থায় তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের দ্বারা গ্রেপ্তার হলেন। শুরু হল জেলজীবন। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তাঁকে জনতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হতে হল। স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলি সঙ্গবদ্ধ হল, তাতে মিশে গেল সঙ্ঘ-সম্পৃক্ত ভারতীয় জন সঙ্ঘ। মোরাজ্জি দেশাই মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবাণী। রাজনৈতিক কাজের জন্য তাদের কর্মধারায় কাছাকাছি এলেন শ্যামলাল। সমন্বয়ের কাজে দিল্লিতেও তাঁকে অনেক সময় কাটাতে হয়েছে। এইভাবে ১৯৭৬ থেকে ৮০ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামিল হলেন। সংগঠনের অন্যতর দৃষ্টি ভঙ্গী সম্পর্কে আরও নিবিড়ভাবে জানতে সক্ষম হলেন তিনি, যা তাঁকে সাংগঠনিকভাবে আরও মজবুত করে তুলেছিল। সমসাময়িক সময়ে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠিত হলে (৬ ই এপ্রিল, ১৯৮০) তিনি পুনরায় সঙ্ঘের কাজে ফিরে এলেন। রাজনৈতিক জীবনের পূর্বে ১৯৭৬ সালে তিনি মালদা জেলা প্রচারক হন এবং উত্তর বঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হন। এবার তাঁকে আরও উত্তরে সংগঠন বাড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হল। যাকে বলে পার্বত্য বিভাগ, যার হেডকোয়ার্টার শিলিগুড়ি; সেখানে দায়িত্ব নিলেন তিনি। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর জেলা নিয়ে এই বিভাগ। উত্তরবঙ্গের আনাচকানাচে ঘুরে ফিরলেন তিনি। একাদিক্রমে আট বছর (১৯৮০-৮৮) সঙ্ঘকাজ সারলেন। দক্ষিণ আগেই চিনেছেন, তারপর উত্তর; এমন মানুষকেই প্রান্ত কার্যালয় প্রমুখ করা হলে, সকলের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারবেন, এই বোধে সম্ভবত তাঁকে প্রান্তে আনা হল। কেশবভবন তখন তৈরি হচ্ছে, ডাক্তারজীর স্মৃতিতে, তাঁর শতবর্ষে (১৮৮৯ সালের ১ লা এপ্রিল সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তারজী তথা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের জন্ম)। সেই কাজ দেখভালের দায়িত্ব পেলেন প্রান্ত কার্যালয় প্রমুখ শ্যামলাল। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এদিকে
১৯৮৯ সালে রামজন্মভূমি আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে শ্রীরাম শিলা পূজনের সূত্রপাত হয়। অতঃপর ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে অযোধ্যায় বিতর্কিত মসজিদের ধাঁচা ভাঙেন হিন্দু করসেবকেরা। তারই ফলশ্রুতিতে আরএসএস সংগঠনের উপর নেমে এলো নিষেধাজ্ঞা। অনেক কার্যকর্তাদের সঙ্গে শ্যামলালও গ্রেপ্তার হলেন।
১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রান্ত সেবা প্রমুখের দায়িত্ব পেলেন। এটাই তাঁর সেরা সময় বলে মনে করতেন। মানুষের সেবা করার জন্যই যে তিনি এসেছেন, এই বোধ তাকে ভেতরে-বাইরে প্রেরণা দিত। সেবার কাজ তিনি আজীবনই করেছেন। নানান জায়গায় দুঃস্থ মানুষের জন্য; এমনকি অসুস্থ, বৃদ্ধ, অসমর্থ্য কার্যকর্তাদের অফুরন্ত সেবাশুশ্রূষা করেছেন; তাদের জামাকাপড় কেচেছেন, তাদের মলমূত্রও পরিস্কার করেছেন।
১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তাঁকে প্রান্ত কার্যকারিণী সদস্য করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে থেকে আমৃত্যু তিনি ছিলেন প্রান্তের আমন্ত্রিত সদস্য। এইভাবে প্রায় তিন দশকের বেশি সময় তিনি কেশবভবনে অবস্থানের কারণে তিনি আর ভবন হয়ে গেলেন অভিন্ন সত্তা। ভবনের পূর্বতন বিল্ডিংয়ের চারতালার সিঁড়ির বিপ্রতীপে ৩১ নম্বর ঘরটি ছিল তাঁর অভিন্ন হৃদয়ের কক্ষ, তা বলতে সমান আনন্দ পেতেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কেশব ভবনে গেলেই তিনি দর্শনার্থীকে প্রসাদ দিতেন, কুশল বিনিময় করতেন, স্নেহ শুভেচ্ছা ভালোবাসা জানাতেন। ঝকঝকে গণবেশ, টিপটাপ মর্জিসম্মত পোষাক — তারই আবরণে সেবা, সহমর্মিতা, সনাতনী প্রচার সবমিলিয়ে তাঁকে এক অনুপম ব্যক্তিত্বে পর্যবসিত করেছিল। যার পুরোটাই তিনি সঙ্ঘকে দান করে গেলেন। গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় নর্থ সিটি নার্সিং হোমের ভেন্টিলেটরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই সন্ন্যাসী। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল এক বর্ণময় সৌম্য সৌকর্যের অধিকারী একটি ঘরানা। স্বয়ং সেবক মহলে নেমে এল অমিত শোক। তাঁর আত্মা চিরশান্তিতে থাকুন এই কামনা। ওঁ শান্তি। হরি ওঁ।
( তথ্য সংগ্রহ : শ্যামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রী পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়; সঙ্ঘ কার্যকর্তা শ্রী বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়, শ্রী অদ্বৈত চরণ দত্ত এবং অসংখ্য স্বয়ং সেবকবৃন্দ। তাদের প্রতি সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা।)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।